কাদেরের হাতের ছোঁয়ায় শতকোটির মালিক বনে যান সবুজ উদ্দিন :  সমাজসেবার নামে স্ত্রীকে দিয়ে চালাতেন এনজিও, কালো টাকা সাদা করার নতুন কৌশল এনজিও ব্যবসা

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী

নিজস্ব প্রতিবেদক  :  সড়ক পরিবহনে চাকরি মানে আলাদিনের চেরাগ। তার বাস্তব উদহরণ সড়ক পরিবহন এর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ খান। আওয়ামীগ ক্ষমতায় আসার পর নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে তত্ত্বাবধায়ক পরে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বনে যান।


বিজ্ঞাপন

পরে সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এর আশির্বাদপুষ্ট হয়ে নামে বেনামে সম্পদের অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোঃ সবুজ উদ্দিন খান। অল্পদিনের ব্যবধানে সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ডান হাত হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যান তিনি। সরকারি কর্মকর্তা হলেও তাঁর চলাচল, কাজকর্মে ছিল রাজনৈতিক নেতাদের মতো উদাসীন। ওবায়দুল কাদেরের আশীর্বাদপুষ্ট এই কর্মকর্তা হয়েছেন শত শত কোটি টাকার মালিকও। স্ত্রী মাহমুদা আক্তার পান্নাকে এমপি বানানোর স্বপ্নও ছিল তার।


বিজ্ঞাপন

সেই লক্ষ্যে স্ত্রীকে দিয়ে চালাতেন একটি অনিবন্ধিত এনজিও; যার কাজ ছিল মূলত সবুজের কালো টাকা সাদা করা।
সড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে ওবায়দুল কাদেরের আস্থাভাজন হিসেবে অত্যন্ত একরোখা ও দাপুটে কর্মকর্তা হিসেবেই পরিচিতি ছিল তার। অবশ্য সরকার বদলের পর সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের ঢাকা সার্কেলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে করা হয়েছে জয়দেবপুর-বেদগ্রাম-ভূলতা-মদনপুর বাইপাস প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক।


বিজ্ঞাপন

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৯ সালের পর থেকে ঘুরেফিরে সড়ক বিভাগের মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও ঢাকা এই তিন কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন সবুজ খান। আট বছর টানা দায়িত্বে ছিলেন অধিদপ্তরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঢাকা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে। তার বিরুদ্ধে ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অলিখিত মালিক হিসেবেই পরিচিতি ছিল তার।

সওজ অধিদপ্তরের একটি বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে নতুন কাজের ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। অর্থমূল্যের দিক দিয়ে মোট নতুন কাজের প্রায় অর্ধেক পেয়েছেন পাঁচ ঠিকাদার। এর মধ্যে অন্যতম এই আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন। গত পাঁচ বছরে সড়ক বিভাগে সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন, যার পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ১০০টির মতো। এককভাবে তারা পেয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার কাজ। আবেদ মনসুরের অধীনে এখন চলমান কাজ ২১৮টি। এগুলোর প্রকল্প ব্যয় প্রায় ১৭৬ কোটি টাকা।

সড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খানের হাত ধরেই আবেদ মনসুরের কোম্পানির অগ্রযাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠানটি সওজ অধিদপ্তরে ঠিকাদারি শুরু করে বছর সাতেক আগে। সবুজ উদ্দিন খানের আওতায় গাজীপুর ও মানিকগঞ্জে অধিকাংশ কাজ দখলে নিয়ে তারা বনে গেছেন শত শত কোটি টাকার মালিক। সবুজ খানের সঙ্গে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের এতটাই দহরম-মহরম সম্পর্ক যে অনেকেই সবুজকে ফার্মটির অদৃশ্য মালিক মনে করতেন।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর উত্তরায় ১১ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর রোডের ২৫ নম্বর বাড়িটির মালিক সবুজ উদ্দিন খান নিজেই। বাড়িটির নকশাও তার নামে। যদিও প্লটটি বুকিং দেওয়া হয় তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার পান্না, শ্যালিকা নুরজাহান আক্তার ও নারগিস আক্তার হীরার নামে।সরেজমিন অনুসন্ধান বলছে , বিলাসবহুল বাড়িটিতে সবুজ উদ্দিন এর উপস্থিতি কম থাকলেও , সেখানে তার স্ত্রী শ্যালিকা এবং শ্যালিকার স্বামী বসবাস করেন। আর তিনি থাকেন রাজধানীর গুলশানের বাড়িতে। এছাড়া রাজধানীর মিরপুর কল্যাণ পুর বাংলাদেশ স্পেশালিস্ট হসপিটালের ৫০ ভাগ মালিকানা ভোগ করেছেন সবুজ উদ্দিন। তাঁর বাড়ি পাবনার বেড়া উপজেলার আমিনপুর এলাকায়। সেখানে তার স্ত্রী পান্না সিনথি চ্যারিটি ফাউন্ডেশন নামে অনিবন্ধিত এনজিও পরিচালনা করছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার দপ্তরের একাধিক সহকর্মী বলেন, উল্লেখিত মানবকল্যাণ সংগঠনটির নামে বিভিন্ন কারসাজি দেখিয়ে কালো টাকাকে সাদা করার একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন এ প্রতারক প্রকৌশলী। অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারদের সুবিধা দিয়ে ফাউন্ডেশনটিতে চাঁদাও আদায় করতেন সবুজ উদ্দিন। দুর্নীতির টাকা স্থানীয় বিশ্বস্ত কিছু অনুসারীর কাছেও রেখেছেন সবুজ ও তার স্ত্রী।সবুজের বিরুদ্ধে সিনথি ফাউন্ডেশন ও পরিবারের নামে জমি দখলসহ নানা অভিযোগ করেছেন । সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢালারচর ইউনিয়নের মীরপুর চরে ১০০ বিঘা জমি রয়েছে সবুজ পরিবারের। স্ত্রী মাহমুদা আক্তার পান্নার নামে জাতসাখিনী ইউনিয়নের নান্দিয়ারা গ্রামে রয়েছে ৩০ বিঘা জমি, গাজনার বিলেও মাহমুদার নামে অন্তত ৫০ বিঘা জমি রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সবুজ উদ্দিন খানের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জানান, আমিনপুর থানার মাসুন্দিয়া ইউনিয়নের সবুজের গ্রামের ডুপ্লেক্স বাড়ি ২০ বিঘা জমির ওপর। যার বর্তমান মূল্য অন্তত ১০ কোটি টাকা। একই গ্রামে সিনথি পাঠশালা নামে ৫০ বিঘা জমির ওপর মাঠসহ স্কুল ও গরুর ফার্ম করেছেন মাহমুদা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, এর মধ্যে অন্তত ৪০ বিঘা জমিই জবরদখল করেছেন তারা। শ্যামপুর গ্রামের আক্কাস, মজিদ প্রাং, সনতেষ মণ্ডলসহ কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগ, জমি বিক্রিতে রাজি না হওয়ায় মাস্তান বাহিনী দিয়ে তাদের জমি দখলে নিয়েছেন সবুজ ও মাহমুদা। এ ছাড়া শ্যামপুর, চর শ্যামপুর, দয়ালনগর, আমিরাবাদ, মালঞ্চি, বাদাই, শাতালী, তালিমনগর, চিনাখড়া ও কাশিনাথপুর-নান্দিয়ারা গ্রামে নামে-বেনামে ২০০ বিঘা জমি আছে।

সবুজ খানের ওই আত্মীয় আরও বলেন, ‘সবুজ যেন একটি টাকার মেশিন।

অবৈধ আয় লুকাতে ঘুষের টাকায় স্ত্রীকে দিয়ে সমাজসেবার নাটক করতেন তিনি। ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকায় স্ত্রী মাহমুদা আক্তার পান্নাকে পাবনা-২ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি বানানোরও স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। ভয়ে আমরা কিছুই বলতে পারিনি। তারা যে পরিমাণ লুটপাট করেছেন, আমরা পরিবারের সদস্য হয়েও লজ্জিত। আমরা তাদের শাস্তি চাই।’

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান ও মাহমুদা আক্তারকে বারবার ফোন দেওয়া হলেও রিসিভ করেননি। মোবাইল ফোনে বার্তা দিয়েও সাড়া মেলেনি। তবে, অনুসন্ধানের বিষয়টি জানতে পেরে অনুসারী স্থানীয় কিছু সাংবাদিককে দিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করতে বারবার অনুরোধ ও উৎকোচের প্রস্তাবও দেন মিনপুরের বাসিন্দারা।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *