বিসিআইসিতে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের মহাদাপট  :সার আমদানীর পরিবহণ খাতে ৬৮ লাখ মার্কিন ডলারের দুর্নীতির তথ্য ফাঁস!

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী সারাদেশ

বিশেষ প্রতিবেদক  :  ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পরও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাট্রিজ কর্পোরেশনে (বিসিআইসি) উচ্চমুল্যে সার আমদানির আওয়ামী সিন্ডিকেট এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। বিদায়ী শিল্প মন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন গ্রেফতার হলেও ধরা ছোয়ার বাইরে রয়েছেন তার ঘনিষ্ট দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিদেশ থেকে উচ্চমুল্যে সার আমদানি ও তা পরিবহণ করে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। বিসিআইসি উৎপাদনকারী সরকারি সংস্থা হলেও একের পর এক কারখানা বন্ধ করে উৎপাদনের পরিবর্তে কৃষকের ভর্তুকির টাকায় সার আমাদানি করে পরিবহণেই উৎসাহ বেশি ছিল কর্মকর্তাদের।


বিজ্ঞাপন

তাদের মধ্যে রয়েছেন ঐ সংস্থার স্বৈরাচারী আমলের ৩ জন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন এবং কামাল আহমেদ মজুমদার। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাঁচটি ইউরিয়া কারখানার মধ্যে তিনটিই বন্ধ ছিল দীর্ঘ দিন ধরে। বিসিআইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গ্যাস সংকট ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কো¤পানি জানুয়ারি থেকে এবং চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার (সিইউএফএল) ও যমুনা ফার্টিলাইজার কো¤পানির উৎপাদন ফেব্রুয়ারি থেকে বন্ধ রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে সাবেক চেয়ারম্যান শাহ মোঃ ইমদাদুল হক দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি ক্রয় বিভাগের তৎকালিন প্রধান ও বিপণন বিভাগের প্রধান শহিদুল ইসলাম ও মঞ্জুর রেজা সহ উপ-মহাব্যবস্থাপক সাইফুল আলম ও কাজী আনোয়ার, ব্যবস্থাপক আবদুস সালাম, মাকসুদসহ কর্মকর্তাদের একটি সিন্ডিকেট কারখানা বন্ধ করে পুনরায় চালু করার জন্য কেনাকাটা এবং কৃষকের জন্য উচ্চ মূল্যে সার আমদানি করে নিজস্ব পছন্দনীয় এজেন্ট এর মাধ্যমে উচ্চ মূল্যে আমদানিকৃত সার পরিবহণ করার কাজ নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। রাষ্ট্রীয় প্রায় ৩০-৩৫টি শিল্প প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিসিআইসি দীর্ঘ যুগ ধরে লাভজনক ভাবে পরিচালিত হচ্ছিল।


বিজ্ঞাপন

মূলত লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কয়েকটি সার কারখানা উল্লেখযোগ্য। যার উৎপাদিত সার বিগত স্বৈরাচারী সরকারের পূর্বে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানীও হতো। উক্ত মন্ত্রণালয়ের দূর্নীতিবাজ সাবেক সচিব ও চেয়ারম্যানসহ পরিচালক এবং বর্তমান একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা আর্থিক লোপাটের ধারাবাহিক কারণে প্রায় সকল সার কারখানাকে আজ গলা টিপে হত্যা করে, সার আমদানির প্রথা চালু করে।

অন্যদিকে, স্বৈরাচারী সরকারের আমলে প্রতিটি সার কারখানার মেরামত ও ওভারলিং করার জন্য নানান পন্থায় দেশী-বিদেশী কেনাকাটা এবং বিদেশ ভ্রমণের মহোৎসব চলছিল।

বিগত স্বৈরাচারী সরকারের শেষ ১০ বছরে সার দুর্নীতির ধারাবাহিক আলোচনা, টপ টু বটম যথা-সার্বক্ষণিক অচেতন শিল্পমন্ত্রী থেকে মহিলা সচিব জাকিয়া সুলতানা, চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল ও শাহ মোহাম্মদ ইমদাদুল হক, বর্তমান চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান এবং অদক্ষ পরিচালকগণের যোগ-সাজশে সবচেয়ে বেশী দূর্নীতির উৎপত্তি হয় এই কেনা-কাটা থেকে।

উক্ত দূর্নীতিবাজ ব্যক্তিরা আমু, হুমায়ুন মজিদদেরকে প্রায় ২ ডজন বড় বড় লাইটার জাহাজের মালিক বানিয়ে শান্তিতে রেখেছিলেন। ক্রয়বিভাগের জিএম শহীদুল ইসলাম, ম্যানেজার সাইফুল (বর্তমানে ডিজিএম, ক্রয়বিভাগ), জিএম আবুল ফয়েজ মো: হাবিবুর রহমান এবং আব্দুস সালাম সহ বিপণন বিভাগের জিএম মঞ্জুর রেজা, নূর নবী, কাজী আনোয়ার হোসেন, জিএম মাকসুদুল আলম সহ একটি সিন্ডিকেট বিগত ১০ বছরের কেনাকাটার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ও দূর্নীতি করে নামে বেনামে ব্যাংক ব্যালেন্স ও একাধিক লাক্সারিয়াস ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে উঠেন। সারের বস্তা ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাৎসরিক শুধুমাত্র ১৬ লাখ মেট্রিক টন সারের জন্যে প্রায় ৪০ কোটি বস্তা ক্রয় করতে হয়।

সেক্ষেত্রেও ১৪০ গ্রাম ওজনের বস্তার স্থলে ৯৬ গ্রাম সারের বস্তা কিনে, শত কোটি টাকা দূর্নীতি করে, যার কারণে হাজার হাজার মেট্রিক টন সার নষ্ট হয়। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমদ, সাবেক চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ ইমদাদুল হক এর স্কুল বন্ধু হওয়াতে, তারই যোগ-সাজশে কেনাকাটার এই দূর্নীতিতে ক্রয় বিভাগের কর্মকর্তারা কাউকেই তোয়াক্কা করেননি। পরবর্তীতে তারা রাষ্ট্রীয় সকল সার কারখানা বন্ধ করে দিয়ে, স¤পূর্ণ আমদানী নির্ভরশীল হয়ে সার আমদানীর উপর অতি উৎসাহিত হয়। টাকার জোর দেখিয়ে অদক্ষ কর্মকর্তা হওয়া স্বত্তেও একেক জন একই চেয়ারে বসে তিনটি করে প্রমোশন ভোগ করছে। গত আগস্ট মাসে বাঘাবাড়ি, সিরাজগঞ্জ ঘাটে গোপনে সার বিক্রি হচ্ছে এমন খবর গণ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

বাঘাবাড়ী নৌবন্দর এলাকার বাফার গুদাম এবং বন্দর ইয়ার্ড ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২০-২১ এবং ২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রামের মেসার্স নবাব ট্রেডিং কো¤পানির মাধ্যমে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে প্রায় ১২ হাজার টন ইউরিয়া সার আনা হয়। কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, এগুলো নবাব এন্ড কো¤পানীর সুপ্রিম কোর্টের অকশনকৃত সার, এগুলো তাদের আওতায় নেই।

এ বিষয়ে উক্ত সার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নবাব গ্রুপ এন্ড কো¤পানীর কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইলে, তারা জানান, তারা দীর্ঘ ৩৫ বছর যাবৎ কোটি কোটি মেট্রিক টন সারের দেশী ও বিদেশী পরিহণের ব্যবসা করেছেন। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের শেষ ১০ বছরে তারা লাঞ্চিত হয়েছেন এবং তাদের পাওনা বিল ২১১ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক জাহাজ ভাড়া ৪৭ লক্ষ মার্কিন ডলার এখনো বিসিআইসি পরিশোধ না করে লোকাল চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে উল্টো সার আত্মসাতের অভিযোগ করে। এতে হাইকোর্টের জামিন থাকা অবস্থায়, উক্ত দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যানের যোগ-সাজশে সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য বেনজির আহমদ এর নির্দেশে মৌখিক অভিযোগে সিসিটি এর মাধ্যমে হাইকোর্টের গেট থেকে গ্রেফতার করায়।

সার গ্রহণ করার টাকা পরিশোধের জন্য একাধিক মামলায় উচ্চ আদালতের আদেশ প্রাপ্ত হয়েও নবাব এন্ড কোম্পানীর ট্রানজিটে থাকা ২৪৩ মার্কিন ডলারে ক্রয়কৃত সার গ্রহণ না করে, দেদারসে ৯৭০ ডলারে করে সার আমদানী ও পরিবহণ করে। বিল ও জাহাজ ভাড়া পরিশোধের জন্য শিল্প উপদেষ্টার কাছে নবাব এন্ড কোং এর লিখিত আবেদনে বলা হয়, দীর্ঘদিন যাবত তার প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২১১ কোটি টাকা পাওনা বিলের মধ্যে ৪৭ লাখ মার্কিন ডলার জাহাজ ভাড়া রয়েছে। দীর্ঘদিন তাদের জাহাজ মালিকের পাওনা পরিশোধ না করার কারণে তারা ভারত ও আরব সাগরে বিসিআইসির কার্গো লিয়েন করবে মর্মে জানিয়েছে এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫,২৬৪ কোটি টাকার জন্য আইনি নোটিশ প্রদান করা হয়েছে।

অতিরিক্ত মূল্যে নতুন ইউরিয়া সার ক্রয় এবং তা পরিবহণে বিরাট অংকের আর্থিক লাভবান হয়েছেন কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট। সার গ্রহন করা ও তাদের পাওনা বিল পরিশোধ এবং খালি ও নতুন বস্তা সরবরাহের জন্য বিসিআইসিকে হাইকোর্ট একাধিক আদেশ প্রদান করলেও তা অমান্য করায় এবং সম্প্রতি ৭টি পত্রিকায় নিলাম বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে, যেখানে যে অবস্থায় আছে ভিত্তিতে বিসিআইসির উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে উক্ত ট্রানজিটে থাকা ইউরিয়া সারের ৩১/০৩/২০২৪ ইং নিলাম স¤পন্ন করেন। অন্যদিকে, স্বৈরাচারী সরকারের অপরাধ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দূর্নীতি ঢেকে রেখে সার্ভিস বেনিফিট ভোগ করে উক্ত কর্মকর্তারা অবসরে যাওয়ার পায়তারা করছে।

অভিযোগের বিষয়ে বিসিআইসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মো. সাইফুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, বিসিআইসিতে কোন সিন্ডিকেট নেই। কারখানা বন্ধ রেখে সারআমদানীর যে অভিযোগ তা সঠিক নয়। তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্টসময়ের মধ্যে সার সরবরাহ দিতে পারেনি নবাব এন্ড কো¤পানী। এ বিষয়ে নবাব এন্ড কোম্পানীর কাছে জানতে চাইলে তারা জানায়, সারের প্রয়োজন স্বল্পসময়ে প্রায় ১৬ লাখ টন, কিন্তু বিসিআইসির নিকট ট্রানজিট গুদাম আছে মাত্র ৩ লাখ ৭৫ হাজার টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন। দৈনিক গ্রহণ করে প্রায় ৪ থেকে ৫শত টন।

অন্যদিকে দৈনিক ৩ হাজার টন জাহাজ থেকে খালাস করতে না পারলে ৩০ হাজার মার্কিন ডলার জরিমানা গুনতে হয়। তাই ট্রানজিটে থাকাটা দরপত্রেও লিখিত প্রচলিত। কোন কালেও বিসিআইসি সময়মত সার নিতে পারে নাই। তাই প্রতিটি জাহাজেরই প্রায় ৫ থেকে ৬ বছর দীর্ঘায়িত হওয়াটাও প্রচলিত।

জানা যায়, পূূর্বের বছর গুলোতে দক্ষ কর্মকর্তা জি এম মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, ইমদাদ জাহাঙ্গীর সৈয়দ খুরশিদ হাসেম নিজস্ব বুদ্ধিতে টেন্ডার আহ্বান করে আন্তর্জাতিক সার পরিবহণ করাতো। বর্তমানে অদক্ষ দূর্নীতিবাজ জিএমরা প্রতি টনে ২ দশমিক ৫ শতাংশ (মার্কিন ডলার) হারে, ভর্তুকির টাকা হতে অতিরিক্ত কমিশন দিয়ে টেন্ডার কার্যক্রম বিএসসি’র মাধ্যমে করানো হয়। যদিও বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রকাশ্য নির্দেশ, সরকারী কেনাকাটায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগীতামূলক দরপত্র আহ্ববান
করতে। কিন্তু উক্ত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগ সাজশে বিএসসি এলটিএম এ দরপত্র আহ্বান করে। ইতিপূর্বের জিএমরা এলটিএম বা লিমিটেড টেন্ডার মেথড এ ছিল না। ওপেন টেন্ডার মেথড বা ওটিএম টেন্ডার অনুষ্ঠিত হতো।

এই নিয়মে, উক্ত প্রতিষ্ঠান ২০২১-২০২২সালে ২০টি আন্তর্জাতিক সার পরিবহণ টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে এবং প্রায় ৬০ লাখ মার্কিন ডলার কম দরে সর্বনিন্ম দরদাতা হওয়া স্বত্ত্বেও, তাদেরকে কাজ না দিয়ে অধিক দরে ২য় এবং ৩য় দরদাতাকে কাজ দেয়। অথচ পিপিআর অনুসারে যে কোন কারণে প্রথম দরদাতাকে কাজ না দিলে ২য় দরদাতাকে কাজ দিতে হলে, প্রথম দরদাতার দরে কাজ দিতে হয়, অন্যথায় রি-টেন্ডারের বিধান রয়েছে। এ বিষয়ে নবাব এন্ড কোম্পানী পাওনা পরিশোধের জন্য শিল্প উপদেষ্টা, শিল্প সচিব এবং বিসিআইসি চেয়ারম্যান এর সাথে একাধিক বার দেখা করেও কোন সুরাহা হয়নি।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *