# নামে বেনামে অঢেল সম্পদ # অস্থাবর সম্পদ ১৯১ কোটি টাকার # কৃত্রিম হীরাকে আসল হীরার গ্যারান্টি দিয়ে প্রতারণা # এমপি আনোয়ারুল হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ # ভারতে ১১টি জুয়েলারি দোকান ও বাড়ি #

ছবি কথা বলে আবার ছবি ই মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেয় অন্যভাবে।

নিজস্ব প্রতিবেদক : একসময়ের সামান্য ঠিকাদার ছিলেন দিলীপ কুমার আগারওয়াল। সময়ের পরিক্রমায় বদলে যায় তার জীবনমান। গত দুই দশকে হয়েছেন শত শত কোটি টাকার মালিক। দেশে বিদেশে গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। নামের পাশে লাগিয়েছেন বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অর্থাৎ সিআইপি।

প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণে দেখা গেছে, দেশি-বিদেশি সোনা ও হীরা চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ও অর্থপাচারের গড ফাদার ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের কর্ণধার দিলীপ কুমার আগারওয়াল। গোয়েন্দারা তথ্য বলছে, দেশে-বিদেশে দিলীপসহ অন্তত অর্ধশতাধিক গডফাদার চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত।

দিলীপের বিরুদ্ধে সিআইডি ও দুদকের অনুসন্ধান : স্বর্ণ ও হীরা চোরাচালান, বিদেশে অর্থপাচার, মানি লন্ডারিং, ডায়মন্ডের বদলে উন্নত মানের কাচের টুকরোকে ডায়মন্ড বলে বিক্রি করা, ভারতের কলকাতায় তিনটি জুয়েলারি দোকান ও ১১টি বাড়ি এবং মালয়েশিয়া, দুবাই ও কানাডায় বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ গড়েছেন তিনি। এর বাইরেও নানা রকমের প্রতারণার প্রমাণ পেয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ভোল্ট পাল্টানোর চেষ্টা করেও হলনা শেষ রক্ষা : আওয়ামী সরকারের আমলে সুবিধাভোগী লুটপাটকারী দিলীপ কুমার আগারওয়াল এখন ভোল্ট পাল্টাতে বিএনপির নেতাদের দ্বারে। তার এমন দুটি ছবি এসেছে আমাদের হাতে। সেখানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনের সাথে দেখা যায় দিলীপ কুমারকে। তবে, সেখানে ভেড়ার আগেই আজ মধ্যরাতে র্যাবে জালে ধরা পড়েন দিলীপ।
জুয়েলার্স ব্যবসায়ীদের দাবি- নামে বেনামে গড়ে তুলেছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদ। তাদের মতো অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে সোনার বাজারে এখন অস্থিরতা। এই চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে কাস্টমসসহ দেশের সকল আইন-প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের জোরালো অভিযান ও শাস্তি নিশ্চিত করতে বলেন তারা।
চোরাকারবারে বিশাল সাম্রাজ্য দিলীপের : জুয়েলারি ব্যবসার আড়ালে সোনা চোরাকারবারের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন দিলীপ কুমার আগরওয়ালা। রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মার্কেটের জুয়েলারি দোকানকে কেন্দ্র করে দিলীপ অবৈধ সোনার ব্যবসার শাক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন।
তিন পথেই দিলীপের সিন্ডিকেট : সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈধ উপায়ে সোনা আমাদানির সুযোগ থাকলেও অতিমুনাফা লোভে চোরাচালানের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন দিলীপ। তাদের ছত্রছায়ায় আকাশ, স্থল ও সমুদ্র তিন পথেই হয় সোনা চোরাচালান। হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারের চক্র পরিচালনা করতেন দিলীপ।
সম্পদের পাহাড় দিলীপের : সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, কাগজে কলমে দিলীপ কুমার আগরওয়ালারের বার্ষিক আয় প্রায় ৪ কোটি টাকা। দিলীপ কুমারের নগদ ও বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ প্রায় ১৩ কোটি টাকা। অস্থাবর সম্পদ রয়েছে মোট ১৯১ কোটি টাকার। এমনকি তার স্ত্রীর নামেও রয়েছে ৪৯ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ।
তথ্য সূত্র বলছে, ঢাকা ও চুয়াডাঙ্গায় বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পদ রয়েছে দিলীপ কুমারের। প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা মূল্যের রয়েছে কৃষি জমি। ফ্ল্যাট ও দালানের মূল্য প্রায় ৩১ কোটি টাকা। এমনকি স্ত্রীর স্থাবর সম্পদও রয়েছে প্রায় ৪০ কোটি টাকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সোনা ও নকল হীরা বিক্রি করে দিলীপ কুমারের বার্ষিক আয় আরো কয়েক গুণ। যা দিয়ে বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি।
গ্রাহকদের ল্যাবে তৈরি কৃত্রিম হীরাকে আসল হীরার গ্যারান্টি দিয়ে প্রতারণা করছে দিলীপ আগরওয়ালের ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। এ সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্তে ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর তদন্ত কমিটি গঠন করে দুদক। কিন্তু আজও তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা পড়েনি।
শুধু চোরাচালান নয় দীলিপ আগারওয়ালের বিরুদ্ধে রয়েছে খুনের মামলার মতো গুরুতর অভিযোগ। গত ২২ আগস্ট বাড্ডা থানায় সাবেক স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দিলিপ কুমার আগারয়ালের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়।
অর্জিত সম্পদ নিয়ে হলফনামায় জালিয়াতি : এদিকে, নিজের অর্জিত সম্পদ নিয়ে হলফনামায় দিয়েছেন অসংগতিপূর্ণ তথ্য। হলফনামায় দেখা যায় দিলীপের ১৮৮ ভরী স্বর্ণ ও ৪৬ গ্রাম ডায়মন্ডের মূল্য দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা। অপরদিকে, তার স্ত্রীর ২৩৯ ভরি স্বর্ণ ও ৬২ গ্রাম ডায়মন্ডের মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৮৫ লাখ টাকা। আবার, তার পুত্রের মূল্যবান সম্পদের বিবরণীতে ২২৫ ভরি স্বর্ণ ও ২৪ কেরেটের ডায়মন্ডের কোনো মূল্যেই লিখা নেই।
গৃহিণী স্ত্রীর ঋণ ২১ কোটি : শুধু তাই নয়, নথিতে একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তার ঋণ প্রদান দেখানো হয়েছে প্রায় ১৩ কোটি টাকা, যেখানে গৃহিনী হিসেবে তার স্ত্রীর দেখানো হয়েছে প্রায় ২১ কোটি টাকা। এমন অসঙ্গতি রেখেই হলফনামা জমা দিয়েছেন দিলীপ কুমার।
দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের দাবি, ভবিষ্যতে দিলীপের মতো চোরাকারবাররা যদি এই শিল্পের সাথে জড়িত থাকার সুযোগ পায় বিগত তবে স্বৈরাচার সরকারের মতোই নিজের অপকর্ম চালিয়ে যাবে। ব্যবসায়ীদের দাবি- দেশের স্বর্ণ শিল্পকে বাঁচাতে এসব গডফাদারদের শণাক্ত ও পরিচয় বের করে দ্রুত আইনের আওয়াতায় নিতে হবে।
ফ্ল্যাটের হিসেবে কারসাজি : এদিকে, দিলীপের হলফনামায় স্থাবর সম্পত্তির বিবরণীতে একটু নজর দিলে ধরা পড়বে তার সুক্ষ্ম দুর্নীতি। ২০১৯ থেকে ২০২৩, দুই বছরের ব্যবধানে অভিজাত এলাকা গুলশানের একই এপার্টমেন্টে তিনি ৭ টি ফ্ল্যাট কিনেছেন। ফ্ল্যাটের ঠিকানা ও দামে করেছেন নির্লজ্জের মতো গড়মিল। ৫টি ফ্ল্যাট দেখিয়েছেন আকাশ টাওয়ারে আর ২ টি ফ্ল্যাট দেখিয়েছেন টাওয়ার অব আকাশ-এ। দুটো একই এপার্টমেন্ট বিল্ডিং। এবং নাম বদলের সাথে দামের বিশাল তারতম্যও দেখিয়েছেন এই চরাকারবারি।
অনুসন্ধান বলছে, আকাশ টাওয়ারের ২০২১ সালে কেনা ৪৭৬০ বর্গফুটের ২ টি ফ্ল্যাটের প্রতিটির দাম তিনি দেখিয়েছেন তিন কোটি চার লাখ ৪২ হাজার ৬৩৮ টাকা। সে হিসেবে প্রতি বর্গফুটের দাম দাঁড়ায় প্রায় ছয় হাজার ৪০০ টাকা। যেখানে বিগত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে গুলশান এলাকাতে ফ্ল্যাটগুলোর প্রতি স্কয়ার ফিট ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসেব করলে ফ্ল্যাটটির প্রকৃত মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১২ কোটি টাকা। এভাবেই চরম মিথ্যাচার করেছেন দীলিপ।
এদিকে, একই এপার্টমেন্টে ২০২১ সালে ৪৭৬০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের দাম যেখানে দেখিয়েছেন প্রায় তিন কোটি টাকা। সেই একই এপার্টমেন্টের ২০২৩ সালে ১৪ তলায় কেনা ৪৭৬০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের দাম দেখিয়েছেন মাত্র ১ কোটি তিয়াত্তর লাখ ষাট হাজার টাকা। এভাবেই তার প্রতিটি সম্পদের মূল লুকিয়েছেন চরাকারবারি দিলীপ।
জমি ক্রয়ের মূল্যতেও জালিয়াতি : দ্যা সাউথ এশিয়ান টাইমসের হাতে আসা নথিতে দেখা যায়, শুধু ফ্ল্যাট নয় জমি ক্রয়ের মূল্যতেও জালিয়াতি করেছেন দীলিপ কুমার। তার স্থাবর সম্পত্তির বিবরণীতে খেয়াল করলেই দেখা যাবে, শুধু ২০২৩ সালেই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে দীলিপ প্রায় ১০২ শতক জমি কিনেছেন। সেখানে ২০২৩ সালে জানুয়ারি মাসে কেনা ২৫ শতক জমির ক্রয়মূল্য দেখিয়েছেন ৩৪ লক্ষ ৭২ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি শতক প্রতি দাম পড়েছে এক লক্ষ আটত্রিশ হাজার টাকা। যা এক কথায় অসম্ভব।
স্থানীয়রা জানায়, বর্তমান বাজারে রূপগঞ্জে শতক প্রতি জমির দাম সর্বনিম্ন ১০ লক্ষ টাকা। সে হিসেবে দীলিপের জমির স্বাভাবিক গড় মূল্য দাঁড়ায় ২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা। দিলিপ কুমার আগারওয়াল এভাবে তার সম্পদ বিবরণীর প্রতিটি স্তরে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন।
অভিযোগের সব তথ্য প্রমান সংরক্ষিত আছে আজকের দেশ ডটকম পরিবারের সদস্যদের হেফাজতে। র্যাবের হাতে আটকের পর কারাগারে থাকায় দীলিপের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।