গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ডঃ মঈনুল ইসলাম।

বিশেষ প্রতিবেদক : গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ডঃ মঈনুল ইসলাম এর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ইতোপূর্বে তিনি মেট্রোপলিটন জোনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন । তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, দুর্নীতি এবং অনিয়মের মাধ্যমে শত কোটি টাকারও বেশি সম্পদ অর্জনের অভিযোগ চাউর হলে গোটা গণপূর্ত জুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ওই অনিয়মগুলো মাত্র তিনটি প্রকল্প থেকে গড়েছেন বলে জানা গেছে । তাঁর কর্মজীবন শুরু থেকেই ছিল বিতর্কিত। ১৫তম ব্যাচের সহকারী প্রকৌশলীরা ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর চাকরিতে যোগদান করলেও তিনি ৯ মাস দেরিতে, ১৯৯৬ সালের ১২ অগাস্ট যোগদান করেন ।
তার কর্মজীবনের সবচেয়ে অস্বাভাবিক ঘটনাটি হলো ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৯ বছর ৮ মাস ২২ দিন কর্মস্থল থেকে চূড়ান্তভাবে অনুপস্থিত থাকা । এই দীর্ঘ অনুপস্থিতির জন্য তাকে চাকরি থেকে চূড়ান্তভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। একটি স্বাভাবিক প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় এমন গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গের পর কোনো সরকারি কর্মকর্তার জন্য চাকরিতে পুনর্বহাল হওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে তিনি পরবর্তীতে মন্ত্রণালয়ে আপিলের মাধ্যমে তার চাকরি ফিরে পান ।

এই ঘটনাটি কেবল একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার বর্ণনা নয়, বরং একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রভাবের ইঙ্গিত বহন করে। এই অস্বাভাবিক পুনর্বহালের নেপথ্যে শক্তিশালী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা কাজ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তিনি “আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর নিকটাত্মীয়” এবং তার প্রভাবেই চাকরিতে পুনর্বহাল হন ।

১.২ খুলনা গণপূর্ত বিভাগ : দুর্নীতির , এসব অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে অমিত কুমার বিশ্বাস-এর নাম উঠে এসেছে । প্রাপ্ত তথ্যসূত্র অনুযায়ী, একজন স্থানীয় ঠিকাদার, মাহবুব মোল্লা, খুলনা গণপূর্ত বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত কুমারের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন । এই অভিযোগগুলো প্রধানত টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, পিপিআর ২০০৮-এর নীতিমালা লঙ্ঘন, পেশিশক্তি ব্যবহার এবং নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার সাথে সম্পর্কিত ।
এছাড়াও, খুলনা শিশু হাসপাতাল, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং একাধিক থানা ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে, যেখানে নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত কুমার বিশ্বাস ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. খালেকুজ্জামানের মতো কর্মকর্তাদের নাম এসেছে । এই তথ্য থেকে পরিষ্কার যে, খুলনা গণপূর্ত বিভাগের দুর্নীতির অভিযোগগুলো ড. মঈনুল ইসলামের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং এটি একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে সংঘটিত
২. ড. মঈনুল ইসলাম-এর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ যথাক্রমে,
২.১ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ ও আর্থিক দুর্নীতি : ড. মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ ও অনিয়মের মাধ্যমে শত কোটি টাকারও বেশি সম্পদ এবং নগদ অর্থের মালিক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে । অভিযোগ রয়েছে যে তিনি মাত্র তিনটি প্রকল্প থেকেই এই বিশাল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন। গণপূর্ত অধিদপ্তরে তিনি ‘মিস্টার টেন পার্সেন্ট’ নামে পরিচিত ছিলেন । এই উপাধিটি প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে তার ১০% কমিশন নেওয়ার অভিযোগের ইঙ্গিত দেয় । তার বিরুদ্ধে বিদেশে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া ও দুবাইয়ে, বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে ।
এই অভিযোগগুলো তার সরকারি বেতন ও বৈধ আয়ের উৎস থেকে অর্জিত সম্পদের তুলনায় পাহাড়-সমান অবৈধ সম্পদের ইঙ্গিত দেয়, যা তার ব্যক্তিগত আর্থিক দুর্নীতির গভীরতা প্রমাণ করে ।
২.২ ঠিকাদার সিন্ডিকেটের সাথে যোগসাজশ : ড. মঈনুল ইসলাম যুবলীগের বিতর্কিত নেতা ও ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া (জি কে) শামীম-এর সিন্ডিকেটের একজন প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে চিহ্নিত জি কে শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদের সময়ই তার দুর্নীতির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের পক্ষ থেকে ড. মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঘুষ, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ জমা দেওয়া হয়েছে, যেখানে তার ছাত্রজীবন, রাজনৈতিক পরিচয় ও অর্থ-সম্পদের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে
একটি নির্দিষ্ট মামলায় ঠিকাদার আসিফ ও শাহাদাত এবং ১১ জন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ৩১ কোটি টাকারও বেশি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে । এই মামলার আসামিরা সবাই ড. মঈনুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বলে জানা যায়। এই তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, দুর্নীতি কেবল একক ব্যক্তির মাধ্যমে সংঘটিত হয়নি, বরং এটি একটি সুসংগঠিত সিন্ডিকেটের কার্যক্রম, যেখানে ড. মঈনুল ইসলাম একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে তার ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এই চক্রটি ঠিকাদার ও প্রকৌশলীদের আঁতাতের মাধ্যমে পুরো টেন্ডার ও প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে।
এটি গণপূর্ত অধিদপ্তরের অভ্যন্তরে একটি ক্ষমতাবান “মাফিয়া চক্র”-এর অস্তিত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ ।
২.৩ দুদকের তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়া : ড. মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত ২৬ ডিসেম্বর (২০২০) তার দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করে । তাকে ৫ জানুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলবি নোটিশ পাঠানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার সম্পদ বিবরণীও নেওয়া হয়েছে । দুদক সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, ড. মঈনুলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে সংস্থাটি নিশ্চিত হয়েছে এবং অভিযোগের পক্ষে যথেষ্ট নথিপত্রও পাওয়া গেছে ।
এই ধরনের উচ্চপদস্থ ও ক্ষমতাধর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের এই সুনির্দিষ্ট ও সময়োপযোগী পদক্ষেপটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। পূর্বে এই ধরনের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে দুদকের
“ধীর গতির নীতি” ছিল বলে অভিযোগ ছিল : সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং গণমাধ্যম ও জনগণের চাপের কারণে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়াটি গতিশীল হয়েছে। অনেক দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী এখন মামলার ভয়ে কাজে অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও দায়ের করা হয়েছে ।
এই ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে যে, দুর্নীতি শুধু ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক নয়, বরং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ৩.১ টেন্ডার সংক্রান্ত দুর্নীতি।
খুলনা গণপূর্ত বিভাগ-১ এ নিলাম দরপত্রে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে, যেখানে পিপিআর ২০০৮-এর নীতিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে । অভিযোগ অনুযায়ী, প্রতিদিন দরপত্র গ্রহণের পরিবর্তে নির্দিষ্ট একটি দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল। এছাড়াও, দরপত্র জমা দেওয়ার বিকল্প স্থান (যেমন: জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বা পুলিশ সুপারের কার্যালয়) রাখা হয়নি ।
এই অনিয়মের কারণে নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। অভিযোগ রয়েছে যে, এই ব্যবস্থাটির সুবিধা নিয়ে দুর্বৃত্ত ও পেশিশক্তির লোকজন সাধারণ ঠিকাদারদের দরপত্র দাখিলে বাধা দেয় । এই ধরনের অপ্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার প্রক্রিয়া সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতির কারণ হয়, কারণ সিন্ডিকেটভুক্ত ঠিকাদাররা কম মূল্যে সরকারি সম্পত্তি নিলাম করতে পারে । এটি প্রমাণ করে যে, খুলনা গণপূর্ত বিভাগে একটি শক্তিশালী ঠিকাদার-প্রকৌশলী সিন্ডিকেট চক্র সক্রিয় রয়েছে।
খুলনা গণপূর্ত বিভাগ-১ এর অধীনে প্রায় ৫০টি পরিত্যক্ত ভবন ও ২০টি কোয়ার্টার রয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে যে, এসব ভবন ও কোয়ার্টার মেরামতের নামে প্রতি বছর কোটি টাকা লোপাট করা হয়। প্রকৃতপক্ষে কোনো কাজ না করেই এই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এছাড়াও, জোনাল অফিস এবং নির্বাহী প্রকৌশলীর অফিস মেরামতের নামে আরও এক কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে । এই ধরনের ‘ভুতুড়ে’ মেরামত কাজ সরকারি অর্থ লোপাটের একটি সুসংগঠিত পদ্ধতি, যা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত হয়।
নিচের সারণীতে খুলনা গণপূর্ত বিভাগে অভিযুক্ত প্রকল্পসমূহের সারসংক্ষেপ ও অভিযোগ যথাক্রমে তুলে ধরা হলো : প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণ করে যে,গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মঈনুল ইসলাম এবং খুলনা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত ড. মঈনুল ইসলামের মতো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যখন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সিন্ডিকেট পরিচালনা করেন, তখন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা (যেমন: খুলনাতে অমিত কুমার) সেই একই ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির ধারা অনুসরণ করে। জি কে শামীমের মতো ঠিকাদার এবং ড. মঈনুল ইসলামের মতো প্রকৌশলীদের সিন্ডিকেটগুলো পুরো সরকারি ক্রয় ও নির্মাণ ব্যবস্থাকেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে।
সামগ্রিক প্রভাব : এই ধরনের দুর্নীতি সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি, প্রকল্পের নিম্নমান, জনগণের দুর্ভোগ এবং সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থার ওপর থেকে জনগণের আস্থা হ্রাস করে।
এই প্রতিবেদনটি প্রমাণ করে যে, কেবল ব্যক্তিগতভাবে একজন কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করাই যথেষ্ট নয়, বরং দুর্নীতির পেছনে থাকা রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতার উৎসগুলোকেও উন্মোচন করা জরুরি।
একজন উচ্চপদস্থ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ বিদ্যমান এবং একই সাথে খুলনা গণপূর্ত বিভাগে কাঠামোগত দুর্নীতি বিদ্যমান, যার সাথে অন্যান্য প্রকৌশলীরা জড়িত।
মূল পর্যবেক্ষণসমূহের সারসংক্ষেপ যথাক্রমে তুলে ধরা হলো:
# গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মঈনুল ইসলাম, যিনি একজন ক্ষমতাধর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকের আশ্রয় পেয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ এবং জি কে শামীম সিন্ডিকেটের সাথে যোগসাজশের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। দুদক তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে এবং পর্যাপ্ত নথিপত্রও পেয়েছে।
# খুলনা গণপূর্ত বিভাগে, নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত কুমার-এর অধীনে টেন্ডারে অনিয়ম, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
এসব অনিয়মের বিষয় জানতে চেয়ে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে ফোন কল গ্রহণ করেননি। তাঁর হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও কোনো সাড়া মেলেনি বিধায় তার কোন প্রকার বক্তব্য প্রকাশিত হলো না ।