মাগুরা প্রতিনিধি : মাগুরা জেলার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের আউটসোর্সিং চুক্তিভিত্তিক জনবল সরবরাহের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগের টেন্ডারে ভয়ংকর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। একটি বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে সরকারের আউটসোর্সিং নীতিমালার বিধি লংঘন করে টেন্ডারে বিশেষ বিশেষ শর্ত আরোপ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের একটি আউটসোর্সিং ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য হাসপাতালের তত্তাবধায়ক ডা: মহাসিন ফকির ও সংশ্লিষ্ট কর্মচারিরা এই অনিয়ম করেছেন বলে দাবী করা হয়েছে।

সূত্রমতে, মাগুরা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ১৪ জন আউট সোর্সিং কর্মী সরবরাহের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য গত ২৪/০৩/২০২৫ তারিখে দরপত্র আহবানের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এই দরপত্র বিজ্ঞপ্তি ২ টি জাতীয় দৈনিক (একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি) এবং একটি আঞ্চলিক বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকায় ছাপানোর বিধান থাকলেও সেটি প্রতিপালন করা হয়নি। মাগুরা থেকে প্রকাশিত একটি অনিয়মিত দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে যা কোন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের খুঁজে পাননি।

এ ছাড়া দরপত্রে অংশ গ্রহন করার যোগ্যতার ক্ষেত্রে যে সব শর্ত আরোপ করা হয়েছে তা কেবল পিপিআর বর্হিভুতই নয় রিতিমত মনগড়া ,দায়িত্বজ্ঞানহীন ও শঠতাপূর্ণ। দরপত্র বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী পিপিএ-২০০৬, পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী ফলো করার কথা বলা হইছে। দরপত্র সিডিউলের ৩ নম্বরে শর্তে ২৫,০০,০০০/- (পঁচিশ লক্ষ) টাকার ব্যাংক স্থিতিশীল সনদসহ ব্যাংক স্টেটমেন্ট সহ (২০২৩-২৪ অর্থ বছরের মূলকপি দাখিল করিতে হইবে) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই শর্ত পিপিআর-এর কোথায়ও নাই।

৬ নং শর্তে জয়েন্টস্টক কোম্পানির সনদ চাওয়া হয়েছে। জয়েন্টস্টকের আর্টিকেল মেমোরেন্ডমের লাইসেন্স হয় , কোন সনদ হয় না। ৮ নং শর্তে প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কর্তৃক জনবল/ কর্মী সরবরাহের লাইসেন্স চাওয়া হয়েছে । যার কোন বিধান নেই। ১২ নং শর্তে শ্রম অধিদপ্তরের জনবল সরবরাহের বৈধ লাইসেন্স চাওয়া হয়েছে। শ্রম অধিদপ্তর শুধু কলকারখানার লাইসেন্স দেয় অন্য কোন লাইসেন্স দেয় না।
৮নং শর্তে ২ এর পৃষ্ঠা (১) ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরের টি.আই.এন নম্বর টিন সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছে। এটা যে কোন বছরেরই হতে পারে, নির্ধারিত কোন বছর উল্লেখ থাকে না।
২০২৪-২০২৫ আয়কর পরিশোধের প্রত্যয়নপত্র এবং রিটার্ন দাখিল সার্টিফাইড কপি দাখিল করিতে হইবে মর্মে শর্ত আরোপ করা হয়েছে। অথচ: ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরের রিটার্ন এখন পর্যন্ত সরকার জমা নেয় নাই। ঠিকাদার কিভাবে জমা দিবে? আরেকটি শর্তে স্ব-স্ব জেলার বাণিজ্যিক সংগঠনের চেম্বার অব কমার্সের ২০২৫ সালের সদস্য হইতে হবে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা পিপিআর বহির্ভূত। এ ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা নাই।
১৫ নং শর্তে দরপত্র বিজ্ঞপ্তির পেপার কাটিং চাওয়া হয়েছে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন টেন্ডারেই পেপার কাটিং চায় না । আর কোন পেপারে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে তাও ঠিকাদার জানেন না। বিধি অনুযায়ী দেশের বহুল প্রচারিত ন্যূনতম দুইটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে, একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি কিন্তু এখানে দেখা গেছে, দৈনিক খেদমত নামক লোকাল একটি একটি অনিয়মিত পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।
১৬ নং শর্তে আর্থিক স্বচ্ছলার সনদপত্র বা ব্যাংক সলভেন্ট সার্টিফিকেট এর মূলকপি দাখিল করিতে হইবে এবং উহাতে বর্তমান স্থিতিশীল উল্লেখ পূর্বক সনদ পত্র যাহা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ম্যানেজারে নাম, সীল. মোবাইল নং, ই-মেইল নং, টিএনটি নং এবং দুইটি মোবাইল নং উল্লেখ থাকতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যা উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং পিপিআর এর সাথে সাংঘর্ষিক।
আরেকটি শর্তে যে কোন তফসিল ভূক্ত ব্যাংক হতে সিডিউল ড্রপিং এর পূর্বে ব্যাংক স্টেটমেন্ট উহাতে কমপক্ষে ৩,০০,০০,০০০ (তিন কোটি) টাকার লেনদেন সহ সিডিউল ড্রপিং এর পূর্ব দিন পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে ৭ দিন ২৫,০০,০০০ (পঁচিশলক্ষ) টাকা স্থিতিসহ স্টেটমেন্ট দাখিল করিতে হইবে উহাতে বর্তমান স্থিতি উল্লেখ পূর্বক সনদপত্র যাহা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ম্যানেজারের নাম সহ অরিজিনাল সিল হতে হবে, কম্পিউটার প্রিন্ট গ্রহণযোগ্য নয়, ই-মেইল নং, টিএনটি নং এবং দুইটি মোবাইল নং সনদে উল্লেখ থাকতে হবে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে । এটা পিপিআর এর সাথে অত্যন্ত সাংঘর্ষিক ।
২১ নং শর্তে বাংলাদেশ জয়েন্ট স্টক কোম্পানি হতে ঠিকাদার সংস্থার রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত জনবল সরবরাহকারী লিমিটেড কোম্পানি হইতে হইবে এবং এর পক্ষে হালনাগাদ সনদায়নকৃত সনদ পত্রের সত্যায়িত ফটোকপি জমা দিতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জয়েন্ট স্টক এ ধরণের সনদ কখনোই দেয় না।
জয়েন্টস্টকের কখনো সনদ হয় না সরাসরি লাইসেন্স হয়। সেটার নাম আর্টিকেল অব মেমোরেন্ডম । এখানে আরো বলা হয়েছে যে, প্রতিষ্ঠানটিকে লিমিটেড কোম্পানি হইতে হবে। তাহলে প্রোপাইটারশীপ প্রতিষ্ঠানগুলো কি আংগুল চুষবে?
৩৫ নং শর্তে একক মালিকাধীন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১ম শ্রেণির ম্যাজিষ্ট্রেট হলফনামায় সত্যায়িত ফটোকপি দরপত্রের সাথে দাখিল করিতে হইবে। বলা হয়েছে। ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব কি ঠিকাদারের মামা হন না খালু হন যে তিনি এই সত্যায়ণ প্রদান করবেন? । বাংলাদেশের কোন দরপত্র সিডিউলে এ ধরণের কোন কথা উল্লেখ থাকে না।
৩৮ নং শর্তে দরপত্র কমিটির বিরুদ্ধে কেহ কোন আইনের আশ্রয় লইতে পারিবে না। বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলে দরপত্র কমিটির সদস্যরা যদি অনিয়ম-দুর্নীতি করেন তাহলে কেন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান আইনের পদক্ষেপ না নিয়ে তাদেরকে কি জুতা দিয়ে পেটাবে?
শর্তাবলী ৬ এ ১০ লক্ষ টাকার ব্যাংক গ্রান্টি/ পে-অর্ডার যাচাই কোন অসংগতি পরিলক্ষিত হইলে দরপত্র বাতিল সহ দরপত্রদাতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে। এখানে সিডিউলে কেন ১০ লক্ষ টাকার কথা আসছে সেটা কারো বোধগম্য নয়।
শর্তাবলী ৮ এ ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরের আয়কর প্রত্যয়নপত্র জমা দিতে হবে বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার এই অর্থ বছরের রিটার্নইতো জমা নেয় নি তাহলে আয়কর প্রত্যয়নপত্র জমা দিবে কিভাবে? রিটার্ন জমা দেওয়ার ন্যূনতম ৩ মাস পরে আয়কর রিটার্নের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়।
এভাবে দরপত্রের সিডিউল বিক্রির ক্ষেত্রে বিশেষ শর্ত আরোপ করে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে অধিক সংখ্যক প্রতিষ্ঠান যাতে অংশ গ্রহন করতে না পারে তা সুনিশ্চিত করা হয়েছে।
বিগত দিনে আউটসোর্সিং জনবল সরবরাহ করেছে এমন একটি আওয়ামী ঘরাণার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কাজটি পাইয়ে দেওয়ার জন্য এসব অতিারিক্ত শর্ত আরোপ করা হয়েছে বলে দাবী করছেন স্থানীয় আউটসোর্সিং ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্তাবধায়ক ডা: ডা: মহাসিন ফকির বলেন, অতীতের ধারাবাহিকতায় দরপত্র আহবান করা হয়েছে। অজ্ঞতাবশত: সিডিউলের শর্তে যদি কিছু ভুলত্রুটি বা অনিয়ম থাকে তবে সেগুলো সংশোধন করে পুন: দরপত্র আহবান করা হবে।
তবে প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের অভিমত, দরপত্র আহবান করার সময় পিপিআর এর অনুশাসন মেনে সতর্কতার সাথে ফাইল ওয়ার্ক করা উচিত ছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সিডিউলের শর্তগুলো ভালোভাবে যাচাই বাছাই করে স্বচ্ছতার সাথে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা বাধ্যতামুলক ।
পিপিআর এর নির্দেশনা বর্হিভুত শর্ত আরোপ করা হলে সেটি কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের প্রমাণ বহন করে। সে ক্ষেত্রে সরকারী দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অবহেলা বা গাফিলতির দোষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অধিকারী হবেন। তারা এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিবের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন।