এম এ স্বপন : বায়ু দূষণে শীর্ষ পাঁচ শহরের মধ্যে প্রায়ই ঢাকার নাম আসছে। এর অন্যতম কারণ বায়ুতে অতিরিক্ত ধুলো। ধুলার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওযায় বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের নগরীতে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় সোমবার সকালে আবারও শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। এর ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন এই শহরের বাসিন্দারা। সকাল ৮টা ১০ মিনিটে ঢাকার স্কোর ছিল ৩০৬, যার অর্থ হচ্ছে এ শহরের বাতাসের মান ‘ঝুঁকিপূর্ণ’। একিউআই মান ২০১ থেকে ৩০০ হলে স্বাস্থ্য সতর্কতাসহ তা জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ এবং অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। কিরগিজস্তানের বিশকেক এবং পাকিস্তানের লাহোর যথাক্রমে ২২৭ ও ২১৫ একিউআই স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে। একিউআই স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে নগরবাসীর প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
বায়ু দূষণ সূচক এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআইয়ের দেয়া তথ্য বলছে, চলতি মাসের ১৭-১৯ তারিখ ঢাকার বায়ু মান ছিল ২৩০-২১২ পিপিএম, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। এর কদিন আগে প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে বায়ু মান ১৯৬ পিপিএম পরিমাপ করার পর তা অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমতাবস্থায় বাতাসের মান স্বাভাবিক রাখতে ভারতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও বাংলাদেশে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
বায়ুমান সূচক অনুযায়ী বায়ু মান স্কেলের ০-৫০ ভালো, ৫১-১০০ সহনীয়, ১০১-১৫০ অসুস্থ্যদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অস্বাস্থ্যকর, ১৫১-২০০ সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ খুবই অস্বাস্থ্যকর (জরুরি অবস্থা ঘোষণা) এবং ৩০০-৫০০ সকলের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে বায়ু মান ১০০ এর কাছাকাছি পৌঁছালেই শিশুসহ হাঁপানি ও ফুসফুসের রোগীদের বাহিরে বের হতে বারণ করা হয় আর অন্যদের দীর্ঘসময় ধরে বাহিরের কাজকর্ম করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত ঢাকায় মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে। পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। এসব কাজের সামগ্রীগুলো অরক্ষিত অবস্থায় রাখা থাকে। ফলে সেখান থেকে ধুলোর দুষণ বাড়ছে। এছাড়া গাড়ির ধোঁয়া, ইটভাটার ধোঁয়ায়ও বায়ু দূষণ হচ্ছে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ধুলোর দুষণ কমাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না কারায় এর মাত্রা বেড়েছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
সাধারণ মানুষ বলছেন, ঢাকা যেন দুর্ভোগের নগরী। বর্ষাকালে জলাবদ্ধতার আর শুষ্ক মৌসুমে ধুলোর দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক গবেষণা বলছে, ঢাকায় বায়ু দূষণের ৫০ শতাংশ হয় ইটভাটা থেকে, ৩০ শতাংশ রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি ও সিটি করপোরেশনের বর্জ্য থেকে, ১০ শতাংশ দূষণ হয় গাড়ির জ্বালানি থেকে এবং শিল্প কারখানার বর্জ্য থেকে ১০ শতাংশ।
সরেজমিনে দেখা গেছে রাজধানীর মুগদা, মানিকনগর, গোপীবাগ, পল্টন, প্রেসক্লাব শাহবাগ, ফার্মগেট, মিরপুর, মহাখালী, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী এলাকায় ঘুরে ধুলোর দূষণের চিত্র দেখা গেছে। এছাড়া ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, গাবতলী এলাকায়ও ধুলোর দুষণে আবৃত্ত।
অরক্ষিত অবস্থায় যত্রতত্রভাবে নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়েছে। মেট্রোরেল নির্মাণ এলাকা খোঁড়াখুঁড়ি করে রাখা হয়েছে। বাতাসের সঙ্গে বালু, ধুলো মিশে যাচ্ছে। ভারি যানবাহন চলাচল করায় ধুলো তৈরি হয়েছে।
এছাড়া অনেক এলাকায় পানি-গ্যাস লাইন ও ড্রেন নির্মাণের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়েছে। ড্রেনের নির্মাণকাজ শেষে সড়কে কাজ করানো হলেও পানি ও গ্যাস লাইনের জন্য খুড়াখুড়ি করা হলেও সেটি ঠিক করা হয় না। ফলে উন্নয়ন কাজের জন্য রাস্তা ভাঙার পর সেখান থেকে ভাঙা আরো বাড়ে।
খোঁড়াখুঁড়ির পর যে ধুলো হয় সেগুলো প্রশমনের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়না। বিশেষ করে পানি ছিটানো বা ঢেকে রাখার মতো কোনো কাজ করা হয় না।
ধুলোর দূষণ কমাতে উচ্চ আদালত থেকে ব্যবস্থা নিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছে। সে মোতাবেক ঘটা করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন শুরুতে রাস্তায় পানি ছিটানোর কার্যক্রম উদ্বোধন করে। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ধুলোর দুষণ এড়াতে আগে থেকেই রাস্তায় পানি ছিটানোর কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
সিটি করপোরেশন থেকে জানানো হয়েছে সকাল-বিকেল দুই বেলা সড়কে পানি ছিটানো হয়। এছাড়া পরিবেশ দূষণকারীদের জরিমানার আওতায় আনতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে।
তবে নগরীর অনেকে বলছেন, পানি ছিটানোতেও কার্যকরী কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ সকালে পানি ছিটানোর কিছুক্ষণ পর তা শুকিয়ে যায়। পরে আবারো বাতাসে ধুলো উড়তে থাকে। বিকেলেও এই অবস্থা। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়মিত পরিচালনা না করা ও ফলোআপ না থাকায় বায়ু দূষণকারীরা দূষণ করে যাচ্ছে।
বর্ষা মৌসুমে গেল জলাবদ্ধতা। শুষ্ক মৌসুম আসলো আর ধানমন্ডিতে উন্নয়ন কর্মকা- শুরু হলো। এতে ধুলো-বালির মাত্রাও বেড়েছে। মূল সড়ক খুঁড়াখুঁড়ি করে রাখা হয়েছে। এখন ধুলোয় কাপড়ে আস্তরণ পড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. লেলিন চৌধুরী। তিনি মনে করেন, উন্নয়নের আগে দূষণের বিষয়ে চিন্তা না করায় এ সমস্যা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, বায়ু দূষণ, ধুলোয় দূষণের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। উন্নয়ন করতে গিয়ে তো নিজেদের ক্ষতি করতে পারি না।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা আব্দুল মতিন বলেন, কনস্টাস্ট্রাকশনের কাজ করার সময় প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। এতে ধুলো-বালি বাতাসের সঙ্গে ছড়ায় না। কিন্তু আমাদের এখানে এটা করা হয় না। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।