দুবাইস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল (সিজি) বিএম জামাল হোসেন ও তার সহযোগী, এনজিওর নামে পাহাড় পরিমাণ বিদেশি অনুদান গায়েবকারী এনামুল খোন্দকার।
বিশেষ প্রতিনিধি : দুবাইস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটের চরম দূর্নীতিবাজ ও স্বেচ্ছাচারী কনসাল জেনারেল (সিজি) বিএম জামাল হোসেন ও তার সহযোগী, এনজিওর নামে পাহাড় পরিমাণ বিদেশি অনুদান গায়েবকারী এনামুল খোন্দকার দুর্নীতি লুটপাটের মহাসাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। এ চক্র লুটপাট, দালালি, প্রতারণার মাধ্যমে মাত্র তিন বছরেই হাতিয়ে নিয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। তারা শুধু দুর্নীতি লুটপাটই নয়, কুয়েত সরকারের কোটি কোটি টাকাও বেমালুম হজম করে ফেলেছে- এতে রাষ্ট্রীয় ভাবে বাংলাদেশের ইমেজ চরমভাবে ক্ষুন্ন হলেও দুর্নীতির মানিকজোড় রয়েছে বহাল তবিয়তে।
বরং হাজারো অভিযোগ মাথায় নিয়ে লুটপাটের রাঘববোয়াল সিজি জামাল কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলে মর্যাদার সাথে দ্রুত দুবাই কনস্যুলেট থেকে বিদায় নিয়েছে। যেখানে তার অপরাধ অপকর্ম, দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার কথা, সেখানে উল্টো নিজের তদন্তাধীন অভিযোগগুলো গায়েব করে নিরাপদে সটকে পড়েছেন ঘাঘু জামাল হোসেন। এসব অভাবনীয় জাদুকরী তদবিরের মাধ্যমে তাকে রক্ষা করে থাকে তারই লুটপাটের দোসর চিহ্নিত প্রতারক এনামুল খন্দকার। হুজুর ছদ্মবেশী এনামুল মূলত এনজিও প্রতারক হিসেবেই সমধিক পরিচিত।
বহুমুখী এ অপরাধীর বাড়ি হচ্ছে কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানার আলকরণ এলাকায়। সেখানে তিনি কট্টর আওয়ামীলীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী মুজিব পন্থী গ্রুপের অন্যতম নিয়ন্ত্রক। অথচ এনজিওর নামে প্রতারণাকালে বরাবরই এনামুল খন্দকার জামায়াতে ইসলামীর রোকন পর্যায়ের নেতা হিসেবে পরিচিত। দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের শহরসমূহে তিনি সিজি জামাল সিন্ডিকেটের দাপুটে, অগাধ টাকার মালিক বনে যান।
কনসাল জেনারেল (সিজি) বিএম জামাল হোসেনের চরম দূর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় ক্ষুব্ধ প্রবাসী বাংলাদেশীগণ।
দুবাই কনস্যুলেটের প্রধান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উঠা দূর্নীতি ও অনিয়মের নানা তথ্যভিত্তিক অনুসন্ধানী রিপোর্ট।বাংলাদেশ কনস্যুলেট দুবাই ও উত্তর আমিরাতের কনসাল জেনারেল বিএম জামাল হোসেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে যেসকল অনিয়ম ও দূর্নীতি করেছেন এই প্রতিবেদকের সরেজমিন অনুসন্ধানে তার প্রমান পাওয়া গেছে।
দুবাই ও উত্তর আমিরাত কনস্যুলেটের অধীনে ‘দুয়ারে কনস্যুলেট’ নামে বাংলাদেশী প্রবাসীদের জন্যে একটি সেবা কর্মসূচী গ্রহন করেন সিজি জামাল হোসেন । এই সেবা কর্মসূচীর মাধ্যমে দুবাইয়ে বসবাসকারী বাংলাদেশী প্রবাসীদের পাসপোর্ট, প্রবাসী কল্যাণ কার্ড, জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র ইত্যাদি সেবা প্রদান কর্মকান্ড ছয়টি সেন্টার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
সার্ভিস সেন্টার গুলোতে কনস্যুলেট ঘোষিত নির্দিষ্ট দিন তারিখ ও সময়ে কর্মকর্তাগণের একটি টিম গিয়ে সেবা প্রদান করে থাকেন। সেন্টারগুলোতে দুরদুরান্ত থেকে আগত সেবাপ্রার্থী প্রবাসীদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট তারিখের পূর্বে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে এবং সেবা প্রদানের নির্দিষ্ট তারিখে প্রবাসীদেরকে সংগঠিত করে দিনব্যাপী ব্যাবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন বাঙালী কমিউনিটি পরিচালিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা সংগঠন। এর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ এসোসিয়েশন সারজাহ শাখার দায়িত্বে সারজাহ সার্ভিস সেন্টার, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ফুজাইরা শাখার দায়িত্বে ফুজাইরা সার্ভিস সেন্টারটি পরিচালিত হচ্ছে।
দুবাই শহর থেকে বেশ দূরে ওমান সীমান্তের কাছে হাত্তা এলাকার সার্ভিস সেন্টারটি পরিচালনায় রয়েছে ওয়াহাত আল ফালাজ টাইপিং সেন্টার। বাকি তিনটি সার্ভিস সেন্টার আজমান, রাস আল খাইমা ও জেবাল আলী পরিচালনার দায়িত্ব কমিউনিটির কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে না দিয়ে কনসাল জেনারেল তার একক ক্ষমতার অপব্যাবহার করে এনামুল হক খোন্দকার নামক ব্যক্তিকে দিয়েছেন এবং তার নিকট থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। আর্থিক সুবিধা নেয়ার বিষয়টি এখানেই শেষ নয়! প্রতি মাসে ত্রিশ পার্সেন্ট অর্থ প্রদানের শর্তে এনাম খোন্দকারকে তিনটি সার্ভিস সেন্টার পরিচালনার কন্ট্রাক্ট দিয়েছেন।আশ্চর্যের বিষয় হলো একটি নয় দুটি নয় অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে তিন তিনটি সেন্টার পরিচালনার কাজ ভাগিয়ে নেন একই ব্যক্তি।
আরো আশ্চর্য্যের বিষয় হলো এনামুল হক খোন্দকার তিনটি সেন্টার পরিচালনায় যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের নাম উল্লেখ করেছেন সেগুলির অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। যেমন রাস আল খাইমা’র আস-সালাম টাইপিং সেন্টার, আজমানের এএম টাইপিং সেন্টার, জাবেল আলী’র আল-বারাকা টাইপিং সেন্টার।
এসব অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে এনামুল হক খোন্দকার ও কনসাল জেনারেল বিএম জামাল দুজনে মিলে প্রবাসীদেরকে সেবা দেয়ার নাম করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাটিকে “প্রবাসেও দূর্নীতিগ্রস্থ এক টুকরো বাংলাদেশ” বলে সচেতন বাংলাদেশী কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ মন্তব্য করেছেন।
কনস্যুলেটে সিজি জামাল হোসেনের সকল দূর্নীতির আরেক সহযোগী হচ্ছে পাসপোর্ট উইংয়ের প্রধান কাজী ফয়সাল।
সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুবাই কনস্যুলেটের একজন কর্মকর্তা জানান, গত ১৭ মে আজমান সার্ভিস সেন্টারে ট্যুর সেবা কার্যক্রমে রাত দশটা পর্যন্ত কাজ করে আমরা দুবাই ফিরতে চাইলে জর্দান ভ্রমনে থাকা কনসাল জেনারেল জামাল উদ্দিন কর্মকর্তাদেরকে ফোন করে চাপ প্রয়োগ করে বলেন সারারাত কাজ করে হলেও শেষ করতে হবে।
ক্লান্ত কর্মকর্তাগণ সিজি’র ধমকে ভয় পেয়ে ওইদিন ভোররাত পর্যন্ত জেগে কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাত জেগে কাজ করে পরদিন সকালে দূতাবাসের মুল কাজকর্ম পালন করতে গিয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।
সে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আরো একজন জানান কনসাল জেনারেলে’র এ ধরনের চাপ প্রয়োগ করে কাজ আদায়ের মুল কারন হলো সেদিন ওই সার্ভিস সেন্টারে প্রায় চার শতাধিক পাসপোর্টের কাজ হয়েছে। এথেকে যে পরিমান সার্ভিস চার্জ আয় হয়েছিলো তার ত্রিশ পার্সেন্ট পাবেন কনসাল জেনারেল বাদবাকী অর্থ পাবে নিয়ম বহির্ভুতভাবে তিনটি সেন্টার পরিচালনার কাজ ভাগিয়ে নেয়া সেই এনামুল হক।
আরো একটি সুত্র জানিয়েছে বিতর্কিত তিনটি সার্ভিস সেন্টারের ঘর ভাড়া নেয়া, ডেকোরেশানসহ সকল কাজে ব্যাবসায়ীক অংশীদার হয়ে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অবসরপ্রাপ্ত জনৈক কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা নাকি কয়েকমাস পর পর দুবাই এসে কনসাল জেনারেল জামাল হোসেন ও এনামুল হক খোন্দকারের সাথে হিসাব নিকাশ করে তার লাভের পাওনা অর্থ বুঝে নিয়ে যান।
দূর্নীতিবাজ কনসাল জেনারেল জামাল হোসেন তার ক্ষমতার অপব্যাবহার করে কনস্যুলেটে তার মামাতো ভাই অলি আহমেদ ও শ্যালক আতিককে চাকুরীতে নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়াও তার কানাডা প্রবাসী ছেলে দুবাইতে এলে সেও কনস্যুলেট অফিসের চেয়ারে বসে বাবার অংশীদারী ব্যবসা ই-পাসপোর্ট এনরোলমেন্টের কাজ গুলো তদারকি করেন বলে নিশ্চিত করেছেন কনস্যুলেটের কয়েকজন কর্মকর্তা।
সিজি জামাল হোসেনের নিকট এশিয়া রয়েল রেস্টুরেন্ট খাবারের বকেয়া বিল বাবদ বিশ হাজার দেরহাম পাবে। কর্তৃপক্ষ পাওনা অর্থ চাইলে তিনি তা পরিশোধ না করে উল্টো হুমকি ধমকি দেন বলে জানা গেছে। তিনি দুবাইতে কনস্যুলেট কর্তৃক বাংলাদেশী বইমেলা আয়োজনের নামে বিশিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন প্রদেশের বাংলাদেশ এসোসিয়েশন বা সমিতি থেকে চাঁদা আদায় করে থাকেন। এছাড়াও জাহাঙ্গীর টাইপিং সেন্টার থেকে নিয়মিত কমিশন গ্রহন করেন। নানা খাত থেকে প্রচুর অবৈধ অর্থ আয় করে তিনি আজমানের নাইমিয়াতে ‘পদ্মা’ নামের একটি রেস্টুরেন্টের মালিক হয়েছেন।
জামাল হোসেনের সীমাহীন দূর্নীতির বিষয়গুলি জানাজানি হওয়ার পর থেকে বাঙালী কমিউনিটিতে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কনস্যুলেট কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তিতে থাকলেও তাদের মুখ খোলার সাহস নেই। কারণ জামাল হোসেন দুবাই কনস্যুলেটের অঘোষিত রাজা। তিনি নিজেই বলেন তাঁর বাড়ী বাংলাদেশের এমন জেলায় যে জেলার নাগরিক হয়ে যারা সরকারের উচ্চ পদে আসীন তারাই এখন গোটা বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণ করে।
এছাড়াও তিনি নিজেকে বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয় হন এমন একজন প্রভাবশালী নেতার আশির্বাদপুষ্ট বলেও প্রচার করে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে জামাল হোসেনের বিরুদ্ধাচরণ করার মতো সাহস তার অধীনস্থ কোনো সরকারী কর্মকর্তা বা দুবাইয়ে প্রবাসী বাংলাদেশীদের নেই। সে কারণে দুবাই প্রবাসীগণ জামাল হোসেনের দূর্নীতির নানা কর্মকান্ডে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে এসব ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।