বয়লার পরিদর্শক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান।

নিজস্ব প্রতিবেদক : শত কোটি টাকা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ এসেছে বয়লার পরিদর্শক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানের বিরুদ্ধে। দূনীতির মাধ্যমে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। ফ্যাসিস্ট সরকারের মদদপুষ্ট এই কর্মকর্তা ২০১৫ সালে অবৈধ ভাবে প্রায় ৭০ লাখ টাকা ঘুষ প্রদান করে তাঁর সিনিয়রকে টপকিয়ে এ কার্যালয়ের প্রধান বয়লার পরিদর্শক পদে নিয়োগ লাভ করেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও সবাইকে ম্যানেজ করে এই পদে বহাল তবিয়তে আছেন তিনি। গত ১০ বছর ধরে একই পদে থেকে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। ১০ বছর ধরে এক পদে থাকা নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এদিকে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তদন্তে শিল্প মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

গত ২৭ জুলাই প্রধান বয়লার পরিদর্শক আবদুল মান্নানকে অপসারণ সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির আহ্বায়ক শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব দিলসাদ বেগম ও সদস্য হিসেবে রয়েছেন সহকারী সচিব সোহেরা নাসরীন। এই কমিটিকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এছাড়াও এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে আরো একটি অভিযোগ শিল্প মন্ত্রণালয়ের জিআরএস সফটওয়্যারে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগ যাচাই বাছাই করেই ডিজিটাল মাধ্যমে অভিযোগ তালিকাভুক্ত করা হয়। এই সফটওয়্যারের কার্যক্রম প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মাধ্যমে তদারকি করা হয়। প্রধান বয়লার পরিদর্শকের অভিযোগটি এখন শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ও অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তা (অনিক) ড. মো. সাইফুল ইসলাম তদন্ত শুরু করেছেন। এরই অংশ হিসেবে গত ২২ জুলাই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনিক কর্মকর্তা ও উপপ্রধান বয়লার পরিদর্শক প্রকৌশলী মো. ফজলে রাব্বির নিকট অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতে পাঠানো হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে মতামত প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মান্নানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠার বিষয়টি স্বীকার করে গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, বয়লার পরিদর্শকের অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করতে মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে তিনি দোষী প্রমাণিত হলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য বয়লার পরিদর্শক মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করা চেষ্টা করা হলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায় বিধায় তার কোন বক্তব্য প্রকাশিত হলো না ।
জানা গেছে বয়লার সেক্টরে নানা অনিয়মের সাথে জড়িত এই কর্মকর্তা। ৩ টন বয়লারকে ২ টন দেড় টনকে এক টন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এতে সরকারের লোকসান হলেও শিল্প ও কল কারখানা মালিকরা লাভবান হয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে তার মামাশ্বশুর ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম। চাচাশ্বশুর আওয়ামী লীগপন্থি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ইকবাল আর্সলান। তাদের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ হন সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর সাথে। সাবেক এই প্রভাবশালী মন্ত্রীকে ম্যানেজ করে ঘুষ দিয়ে এই পদে নিয়োগ পান মান্নান।
এর পর তিনি বয়লারের বিভিন্ন সেক্টর থেকে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়,দেশে প্রায় ৪০ বয়লার নির্মাণের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অথচ নিজ ভাগ্নের নামে প্রতিষ্ঠান ‘টেকনো কেয়ার’-এর মাধ্যমে বাধ্যতামূলক ডিজাইন করানো হতো।
পরবর্তীতে ধাপে ধাপে ঘুষ দিয়ে এসব ইন্ডাস্ট্রিয়াল বয়লারের অনুমোদন মিলত। তবে টেকনো কেয়ারের বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ডিজাইন করালে সেটির অনুমোদন মিলত না। “টেকনো কেয়ার” নামক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ঠিকানা: ২৪৭ ওয়াপদা রোড, ফ্ল্যাটই/২, পশ্চিম রামপুরা, ঢাকা-১২২৯।
অবৈধভাবে প্রধান বয়লার পরিদর্শক পদে আসীন হওয়ার পর থেকেই কৌশলে বয়লার অপারেটরদের সনদ প্রদান বিষয়ে নিজের নিকট আত্মীয় ও তার নিজ জেলা রাজবাড়ীর লোকজন নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। এই সিন্ডিকেটের দুইজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হচ্ছে (১) প্রধান বয়লার পরিদর্শকের আপন ভাগিনা মোহাম্মদ শরীফ হোসেন (১ম শ্রেণির বয়লার অপারেটর) ও (২) অন্যজন প্রথম শ্রেণির বয়লার অপারেটর মোঃ ইমন হাসান। উক্ত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সনদ প্রার্থী পরীক্ষার্থীদের টাকার বিনিময়ে অসাধু পন্থায় সনদ প্রদান করা হয়।
মান্নান এই কার্যালয়ে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে বয়লার নির্মাণ, বয়লার নিবন্ধন, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ ও বয়লার অপারেটর সদন প্রদানে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
ডিজাইন ও এর অনুমোদন বাবদ ৮ স্তরের প্রতি স্তরে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে ঘুষ দিতে হতো। এই টাকা সরাসরি প্রধান বয়লার পরিদর্শক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানের নিকট দিতে হতো।
শর্ত না মেনে মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ও নিয়োগ কমিটির সদস্যসচিব মো. শরাফত আলী যথাযথ জেলা কোটা অনুসরণ না করে, স্বজনপ্রীতি ও ঘুষের বিনিময়ে বয়লার টেকনিশিয়ান পদসহ নানা পদে বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়োগ দিয়ে বাণিজ্য করেছেন।
শিল্প মন্ত্রণালয়ে দায়েরকৃত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানের মিরপুর ডিওএইচএস এর ৬ নম্বর রোডের ৪১৬ নম্বর গ্রিন উড সাউথ শাইন বিল্ডিং ২২৫০ বর্গফুটের দুইটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন। যার মূল্য ৭ কোটি টাকা। রাজবাড়ি শহরে প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের একটি ডাবল ইউনিটের বহুতল আলিসান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। রাজবাড়ি সদর হাসপাতালের কাছে ৫ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ২০ কাঠা জমি, ঢাকার হেমায়েতপুরে সুগন্ধা হাউজিংয়ে ৫ কোটি টাকা মূল্যের ৮ কাঠার একটি প্লট কিনেছেন। এ ছাড়া ঢাকার অভিজাত এলাকায় তার একাধিক ফ্ল্যাট এবং প্লট রয়েছে।
প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়ে ২০০৪ সালে প্রথম বয়লার পরিদর্শক পদে যোগদান করেন। অতঃপর ২০১৩খ্রিঃ সালে উপপ্রধান বয়লার পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১৫ সালে প্রধান বয়লার পরিদর্শক পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হন।