!!  মন্তব্য প্রতিবেদন  !!  আওয়ামি লিগের আউলিয়াপনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াপনা !

Uncategorized জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজনীতি সংগঠন সংবাদ সারাদেশ

বিশেষ প্রতিবেদক  :  ‘বাংলাদেশ আওয়ামি লিগ’ বেমালুম ‘ভারত আওয়ামি লিগ’-এ পরিণত হয়েছে— আট মাস হয়ে গেছে। আট মাস আগে দলটির ঊর্ধ্বতন নেতারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কোলকাতায় ‘প্রবাসী সরকার’ গঠন করেছেন, দেশে দলীয় কর্মীদেরকে মৃত্যুর মুখে রেখে বিদেশে যাপন করছেন আকণ্ঠ আয়েশি জীবন। আগস্টপরবর্তী আট মাসে আওয়ামি লিগের কোনো নেতা এমন কোনো বক্তব্য দিতে পারেননি, যা শুনে আওয়ামি লিগের কোনো কর্মী বা ভোটার উজ্জীবিত হবে। আওয়ামি লিগের সুবিধাভোগী কোনো বুদ্ধিজীবী এমন একটা কলাম লিখতে পারেননি; যে-কলামটা পড়ে পাঠক আওয়ামি লিগের প্রতি সহানুভূতি বোধ করবে, আওয়ামি লিগকে নিরপরাধ ভাববে অথবা আওয়ামি লিগকে পুনর্বার ক্ষমতায় আনতে ইচ্ছুক হবে। আওয়ামি লিগের আমলে সুবিধা-পাওয়া কোনো সাংবাদিক বা চলচ্চিত্রকার এমন কোনো একটা প্রতিবেদন বা প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে পারেননি, যেটা দেখে দর্শক আওয়ামি লিগের প্রতি ন্যূনতম করুণা বোধ করবে। আওয়ামি লিগের আমলে পদক-পাওয়া, শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতিসংঘসফরে-যাওয়া বা গণভবনে চড়ুইভাতি-করা কোনো কবি এমন একটা কবিতা বা ছড়া এই সাত মাসে লিখতে পারেননি, যেটা পড়ে সাধারণ পাঠক আওয়ামি লিগের প্রতি বিন্দুমাত্র আকৃষ্ট হবে। আওয়ামি লিগের মুড়িমুড়কি-খাওয়া কোনো কার্টুনিস্ট বর্তমান সরকারের কোনো কর্তাব্যক্তির এমন কোনো একটা কার্টুন আঁকতে পারেননি, যেটা দেখে সাধারণ মানুষ বর্তমান সরকারের ওপর বিরক্ত হয়ে আওয়ামি লিগের দিকে ধাবিত হবে। বর্তমান সরকারের সমালোচনা তারাই করে চলছেন— যারা বিগত দেড় দশক ধরে আওয়ামি লিগ সরকারেরও সমালোচনা করেছিলেন, দুই দশক আগে বিএনপি সরকারেরও সমালোচনা করেছিলেন। যারা সব সরকারেরই সমালোচনা করেছেন; সেইসব স্বাধীন-সার্বভৌম বুদ্ধিজীবীদেরকেই মানুষ চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে, দলীয় বুদ্ধিজীবীদেরকে না। দল পালিয়ে যাওয়ার সাথে-সাথে দলীয় বুদ্ধিজীবীরাও নিঃশর্তভাবে গর্তে ঢোকে। স্বাধীন বুদ্ধিজীবীরা বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে এক অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছেন বলেই পলাতক আওয়ামি লিগ ডিঅ্যাক্টিভেটেড ফেসবুক আইডি রিঅ্যাক্টিভেট করার সুযোগ পেয়েছে, নইলে এই আওয়ামি লিগকে আরো দেড় বছর ফেসবুক থেকেও পলাতক থাকতে হতো। আওয়ামি লিগের পলাতক নেতাকর্মীরা এখন ফেসবুকে যে মাথা তুলে উঁকি দিতে পারছেন; এর কৃতিত্বও তাদের নিজেদের না, বরং স্বাধীন বুদ্ধিজীবীদের। ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর আওয়ামি লিগ এখন বিশ্বজুড়ে মশাল জ্বালিয়ে বুদ্ধিজীবী খুঁজছে তাদের পক্ষে একটা কথা বলানোর জন্য। আওয়ামি লিগের এমন একজনও নেতা বা বুদ্ধিজীবী নেই, এই মুহূর্তে যিনি কোনো বক্তব্য দিলে সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাস করবে বা ন্যূনতম পাত্তা দেবে।


বিজ্ঞাপন

ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামি লিগ স্বাধীন বুদ্ধিজীবীদেরকে তিলে-তিলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১১ সালে দেশজুড়ে সড়কদুর্ঘটনার পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর— সড়কদুর্ঘটনায় বিশেষত এই দু’জনের মৃত্যুর পর চারদিক থেকে দাবি উঠেছিল যোগাযোগমন্ত্রীকে (সৈয়দ আবুল হোসেন) পদত্যাগ করতে হবে। কলামলেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ ঘোষণা দিয়েছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী পদত্যাগ না-করলে তিনি কেন্দ্রীয় শহিদমিনারে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে ইদ পালন করবেন। আবুল মকসুদ মারা গেছেন ২০২১ সালে। পৌনে একশো বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। এই দীর্ঘ জীবনে তিনি নির্দিষ্ট কোনো দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন— এমন অভিযোগ কেউ ঘুণাক্ষরেও তুলতে পারবে না। ২০০৩ সালে ইউএসএ যখন ইরাকে আক্রমণ করে নিরীহ মানুষজনকে হত্যা শুরু করে, তখন এর প্রতিবাদে আবুল মকসুদ শাদা কাপড় পরে প্রতিবাদ জানান। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর (মহাত্মা গান্ধী) অহিংস নীতির অনুসারী সেলাইবিহীন দু’খণ্ড শাদা কাপড় পরে সেই যে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি সেই প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিলেন; অর্থাৎ দু’খণ্ড শাদা কাপড়ই পরে ছিলেন। আবুল মকসুদ ২০১১ সালে শহিদমিনারে ইদ পালন করায় আওয়ামি লিগ সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিল এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মকসুদকে নিয়ে তীব্র কটাক্ষ করেছিলেন। হাসিনা প্রকাশ্যে বলেছিলেন আবুল মকসুদকে কে টাকাপয়সা দেয়, তা তিনি দুদকের মাধ্যমে খুঁজে বের করবেন। আবুল মকসুদ শেখ হাসিনার পতন চাননি, সেরেফ সড়কপথে নিরাপদে চলার নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন। এর প্রেক্ষিতে হাসিনা যে-আচরণ করেছিলেন, তা অন্তত আমার তরুণমনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। আবুল মকসুদের আহ্বানে শহিদমিনারে যারা ইদ পালন করতে গিয়েছিলেন, তাদের ভিড়ে আমিও ছিলাম। আমার কলমে-কলামে আবুল মকসুদের প্রভূত প্রভাব আছে।


বিজ্ঞাপন

আওয়ামি লিগ-মন্ত্রিসভার সবচেয়ে হাস্যকর চরিত্রগুলোর মধ্যে হাছান মাহমুদের রোল নম্বর ওপরের সারিতে। জাতীয় জীবনে এমন কোনো ইশু ছিল না, যা নিয়ে এই বাচাল মিচকে মন্তব্য করতে ছাড়তেন। শেখ হাসিনা তাকে একাধিকবার মন্ত্রিত্ব দিয়েছিলেন। আওয়ামি লিগের মহাপলায়নের আগেও হাছান মাহমুদ ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পররাষ্ট্রের মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হাছানের মতো ব্যক্তির হাতে তুলে দিতে হাসিনা দ্বিধা করেননি। ২০১১ সালে পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে হাছান মাহমুদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’-কে আক্রমণ করে বলেছিলেন— ‘কীভাবে তারা জাতীয় কমিটি? কে তাদের রায় দিয়েছে এই জাতীয় কমিটি করতে? কিছু টোকাই নিয়ে গঠিত এ-কমিটি কীভাবে জাতীয় কমিটি হয়?’ হাছান আরো বলেছিলেন— ‘কোথাকার কোন মনু মুহাম্মদ! কোথাকার কোন আনু মুহাম্মদ! তাকে জাতীয় কমিটি গঠন করার ম্যান্ডেট কে দিয়েছে! উনি অর্থনীতির অধ্যাপক, তেল-গ্যাসের কী বোঝেন!’ আনু মুহাম্মদ জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, জাতীয় স্বার্থে আন্দোলন করে রাজপথে মার খেয়েছেন প্রায় সব সরকারের আমলে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় তিনি এখনও সক্রিয়। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবেলা না-করে আওয়ামি লিগের একজন মন্ত্রী একজন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীকে বলেছিলেন টোকাই এবং এ নিয়ে সেই মন্ত্রী নিজেও পরবর্তীকালে কখনও দুঃখ প্রকাশ করেননি, দলও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, ন্যূনতম ভর্ৎসনা করেননি দলের সভাপতিও। বুদ্ধিজীবী হিশেবে আনু মুহাম্মদ সর্বজনস্বীকৃত, রাজনৈতিক চরিত্র হিশেবে হাছান মাহমুদ সর্বজনধিক্কৃত।


বিজ্ঞাপন

এর পরের বছর, ২০১২ সালে, আরেকজন শিক্ষককে অপদস্থ করেছিল আওয়ামি লিগ। দুর্নীতির স্বরূপ বোঝাতে গিয়ে ২০১২ সালের ২ জুন ট্রান্সপারেসি ইন্টারন্যাশনালের এক সভায় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছিলেন— ‘চোর যে চুরি করে, ডাকাত যে ডাকাতি করে; সেটি কি দুর্নীতি? আমার ধারণা, এটি দুর্নীতি নয়। কারণ, দুর্নীতি শব্দের মধ্যে আরেকটি শব্দ লুকিয়ে আছে। শব্দটি হলো নীতি। চোর বা ডাকাতের কাজ ঠিক দুর্নীতি নয়। কারণ, তাদের কোনো নীতিই নেই। সুতরাং, দুর্নীতি সেই মানুষটি করে, যার নীতি আছে। একটা উদাহরণ দিই। যেমন— যদি একজন মন্ত্রী এই বলে শপথ নেন যে, তিনি শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ না-করে সবার প্রতি সমান বিচার করবেন, কিন্তু পরে তিনি সেটি না-করেন, সেটা হবে দুর্নীতি।’ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এই বক্তব্য তৎকালীন কিছু সাংসদ নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে একজন শেখ ফজলুল করিম সেলিম। সেলিম আবু সায়ীদকে নিয়ে সংসদে তীব্র বিষোদ্‌গার করেছিলেন। সেলিম দাবি করেছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মন্ত্রী-সাংসদদেরকে চোর-ডাকাত বলেছেন। এই মর্মে সেলিম বুদ্ধিজীবীদের আয়-ব্যয়ের হিশাব তলব করার কথা বলেছিলেন, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে তলব করে ডেকে এনে সংসদের ডকে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য স্পিকারকে আহ্বান করেছিলেন। তৎকালীন স্পিকার আবদুল হামিদ (পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি) তখন দেশে ছিলেন না। ডেপুটি স্পিকার আলী আশরাফ শেখ সেলিমের আহ্বানে রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু স্পিকার আবদুল হামিদ দেশে ফিরে জাতীয় সংসদে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে পরিস্থিতি সামাল দেন। ক্ষমতায় থাকাকালে সেলিম জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তুচ্ছ কারণে বুদ্ধিজীবীদেরকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছিলেন এবং বুদ্ধিজীবীদের আয়-ব্যয়ের হিশাব তলব করতে চেয়েছিলেন। সেই সংসদ এখন আর নেই। আওয়ামি লিগের পলায়নের দিন সাধারণ মানুষ সংসদের অধিবেশনকক্ষে ঢুকে সাংসদদের আসনে বসে টেবিলে পা তুলে বিড়ি ফুঁকে এসেছে। সেই সেলিমও আজ পলাতক। উল্লেখ্য, শেখ সেলিম শেখ হাসিনার আপন ফুফাতো ভাই, অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব রটিয়ে ধর্মানুভূতির ধুয়া তুলে আওয়ামি লিগ সরকারের আমলেই বেশকিছু শিক্ষককে ছাত্রদের সামনে কান ধরিয়ে ওঠবস করানো হয়েছে, জুতার মালা গলায় পরিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, কোনো-কোনো স্কুলশিক্ষককে নীরবে দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে। ব্যাপারগুলো ঘটেছে জেলাপ্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে এবং প্রায় প্রত্যেকটা ঘটনায় জড়িত ছিল আওয়ামি লিগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা। কেন্দ্রীয় আওয়ামি লিগ এদেরকে দমনের কোনো পদক্ষেপই কখনও নেয়নি। নিজেদের ক্ষমতা সুসংহত করার প্রশ্ন বাদে অন্য যেকোনো প্রশ্নে আওয়ামি লিগ ছিল মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের মতো বোবা ও বধির।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বেরোনোর পথে খুন হন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানলেখক ড. অভিজিৎ রায়। অভিজিতের বই প্রকাশের অপরাধে একই বছরের ৩১ অক্টোবর একই গোষ্ঠী আজিজ মার্কেটে হত্যা করে জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে। বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক (বর্তমানে বাংলা অ্যাকাডেমির সভাপতি) দীপনের মরদেহ দেখে বলেছিলেন যে, তিনি পুত্রহত্যার বিচার চান না। বলেছিলেন — ‘এ-দেশের আদালতে বিচার চেয়ে লাভ কী! মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। শুধু নিয়ম অনুযায়ী আদালতে একটি মামলা করব। আশা করি, উভয় পক্ষেরই শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।’ দেশে যেকোনো কিছু ঘটলে সবাই যেখানে করজোড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মিনতি করত বিচার পাওয়ার জন্য, ফজলুল হক সেখানে বিচারই চাননি— ব্যাপারটায় আওয়ামি লিগের আঁতে ঘা লেগেছিল। এর প্রেক্ষিতে আওয়ামি লিগের বাক্যবাগীশ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছিলেন, ‘একজন ছেলেহারা বাবা তার সন্তানহত্যার বিচার চান না— এই প্রথম বাংলাদেশে এ-রকম একটা ঘটনা দেখলাম। আমার মনে হয়, পৃথিবীতে এ-ধরনের ঘটনা ঘটেনি যে, কোনো বাবা তার ছেলের হত্যার বিচার চান না। আমার মনে হয়, এর কারণ একটাই— ছেলেহারা বাবা অধ্যাপক সাহেব হয়তো ঐ রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। উনি তার দলের লোকজনকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাননি বলেই হয়তো এ-কথা বলেছেন।’ সরকারের কাজ যেখানে হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করা, তা না-করে সেখানে সরকারদলের নেতা সদ্য-সন্তান-হারা একজন হতভম্ব বাবাকে নিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন এমন নির্মম উগ্র উক্তি।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে যে-কজন বুদ্ধিজীবী প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালীদের একজন সুফিয়া কামাল— যাকে বলা হয় ‘জননী সাহসিকা’। সুফিয়া কামালরা না-থাকলে ১৯৭৫-এর পরে আওয়ামি লিগ আর কখনও ক্ষমতায় না-ও যেতে পারত। সুফিয়া কামালের মেয়ে সুলতানা কামাল, যিনি নিজেও বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও আইন অঙ্গনের একজন পুরোধা ব্যক্তি এবং একজন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপস সম্পর্কে ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে সুলতানা কামাল এক রাশ বেদনা নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমারই নির্বাচনী এলাকার মানুষ— আমরা যখন পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে গেলাম— অত্যন্ত স্নেহের পাত্র আমার— মেয়র তাপস— ছোটবেলা থেকে দেখেছি, কারণ, একই পাড়ায় থেকেছে; আমরা সবাই যখন পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে গেলাম, তিনি বললেন যে, যদি বেশি কথা বলে ধোলাইখালে নিয়ে চুবাব! এখন কথা বলতে গেলে যদি চুবানোর ধমক খেতে হয়, আসলে কোন রাজনীতিকের কাছে যাব?’ সুলতানা কামালের মতো একজন ব্যক্তিকে চুবানোর হুমকি দিয়েছেন তাপস, তা-ও আবার পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। যাদের সার্বক্ষণিক সংগ্রামের ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং আওয়ামি লিগ দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ক্ষমতার মুখ দেখেছে, তাদের সাথেই আওয়ামি লিগ-নেতাদের আচরণ হলো এমন; অন্যদের সাথে কেমন, তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। উল্লেখ্য, শেখ তাপস শেখ হাসিনার আপন ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে। শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাভাবিক মৃত্যু হলে ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণির হওয়ার কথা ছিল আওয়ামি লিগের পরবর্তী সভাপতি। মণির ছেলে তাপস। প্রসঙ্গত আরো উল্লেখ্য, ইতিহাস যতটুকু ঘেঁটেছি, লক্ষ করেছি— শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ভাগনেরই বা কোনো ভাগনের কোনো পুত্রেরই আচার-আচরণ পরিশীলিত না, বরং ঔদ্ধত্যে ঠাসা।

প্রথম আলোয় এককালে রাজনৈতিক কার্টুন আঁকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য। বিএনপি-জামায়াত আমলেও তিনি ভয়াবহ সব কার্টুন আঁকতেন। তার একেকটা কার্টুন নিয়ে তখন দেশব্যাপী তোলপাড় হতো। যেদিন-যেদিন তার কার্টুন ছাপা হতো, সেদিন-সেদিন প্রথম আলোর বিক্রি বেড়ে যেত; ঐ-ঐ দিন প্রথম আলো নিজেদের উদ্যোগেই অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি কপি ছাপত। ২০০৮-এ আওয়ামি লিগ সরকার গদিতে বসার পরও কিছুকাল তিনি কার্টুন এঁকেছেন। এর পর তিনি কই যেন হারিয়ে গিয়েছেন, তার কার্টুন আর কোথাও পাইনি। কাঁটাবনের পাঠকসমাবেশে ২০২২ সালে দেখা পেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কার্টুন ইশুতে তিনি কোনো মামলার মুখোমুখি হয়েছেন কি না, কোনো গোয়েন্দাসংস্থা ফোন করে শীতলকণ্ঠে কিছু বলেছে কি না কিংবা সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কায় প্রথম আলোই তাকে বলে দিয়েছে কি না— আর কার্টুন আঁকার দরকার নেই। জবাবে ড. শিশির বলেছিলেন— উল্লিখিত কোনোটাই ঘটেনি। তিনি বরং নিজেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। কোনো মামলা তার বিরুদ্ধে হয়নি; কিন্তু চারদিকে যেভাবে মামলা-মোকদ্দমা হচ্ছে, তাতে তিনি ভয় পেয়েছেন। তিনি বলেছিলেন— ‘মামলা হওয়াটা বড় কথা না। হাজিরা দেওয়ার জন্য আদালতের বারান্দায় দিনের পর দিন ঘুরতে হবে, এটা একটা লজ্জার ব্যাপার। অবশ্য কেউ যদি ফোন করে ভদ্রভাষায়ও কিছু একটা বলে, যদি বলে দেয়— কার্টুন এভাবে না-এঁকে ওভাবে আঁকবেন; এই বয়সে তাও মেনে নিতে পারব না। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ব।’ অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের আমলেও যে-অধ্যাপক হাত খুলে কার্টুন এঁকেছেন, মুক্তবুদ্ধির ধারক-বাহক বলে দাবি করা আওয়ামি লিগের আমলে সেই অধ্যাপকই কার্টুন থেকে স্বেচ্ছা-অবসরে চলে গিয়েছেন। আওয়ামি লিগের আমলে এ-রকম কত বুদ্ধিজীবী নিজেকে খোলসবন্দি করে ফেলেছেন— সোনার কলস পাওয়া আওয়ামি লিগ সেই খবর রাখেনি। উল্লেখ্য, ২০২০ সালে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে প্রথমে তুলে নিয়ে গিয়ে তিনদিন গোপন বন্দিশালায় রাখা হয়, ‘করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়ানো’র অভিযোগ দেখিয়ে গ্রেপ্তার পরে দেখানো হয়, দশ মাস কারাগারে আটকে রেখে করা হয় ব্যাপক নির্যাতন। একই অভিযোগে কিশোরের সাথেই গ্রেপ্তার-হওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ কারাগারেই মারা যান।

শাহ্‌ জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল মাত্র অর্ধদশক আগেও ছিলেন জাতির বিবেকের মতো। তিনি সপ্তাহে একটা করে কলাম লিখতেন। সপ্তাহের বাকি ছয়দিন জাতি যৌথভাবে অপেক্ষা করত তার কলামের জন্য। দেশে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটলে কে কোন অবস্থান নেবেন, তা-ও নির্ধারিত হতো তার কলামের মাধ্যমে। বলাই বাহুল্য— তার অনুসারীরা তার নেওয়া পক্ষ অবলম্বন করতেন। আর বিরোধীরা অবলম্বন করতেন তার নেওয়া পক্ষের ঠিক উলটো পক্ষ। একটা ইশুতে বিরোধীপক্ষ কোন পক্ষ অবলম্বন করবে, তা-ও পরোক্ষভাবে নির্ধারিত হতো জাফর ইকবালের কলামের মাধ্যমে। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতেন বলে একটা গোষ্ঠী তাকে ইসলামবিরোধী হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে এবং প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে সক্ষমও হয়েছে। সেই ১৯৭১ থেকে আজ— মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির পিঠ যখনই দেয়ালে ঠেকেছে, তখনই তারা জোব্বার পকেট থেকে ধর্মকার্ড বের করেছে; জাফর ইকবালের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন মুরতাদ, আশির দশকে আহমেদ শরিফরা মুরতাদ, নব্বইয়ের দশকে জাহানারা ইমামরা মুরতাদ, শূন্য দশকে জাফর ইকবালরা মুরতাদ, দশের দশকে শাহবাগিরা মুরতাদ। মুহুর্মুহু মুরতাদ-মুরতাদ প্রচারণায় উৎসাহিত হয়ে জাফর ইকবালকে হত্যার জন্য এক উগ্রবাদী তরুণ ২০১৮ সালের ৩ মার্চ প্রকাশ্যে হামলাও চালিয়েছিল।

২০২২-এর জানুয়ারিতে শাহ্‌ জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন উপাচার্যবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন হলো, উপাচার্যপতনের দাবিতে ছাত্ররা যখন আমরণ অনশনে গিয়েছিল, ছাত্ররা যখন কারো প্রতিশ্রুতিতেই আন্দোলন স্থগিত করছিল না; আওয়ামি লিগ সরকার তখন দুরভিসন্ধিমূলকভাবে ড. জাফরকে পাঠাল ছাত্রদের অনশন ভাঙাতে। আওয়ামি লিগ সরকার ভালো করেই জানত— শাহ্‌ জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাংলাদেশের কেবল একজন ব্যক্তির কথাই ফেলতে পারবে না, তিনি মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ড. জাফর ছাত্রদের অনশন ভাঙালেন। বললেন তাকে সরকারই পাঠিয়েছে, প্রতিশ্রুতি দিলেন অনতিবিলম্বে সরকার ছাত্রদের দাবি পূরণ করবে৷ ছাত্ররা ড. জাফরকে বিশ্বাস করল। কিন্তু সরকার ড. জাফরের মান রাখল না। যে-উপাচার্য পুলিশকে দিয়ে ছাত্রদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করিয়েছিলেন, সেই উপাচার্যই স্বপদে বহাল থাকলেন। ড. জাফরের বিশ্বাসযোগ্যতা মাটির সাথে মিশে গেল। ঐ ঘটনার পর থেকে তার কলামও গুরুত্ব হারিয়েছে। তিনি সর্বশেষ কলাম লিখেছিলেন ২০২৪-এর জুলাই মাসে। ২০২২ থেকে ২০২৪— এই সময়ে ড. জাফর যে-ক’টা কলাম লিখেছেন, এর একটাও আগের মতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারেনি। তিনি ভবিষ্যতে কলাম লিখলে তা-ও আর কখনও গুরুত্ব পাবে না; তিনি শেষ হয়ে গেছেন, আওয়ামি লিগ তাকে শেষ করে দিয়েছে। ড. জাফরকে প্রাণে মেরে ফেলতে চেয়েছিল মৌলবাদীচক্র, পারেনি। কিন্তু সেরেফ একজন দুর্নীতিবাজ উপাচার্যকে বাঁচাতে গিয়ে আওয়ামি লিগ সরকার ড. জাফরকে ব্যবহার করে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মেরে ফেলেছে, তার বিশ্বাসযোগ্যতার শিরশ্ছেদ করেছে, তাকে পরিণত করেছে হাসাহাসির খুলখাল্লাম খোরাকে। আওয়ামি লিগের কাছে একজন দুর্নীতিবাজ উপাচার্যের মূল্য ছিল মুহম্মদ জাফর ইকবালের চেয়েও বেশি। একটা ব্যাপার লক্ষণীয়— এই লেখায় সেই উপাচার্যের নাম উল্লেখ করিনি, করার প্রয়োজন বোধ করিনি। তার নাম উল্লেখ করলেও যা, না-করলেও তা। হতে পারে তার নাম কবিরউদ্দিন, খবিরউদ্দিন, দবিরউদ্দিন, মফিজউদ্দিন কিংবা ফরিদউদ্দিন। এমন একজন অনুল্লেখযোগ্য অথর্বকে স্বপদে টিকিয়ে রাখতে মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে পানির দামে বিকিয়ে দিতেও আওয়ামি লিগ দ্বিধা বোধ করেনি।

২০১৯ সালে শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে ছাত্রলিগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা একটা স্মরণিকা প্রকাশ করেছিল। তাতে ছাপা হয়েছিল দেশের ‘প্রভাবশালী’ তরুণদের লেখা। ছাত্রলিগ আমার সাথেও যোগাযোগ করেছিল সেই স্মরণিকায় লেখা দেওয়ার জন্য। ব্যাপারটা আমার জন্য অস্বস্তিকর ছিল। কারণ, শেখ হাসিনা নিজের প্রশংসা ছাড়া অন্যকিছু পড়তে অভ্যস্ত না আর আমার পক্ষে কাউকে একচ্ছত্রভাবে প্রশংসা করা সম্ভব না, প্রশংসা করলেও আমার লেখায় কিছু সমালোচনা থাকবেই। অস্বস্তি নিয়েও লেখাটা লিখেছিলাম এবং ছাত্রলিগ সেই লেখা ঐ স্মরণিকায়, অবধারিতভাবেই, রাখেনি; কেননা, লেখাটা তেল-চুপচুপে ছিল না, ছিল উপদেশে ঠাসা। ২০২৩ সালেও ছাত্রলিগ শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে স্মরণিকা প্রকাশ করেছিল এবং ছাত্রলিগের একজন কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি লেখা চেয়ে একাধিকবার যোগাযোগও করেছে। যেহেতু তারা ২০১৯-এর লেখাটা ছাপেনি; তাই ২০২৩-এ ছাত্রলিগকে লেখা দিইনি। যা হোক, ২০১৯ সালে শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে ডাকসু-প্রকাশিত স্মরণিকায় ছাত্রলিগ আমার যে-লেখাটা ছাপেনি, সেটার অংশবিশেষ ছিল এই—

‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারদিক থেকে চাটুকারবেষ্টিত। তিনি নিজেই বলেছেন তাকে ছাড়া দলের বাকি সবাইকে কেনা যায়। যারপরনাই ত্যক্তবিরক্ত ও নিতান্ত বাধ্য না-হলে এ-কথা তিনি উচ্চারণ করতেন না। এক শ্রেণির চাটুকার প্রায়ই অধুনালুপ্ত তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের সাতান্ন ধারায় (বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) এর-ওর বিরুদ্ধে মামলা করত ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার কথিত অভিযোগে। ঘেঁটে দেখা যেত— গোটা বক্তব্যে আদৌ কোনো কটূক্তিই নেই, নেই আমলযোগ্য তেমন কিছু। সেরেফ প্রধানমন্ত্রীর নেক-নজরে যাওয়ার জন্য তোষামুদের দল ঐ কাজটা করত। প্রধানমন্ত্রী হয়তো নিজেও জানেন না— তাকে নিয়ে কটূক্তির কথিত অভিযোগে কোথায় কতগুলো মামলা হয়েছে। এ-জাতীয় মামলা প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে। প্রধানমন্ত্রী এই উদ্বাহু উটকো মামলাবাজদেরকে নিবৃত্ত করলে তা তার নিজের ভাবমূর্তিকেই উজ্জ্বলতর করবে।

গত অর্ধযুগে দেশে বেশকিছু ছাত্র-আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। মোটামুটি প্রত্যেকটি আন্দোলনেরই দাবি সরকার শেষতক মেনে নিয়েছে। কিন্তু প্রত্যেকবারই দেখা গেছে ক্ষমতাসীন দল ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢালাওভাবে আন্দোলনকারীদের প্রতিপক্ষ হিশেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। একটা ব্যাপার লক্ষ করার মতো— সরকার ছাত্র-আন্দোলনগুলোর শুরুর দিকে সাধারণ ছাত্রদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে না, শক্তি প্রয়োগ করে আন্দোলন স্তিমিত করার চেষ্টা করছে এবং শেষ অবধি ঐ ছাত্রদের দাবিই মেনে নিচ্ছে। আর সরকারের এই অসহিষ্ণু আচরণের সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধীচক্র। সাধারণ ছাত্রদের কাঁচা আবেগকে পুঁজি করে ঐ চক্রটি এই সরকারের আমলে একাধিকবার ফায়দা লুটেছে, ছাত্রদের আন্দোলনের ফসল নিজেদের ঘরে তুলেছে। ছাত্র-আন্দোলনগুলোকে সরকার আরো সতর্কতা ও কৌশলের সাথে মোকাবেলা করলে ফসল স্বাধীনতাবিরোধীরা আর ঘরে তুলতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রত্যাশা— ছাত্র-আন্দোলন মোকাবেলায় তার সরকার ও তিনি আরো কৌশলী ও নমনীয় হবেন।’ ২০২৪ সালে যে ছাত্র-আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামি লিগের মহাপতন হলো, অন্তত পাঁচ বছর আগেই সে-ব্যাপারে শেখ হাসিনাকে সতর্ক করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই সতর্কতাবার্তা শেখ হাসিনার চাটুকারবাহিনী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছতে দেয়নি। সেই স্মরণিকায় ছাত্রলিগ যাদের লেখা ছেপেছিল; তারা এখন কোথায়, এই দুঃসময়ে আওয়ামি লিগের পক্ষে তারা এখন কী লিখছে, কী করছে— কেউ জানে না। তাদের প্রত্যেকেই এখন ‘লাপাত্তা লেডিস’।

বিগত দশকের প্রথম ভাগজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দাপিয়ে বেড়িয়েছিল সরকারপন্থি একটা গালিবাজ গোষ্ঠী— সিপি গ্যাং। কেউ যদি সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করেও কোথাও কিছু লিখত; সংঘবদ্ধ চক্রটা তৎক্ষণাৎ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, গয়রহ গালিগালাজে চারদিক কাঁপিয়ে দিত, লেখকের ওপর চাপিয়ে দিত কুৎসিত কলঙ্কের বোঝা। সরকারের ভেতরকার একটা অংশ ঐ গোষ্ঠীটাকে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দিত। অন্তর্কলহে গোষ্ঠীটা একপর্যায়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু স্বাধীনচেতা লেখকদের মনোজগতে রেখে গেছে একটা স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন। তাদের সংঘবদ্ধ গালাগাল আর চরিত্রহননের কবলে পড়ে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল লেখকই লেখার জগৎকে বিদায় দিয়েছেন। আওয়ামি লিগ সরকার জানতও না টাকাকড়ি খরচ করে কত বড় একটা বিষফোঁড়ার চাষ তারা এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করেছিল। সেই চরিত্রসংহারী চাষাবাদের কুফল আওয়ামি লিগকে এখন ভোগ করতে হচ্ছে। ক্ষমতায় থাকাকালে যে-সিপি গ্যাংকে আওয়ামি লিগ দুধকলা দিয়ে পুষেছিল, সেই গ্যাং এখন নিরুদ্দেশ। আওয়ামি লিগের সমস্ত গ্যাং এখন শ্মশানের মতো নীরব।

২০১৩ থেকে ২০১৫— এই তিন বছর বাংলাদেশের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক বিভীষিকার যুগ। এই সময়ে এক থেকে দেড় ডজন লেখক-প্রকাশক খুন হয়েছেন বাংলাদেশে। মুক্তিযুদ্ধকাল ছাড়া বাংলাদেশে আর কখনও এত বেশি পরিমাণ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়নি। এই ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড কেবল ১৪ ডিসেম্বরের পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবীহত্যার সাথেই তুল্য। তিন বছরের এই জাহেলিয়াতকালে মৌলবাদীদের প্রেসক্রিপশনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বেশকিছু প্রকাশককে, এমনকি ছাপাখানা-মালিককে; বইমেলা থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে অনেক প্রকাশনীর স্টল। উল্লিখিত তিন বছরে বুদ্ধিজীবীদের ওপর হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে উগ্রবাদী গোষ্ঠী আর হত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত না-করে এই হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহিত করেছে আওয়ামি লিগ সরকার। বিনা ভোটে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আওয়ামি লিগ মৌলবাদীদের সাথে উপর্যুপরি আপস করেছিল, সুপ্রিম কোর্টের সম্মুখ থেকে ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার প্রাক্‌কালে শেখ হাসিনা বলেছিলেন— বিবদমান দুই গ্রুপ এই ইশুতে সংঘর্ষে জড়ালে সেই সংঘর্ষ না-থামিয়ে তিনি বরং সবার চিকিৎসাখরচ দেবেন। মৌলবাদীদের হাতে তরুণ বুদ্ধিজীবীদেরকে বেঘোরে নিহত হতে দেখে অগ্রজ বুদ্ধিজীবীরা ভয় পেয়েছেন, আরো বেশি ভয় পেয়েছেন যখন সরকার হত্যাকারীদের ভাষায়ই কথা বলতে শুরু করেছে। এর পর থেকে কোনো পক্ষের লেখকরাই আর মন খুলে লিখতে পারেননি, লিখতে গেলেই গা ছমছম করেছে, ভর করেছে মৃত্যুচিন্তা। মৃত্যুপরোয়ানা নিয়ে, আর যা-ই হোক, লেখা যায় না। লেখকচিত্তে মৃত্যুশঙ্কা ঢুকিয়ে দিতে আওয়ামি লিগ সরকার উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে সহায়তা করেছে। আওয়ামি শেষ পর্যন্ত না-পেরেছে প্রতিক্রিয়াশীলদের মন, না-পেয়েছে প্রগতিশীলদের সমর্থন। দুই নৌকায় পা দিতে গিয়ে আওয়ামি লিগের নিজস্ব নৌকা শোচনীয়ভাবে ডুবে গেছে।

আওয়ামি লিগের বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াপনা শেষ পর্যন্ত এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, ২০২২ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন বিদেশী পত্রপত্রিকায় আওয়ামি লিগ সরকারের পক্ষে লেখালিখির জন্য সরকার উপযুক্ত কলামলেখক নিয়োগ করবে এবং লেখা বাবদ পারিশ্রমিক দেবে। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ডাকে কোনো লেখকই সাড়া দেননি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সরকারের পক্ষে আওয়ামি লিগ শেষতক এমনসব লেখকের কলাম ছাপিয়েছে, বাস্তবে যাদের কোনো অস্তিত্বই নেই। যাদের অস্তিত্ব ছিল, তাদের আবার নামের সাথে উল্লিখিত ডিগ্রি ভুয়া; লেখক হিশেবে নাম একজনের, ছবি ভারতের কোনো অখ্যাত মডেলের। এমনকি একই লেখার ইংরেজি সংস্করণ ছাপা হয়েছে একজনের নামে, বাংলা সংস্করণ ছাপা হয়েছে আরেকজনের নামে। আওয়ামি লিগ সরকারের পক্ষে বেশিরভাগ ভুয়া কলাম যে-দু’জনের নামে ছাপা হয়েছে; তাদের একজনের নাম ‘ডরিন চৌধুরী’, আরেকজন ‘নন্দিতা রায়’। বলাই বাহুল্য— এরা ভৌতিক কলামিস্ট, বাস্তবে এদের অস্তিত্ব নেই। বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্ব কোন পর্যায়ে পৌঁছলে একটা দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সরকারকে নিজেদের পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য এমন বেধড়ক বাটপারির আশ্রয় নিতে হয়— তা সহজেই অনুমেয়। দেড় দশকে আওয়ামি লিগ সরকারের পরাক্রমশালী পোদ্দারদের নজর ছিল কেবল লেলিহান লুটপাট আর চতুর্মাত্রিক চোটপাটে, বুদ্ধিবৃত্তিক অন্ধকার দূরীকরণে আওয়ামি লিগের কোনো বিকারই ছিল না। সেই নারকীয় নির্বিকারত্বের কুফল আওয়ামি লিগকে আষ্টেপৃষ্টে আটকে ধরেছে। ইতিহাস আওয়ামি লিগের মেধাহত্যার বিচার করছে। আওয়ামি লিগ এখন শতভাগ মেধাশূন্য। ভারত একদিন আবার ক্ষমতায় নিয়ে দেবে— এই অপেক্ষায় বসে থাকা ছাড়া আওয়ামি লিগের এখন আর কিছুই করার নেই।

নব্বইয়ের দশকে শেখ হাসিনাকে দেখা গেছে ঐতিহাসিক গণআদালতে জাহানারা ইমাম, সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান, কলিম শরাফীদের সাথে। এঁদের সঙ্গ, সহযোগিতা আর পরামর্শই ১৯৯৬-এর নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতার তখতে তাউসে পৌঁছে দিয়েছিল। অন্যদিকে, ত্রিশ-বত্রিশ বছর বাদে, ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের আগে ‘লেটস টক’ নাম দিয়ে হাসিনা বৈঠক করেছিলেন ন্যূনতম রাজনৈতিক জ্ঞান-না-থাকা কিছু কনটেন্ট ক্রিয়েটরের সাথে, যারা ভিডিও বানায় মূলত খাবারদাবার নিয়ে। যে তরুণ লেখকরা রাজনীতি নিয়ে লেখে ও ভাবে, তাদের বক্তব্য শোনার মতো কোনো প্রয়োজন হাসিনা কখনোই বোধ করেননি এবং এরও প্রতিফল হাসিনা পেয়েছেন। ২০২৪-এর জানুয়ারিতে লেটস টক অনুষ্ঠানে হাসিনা যে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের সাথে বৈঠক করেছিলেন; সাত মাস পরে জুলাই-আগস্টে তাদের প্রত্যেকে তার পতনের পক্ষে কাজ করেছে, কেউ-কেউ অংশ নিয়েছে তার পলায়নপরবর্তী গণভবন-লুটপাটেও। মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আওয়ামি লিগকে বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক রাজনৈতিক পলায়ন উপহার দিয়েছে।

দেশের বুদ্ধিজীবীদের একাংশকে আওয়ামি লিগ সরকার কিনে নিয়েছিল— কাউকে পদক বা প্লট দিয়ে, কাউকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে জাতিসংঘ-সফরে নিয়ে, কাউকে গণভবনে ডেকে নিয়ে পাটিসাপটা পিঠা খাইয়ে। যাদেরকে কিনতে পারেনি, যারা বিক্রয়-অযোগ্য, যারা প্রথাবিরোধী; আওয়ামি লিগ— যেভাবে পেরেছে— তাদেরকে হেনস্তা বা শায়েস্তা করেছে। দুর্নীতিবাজ উপাচার্যের গদি রক্ষা করতে গিয়ে আওয়ামি লিগ মুহাম্মদ জাফর ইকবালের মতো মহার্ঘ্য মনীষীকে ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, আনু মুহাম্মদকে টোকাই বলেছে, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে সংসদের ডকে তুলতে চেয়েছে। কোনো বুদ্ধিজীবীর কোনো বক্তব্যে আওয়ামি লিগ সরকার কখনও কর্ণপাত করেনি, প্রমাণ দিয়েছে নজিরবিহীন ঔদ্ধত্যের, অনলাইন লাঠিয়ালবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে করেছে বুদ্ধিজীবীদের চরিত্রহনন। আওয়ামি লিগ নির্বাচনের আগে পায়নি তাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কলাম লেখার মতো কোনো কলামিস্টকে, জুলাই-আগস্টে তাদের পক্ষে কথা বলার মতো কোনো গ্রহণযোগ্য বুদ্ধিজীবীকে, পাচ্ছে না এখনও কোনো কবিসাহিত্যিক বা সংস্কৃতিকর্মীকে। আওয়ামি লিগের এখন কোথাও কেউ নেই। বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের সাথে আওয়ামি লিগ নিজের অজান্তেই তৈরি করে ফেলেছে অলঙ্ঘনীয় দূরত্ব, বুদ্ধিজীবীদের সাথে আওয়ামি লিগ করে ফেলেছে অমোচনীয় পাপ। অথচ প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদেরকে পক্ষে রাখতে পারলে আওয়ামি লিগকে এমন দুর্দিন দেখতে হতো না, ৫ আগস্ট পালাতে হতো না এমন লজ্জাজনক উপায়ে। পলায়নপরবর্তী আট মাসেও আওয়ামি লিগের অর্জন শূন্য— রাজনৈতিক অর্জনও, বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জনও। শেখ হাসিনা এখনও দিল্লিতে বসে ছড়াপাঠ করে প্রচার করছেন, কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালে ছড়াকারদের সমালোচনা পড়ার মতো বা তাতে কর্ণপাত করার মতো প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি। এখন তিনি তাকিয়ে আছেন ছড়াকারদের মুখের দিকে, কলামিস্টদের চোখের দিকে, গীতিকারদের নাকের দিকে।

ক্ষমতায় থাকাকালে রাজনৈতিক দলগুলোর ছড়াকার লাগে না, কবি লাগে না, কলামিস্ট লাগে না; লাগে কেবল চাটুকার। ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার পর পরাক্রমশালী প্রধানমন্ত্রীকেও তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হয়— এই বুঝি কোনো লেখক এমন একটা লেখা লিখবেন— যে-লেখাটা তার পক্ষে যাবে, যে-লেখাটা স্বকণ্ঠে পাঠ করে ছড়িয়ে দিয়ে দলের নেতাকর্মীদের কাছে নিজের অস্তিত্বের জানান দেওয়া যায়, যে-লেখাটা তার মসনদ ফিরে পেতে অন্তত সামান্যতম জনমত তৈরি করবে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *