ইনসেটে সাংবাদিক রোকনুজ্জামান টিপু ও ইউএনও শেখ মো. রাসেল।

নিজস্ব প্রতিবেদক : সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় কালের কণ্ঠের সাংবাদিক রোকনুজ্জামান টিপুর কারাদণ্ডের প্রতিবাদে সাংবাদিক সংগঠনগুলো ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে। টিপুকে নিঃশর্ত মুক্তি এবং তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ মো. রাসেলের অপসারণ দাবি করে ঢাকা, সাতক্ষীরা ও তালায় মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে। সাংবাদিকরা অভিযোগ করেছেন, দুর্নীতির খবর প্রকাশের প্রতিশোধ নিতেই টিপুকে আদালতের নামে একতরফা শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আজ সাতক্ষীরায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাওয়ের ডাক দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, দেশের বিভিন্ন স্থানে টিপুর মুক্তির দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে।

টিপুর মুক্তির দাবিতে আলটিমেটাম : কালের কণ্ঠের তালা প্রতিনিধি রোকনুজ্জামান টিপুর মুক্তির দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন সাংবাদিকরা। এ ছাড়া তাঁরা সাংবাদিক টিপুকে শাস্তিদানকারী ইউএনও শেখ মো. রাসেলের অপসারণ দাবি করেছেন। গতকাল ঢাকা, সাতক্ষীরা, তালাসহ বিভিন্ন স্থানে এই দাবি জানানো হয়।
দাবি আদায় না হলে আজ সাতক্ষীরায় সাংবাদিকরা জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন।
গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে তথ্য কমিশন কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেয় বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম। তালা উপজেলা মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম আয়োজন করে মানববন্ধনের। সাতক্ষীরায়ও মানববন্ধন করেন সাংবাদিকরা।
তথ্য কমিশনে স্মারকলিপি : গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে তথ্য কমিশন কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেয় বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম। ওই সময় কালের কণ্ঠের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন মফস্বল সম্পাদক রিদওয়ান আক্রাম। এ সময় সংগঠনের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আহমেদ আবু জাফর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাংবাদিক টিপুকে নিঃশর্ত কারামুক্তি দেওয়া না হলে দেশব্যাপী কঠোর কর্মসূচিরও ঘোষণা দেন। আজ বৃহস্পতিবার সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা সাতক্ষীরায় সাংবাদিকদের প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেবেন। তথ্য কমিশনের পরিচালক এ কে এম আজিজুল স্মারকলিপি গ্রহণ করে নিয়ম অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
ওই সময় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য রফিকুল ইসলাম মিরপুরী, কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি আব্দুল হাকিম রানা, সহসম্পাদক নুরুল হুদা বাবু, সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুদ রানা, আনিসুর রহমান লিমন, মারিয়া আক্তার, সুমন খান প্রমুখ। বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তালার এ ঘটনায় সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধের মাধ্যমে প্রশাসনের এক শ্রেণির দালাল কারাদণ্ড দিয়ে দুর্নীতি-অনিয়মকে উসকে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের পক্ষ থেকে সাজানো নাটকের বিরুদ্ধে প্রশ্ন রাখা হয়েছে প্রশাসনের উচিত ছিল ঘটনার নিরপেক্ষতা বজায় রেখে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু তা করা হয়নি।
তালায় মানববন্ধন : কালের কণ্ঠের তালা প্রতিনিধি রোকনুজ্জামান টিপুর কারাদণ্ডের প্রতিবাদে গতকাল বুধবার দুপুরে তালা উপজেলা মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের আয়োজনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
তাতে সভাপতিত্ব করেন তালা উপজেলা মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি এম এ ফয়সাল। সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান রেন্টুর পরিচালনায় তাতে বক্তব্য দেন তালা প্রেস ক্লাবের সদস্য সেলিম হায়দার, দপ্তর সম্পাদক শফিকুল ইসলাম, সদস্য কে এম শাহিনুর রহমান, আজিজুল ইসলাম প্রমুখ। উপজেলায় যত উন্নয়নমূলক কাজ হয় তার সব হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অধীনে। এসব কাজে কারো কোনো হস্তক্ষেপ চলবে না। কিছুদিন আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে তালা অপরিকল্পিত ড্রেন নির্মাণকে কেন্দ্র করে ইউএনওর বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় হিংসার বলি হয়েছেন টিপু। বক্তারা বলেন, ইউএনও একজন আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। তাঁর আপন ভাবি ছিলেন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যন। দুর্নীতিবাজ ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলা দিয়ে উপজেলার কি উন্নয়ন হবে?
সাতক্ষীরায় মানববন্ধন : গতকাল সকাল ১১টায় সাতক্ষীরা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক কল্যাণ ব্যানার্জি। মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে বুধবারের মধ্যে সাংবাদিক রোকনুজ্জামান টিপুকে নিঃশর্ত মুক্তি না দিলে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় সাতক্ষীরা ডিসি অফিসের সামনে অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। মানববন্ধন কর্মসূচি চলাকালে বক্তব্য দেন চ্যানেল আইয়ের সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ, সময় টিভির মমতাজ আহমেদ বাপি, আরটিভির রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী, দেশ টিভি ও বিডি নিউজের শরিফুল্লাহ কায়সার সুমন, বিএসএসের আসাদুজ্জামান, ইনডিপেনডেন্ট টিভি ও বাংলাদেশ বেতারের সাংবাদিক আবুল কাশেম, এখন টিভির আহসানুর রহমান রাজীব, দীপ্ত টিভির রঘুনাথ খাঁ, ডিবিসির এম বেলাল হোসাইন, মানবজমিনের এস এম বিপ্লব হোসেন, মানবাধিকারকর্মী মাধব চন্দ্র দত্ত প্রমুখ। বক্তারা বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে ছিলেন না বা তাঁর সামনে কোনো ঘটনা ঘটেনি। এর পরও তিনি আইন ভঙ্গ করে সাংবাদিক টিপুকে সাজা দিয়েছেন। বক্তারা টিপুর নিঃশর্ত মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার, ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপসহকারী প্রকৌশলী এম এম মামুন আলমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
গাজীপুরের চার প্রেস ক্লাবের বিবৃতি : টিপুর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে গাজীপুরের চারটি প্রেস ক্লাব। এর মধ্যে আছে গাজীপুর জেলা প্রেস ক্লাব, গাজীপুর সদর প্রেস ক্লাব, কালীগঞ্জ প্রেস ক্লাব ও শ্রীপুর প্রেস ক্লাব। গতকাল বিকেলে এসব সংগঠন যৌথভাবে এ বিষয়ে বিবৃতি দেয়। গাজীপুর জেলা প্রেস ক্লাবে সভাপতি রিপন আনসারী, সাধারণত সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ভুঁইয়া, গাজীপুর সদর প্রেস ক্লাবের সভাপতি আবু বকর সিদ্দিক, কালীগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি অধ্যাপক মোখলেসুর রহমান ও শ্রীপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি এম এম ফারুক যৌথভাবে এই বিবৃতি দেন।
বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিককে কারাদণ্ড দেওয়া সংবিধান, আইনের শাসন ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী। গত ফ্যাসিস্ট সরকারের মতো আচরণ করায় সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ দণ্ডিত সাংবাদিকের দণ্ড বাতিল করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। অন্যথায় গাজীপুর থেকে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
আক্রোশ থেকে কালের কণ্ঠ সাংবাদিককে সাজা দেন ইউএনও : সাতক্ষীরার তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মো. রাসেলের দুর্নীতি-অনিয়ম এখন প্রকাশ্যেই লোকজনের মুখে শোনা যাচ্ছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণে দুর্নীতি ঢাকতে এবং সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের রক্ষা করতেই তিনি অতি উত্সাহী হয়ে গত মঙ্গলবার কালের কণ্ঠের তালা প্রতিনিধি রোকনুজ্জামান টিপুকে ১০ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন। এ ছাড়া সাংবাদিকদের প্রতিবাদের দরুন তাঁর আমলে করা একটি নালার অবস্থান সরানোর চাপে পড়েন ইউএনও। সাংবাদিকদের প্রতি আগের সেই ঝাল তিনি মিটিয়েছেন টিপুকে জেলদণ্ড দিয়ে।
গতকাল সাতক্ষীরা ও তালায় সাংবাদিকরা দফায় দফায় কর্মসূচির মাধ্যমে সাংবাদিক টিপুকে শাস্তি দেওয়ার প্রতিবাদ জানান। তাঁরা বলেছেন, এই রায় বিদ্বেষপ্রসূত। তাঁরা তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অপসারণের আলটিমেটাম দিয়েছেন। না হলে আজ বৃহস্পতিবার তাঁরা সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন। গতকাল সকালে সাতক্ষীরা প্রেস ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক কল্যাণ ব্যানার্জি।
তালা উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন তৈরির কাজ চলছে। এই কাজে নির্মাণসামগ্রী যথাযথভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না—এমন সংবাদ পেয়ে তা দেখতে গত মঙ্গলবার নির্মীয়মাণ ভবন এলাকায় যান সাংবাদিক টিপু। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাংলোর সামনে নির্মাণকাজ সরেজমিনে দেখার এক পর্যায়ে টিপু উপজেলা প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী এম এম মামুন আলমের কাছে পানি, পাথর ও সিমেন্টের অনুপাত কেমন দেওয়া হচ্ছে তার তথ্য জানতে চান।
কিন্তু মামুন তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান। সেখানে মামুন ও অন্য নির্মাণ শ্রমিকরাই উপস্থিত ছিলেন। এক পর্যায়ে টিপুর সঙ্গে মামুনের তর্ক হাতাহাতিতে গড়ায়। মামুন ও তাঁর অনুগত শ্রমিকরা সাংবাদিক টিপুর ওপর হামলে পড়েন। তাঁরা টিপুকে সামনে থাকা ছাতা দিয়ে শরীরে আঘাত করতে থাকেন।
এ ছাড়া মামুন উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলী রাসেলকে উত্তেজিত হয়ে বিষয়টি মোবাইল ফোনে অবহিত করেন। রাসেল সরেজমিনে উপস্থিত শ্রমিকসহ স্থানীয়দের সাক্ষ্য নিয়ে টিপুর বিরুদ্ধে রায় দেন। উপসহকারী প্রকৌশলী এম এম মামুন আলম গতকাল কালের কণ্ঠের কাছে দাবি করেন, টিপুই আগে মামুনের মুখে ঘুষি মারেন।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পের কাজে মানসম্মত ও যথাযথ নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছিল না। এ কারণে তথ্য না দিয়ে বরং সাংবাদিককে তা থেকে বিরত রাখার জন্যই কৌশল নেন মামুন। জানা গেছে, এই প্রকল্পের কাজ আগে পর পর দুবার বাতিল করা হয়েছিল। তৃতীয়বারের মতো কাজ শুরু হলে ভবনের পাইলিংয়ের ক্ষেত্রে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়। তার ওপর ভবন তোলা হলে ভবন ভেঙেও পড়তে পারে। তাই তা ঠেকানোর জন্য তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন তৈরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সাংবাদিক টিপু।
বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম তালা উপজেলা শাখার সভাপতি এম এ ফয়সাল বলেছেন, ‘দুর্নীতির তথ্য ঢাকতেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় বাধা দেওয়া হয়েছে। আর তালায় বিভিন্ন সরকারি কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে সহযোগিতা করছেন ইউএনও। এ কারণে আমরা তাঁর অপসারণ চেয়েছি।’ তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার-ইউএনও শেখ মো. রাসেল অবশ্য বলছেন, একজন সাংবাদিকের মাধ্যমে আমার একজন কর্মকর্তাকে মারধর করা হয়েছে এমন খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে উপস্থিত শ্রমিকদের সাক্ষ্য শেষে ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় টিপুকে ১৭৬ ধারায় ১০ দিনের সাজা ও ২০০ টাকা জরিমানা করা হয়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আহমেদ আবু জাফর বলেন, ‘এখানে সাংবাদিককে সাজা দেওয়া হয়েছে একতরফাভাবে। এখানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অপরাধ সংঘটন হয়নি।’
তালার ইউএনও ছাত্রলীগের কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি
নিয়মবহির্ভূতভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কালের কণ্ঠের তালা প্রতিনিধিকে ১০ দিনের সাজা দেওয়ার পর দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে সাতক্ষীরার তালার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ রাসেলকে নিয়ে। জানা গেছে, রাসেল নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সক্রিয় কর্মী ছিলেন।রাসেল আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩৫তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি পান; যদিও তিনি ৩১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করেছিলেন। প্রশাসন ক্যাডারে যোগদানের পর এমন কোনো আওয়ামী সুবিধা নেই, যা তিনি পাননি।
স্বল্প চাকরিজীবনে তিনি বিদেশে পোস্টিংও বাগিয়ে নিয়েছিলেন, যা হাতে গোনা দু-চারজন কর্মকর্তাই পান। দলীয় পরিচয় ছাড়া এসব পোস্টিং পাওয়া অনেকটাই অসম্ভব। শুধু তা-ই নয়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি ভোল পাল্টে ঠিকই বাগিয়ে নিয়েছেন ইউএনও পদটিও। সূত্র জানায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির ৩৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শেখ মো. রাসেল।
ছাত্রজীবনের শুরুতে তাঁর কোনো দলীয় পরিচয় না থাকলেও ধীরে ধীরে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর আগে ও পরের ব্যাচের শিক্ষার্থীরা সবাই তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন সে সময়ের জাহাঙ্গীরগনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁদের দহরম-মহরম ছিল চোখে পড়ার মতো। তাঁরা দুজনই এখন সরকারের উচ্চ পদে বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন।
অনেকে দাবি করেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তিনি সাংবাদিককে সাজা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে উপজেলা পরিষদের অডিটরিয়ামে স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিককে হেনস্তা করেন। এ নিয়ে সে সময় তাঁর বিরুদ্ধে খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা।
এদিকে ইউএনও রাসেল নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সক্রিয় কর্মী ছিলেন বলে জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন শেখ রাসেল। থাকতেন কামাল উদ্দিন হলে। ২০১০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। তাতে সাফিনকে সভাপতি ও সাম্যকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয়েছিল। সক্রিয় কর্মী ছিলেন শেখ রাসেল।
সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলম সাম্যর কাছের বন্ধু হওয়ার সুবাদে রাসেল কামাল উদ্দিন হলের সাধারণ সম্পাদক হতে চেয়েছিলেন। তবে হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় কমিটি। আত্মগোপনে থাকা ওই কমিটির এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ছাত্রলীগের রাজনীতি করত রাসেল। তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি ১১ সদস্যের ছিল। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দিতে চেয়েছিল সাধারণ সম্পাদক সাম্য।’
জানা গেছে, উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় ছাড়াও ভূমি অফিসে ইউএনওর আছে একচ্ছত্র আধিপত্য। এখানে ঘুষের রেট নির্ধারণ করে রেখেছেন তিনি। নামজারি, নাম সংশোধনসহ ভূমিসংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা সমাধানে গরিবের পকেট কাটা হয় এখানে। এই পকেট কেটে নেওয়া অর্থের বড় অংশ রোট অনুযায়ী ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার মিরাজ হোসেন, বড়বাবু আব্দুল হাই ও নাজির তপন কুমারের হাত ঘুরে চলে যায় ইউএনওর পকেটে। জমির নামজারি করতে হলে প্রথমে অনলাইনে আবেদন করতে হয়।
এরপর শুরু হয় ঘুষ বাণিজ্য। আবেদনের পর ইউনিয়ন সহকারী ভূমি অফিস থেকে প্রত্যয়ন নিতে হলে দিতে হয় ঘুষ, এরপর সার্ভেয়ারের প্রত্যয়নেও ঘুষ, এমনকি বাড়বাবু ও নাজিরের টেবিলে ঘুসের টাকা জমা না হলে এসি ল্যান্ডের টেবিলে ফাইল যায় না।
উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকেও আলাদাভাবে আসে ঘুষ। তা যায় শেখ মো. রাসেলের কাছে। নগরঘাটা গ্রামের নুরুল ইসলাম বলেন, ‘নামজারি করতে আট হাজার টাকা দিয়েছি। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। আগে এসি ল্যান্ড অফিসে দিতে হতো তিন-চার হাজার টাকা। তবে ইউএনও রাসেল অভিযোগ অস্বীকার করেন।