আলোচিত ও সমালোচিত জজ মিয়া নাটকের মুল নায়ক জজ মিয়া।

আখতারুজ্জামান আজাদ : ‘জজ মিয়া’ নামটা উচ্চারণের সাথে-সাথে আরেকটা শব্দ অবধারিতভাবে চলে আসে— ‘নাটক’। জজ মিয়া নামটা গণমাধ্যমে যতবারই আসে, আসে ‘জজ মিয়া নাটক’ আকারে। বয়সে যারা একেবারেই তরুণ, যাদের জন্ম একুশ শতকে; তাদের অনেকেই জানে না জজ মিয়া কে, ‘জজ মিয়া নাটক’ কী, এই ব্যক্তি কেন কবে থেকে দেশব্যাপী পরিচিত।
জজ মিয়ার প্রকৃত নাম মো. জালাল, বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগে। পেশায় ছিলেন বাস কনডাক্টর। কোথাও-কোথাও বর্ণিত আছে তিনি গুলিস্তানে সিডি কিংবা পোস্টার বিক্রি করতেন। বাবা ভাঙারির ব্যবসা করতেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। জজ মিয়ার লেখাপড়া পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। তবে, তিনি গ্রামের বিচার-সালিশিতে অংশ নিতেন এবং সেখানে বিচারকদের মতো করে কথা বলতেন বিধায় এলাকায় তিনি জজ মিয়া বলে পরিচিত হয়ে যান। মোদ্দা কথা— জজ মিয়া কোনো মাপকাঠিতেই উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যক্তি নন, জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি অর্জন করার মতো ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো কাজই একজীবনে তিনি করতে পারেননি। কিন্তু এখন এটুকু নিশ্চিত— এই মুহূর্তে জজ মিয়ার মৃত্যু হলে সেই খবর দেশের প্রতিটা গণমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করবে। নিজে উল্লেখযোগ্য কিছু না করেও জজ মিয়া নব্বইপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছেন।

২০০৪ সালের একুশে আগস্ট আওয়ামি লিগের (তৎকালীন বিরোধীদল) জনসভায় গ্রেনেডহামলা হয়। তাতে চব্বিশজন নিহত হন। নির্দিষ্ট একটা রাজনৈতিক দলকে সমূল ধ্বংস করে দেওয়ার মতো এমন হামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে অদ্যাবধি এই একবারই সংঘটিত হয়েছে। এই ঘটনাই বাংলাদেশের তৎপরবর্তী রাজনীতির ভূপ্রকৃতি আমূল বদলে দিয়েছে। পারস্পরিক বিশ্বাসের যে ছিটেফোঁটাটুকু রাজনৈতিক অঙ্গনে তখনও অবশিষ্ট ছিল, একুশে আগস্টের পর তা বাংলাদেশের বুক থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছে। বাংলাদেশের মূল ধারার রাজনীতির ঠিক মাঝখানে অবিশ্বাসের পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একুশে আগস্ট।

তৎকালীন বিএনপি সরকার এই হামলার তদন্তে কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি, যদিও আওয়ামি লিগের অভিযোগ বিএনপিই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের সমাবেশে হামলা করেছে। তদন্তের জন্য সরকার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, এফবিআই এবং ইন্টারপোলকেও ডেকে এনেছিল। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পেয়ে সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা ফিরে গিয়েছিলেন; যদিও সরকার প্রচার করেছিল— স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড তাদের প্রতিবেদনে এমনসব স্পর্শকাতর তথ্য দিয়ে গেছে, যা প্রকাশ করলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। যা হোক, হামলা যারাই করুক, ক্ষমতাসীন দল হিশেবে তখন বিএনপির ওপর বহুমুখী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ ছিল ঘটনার আদ্যোপান্ত আবিষ্কার করার। বিএনপি তা পারেনি। এই ইশুতে বিএনপি ধারাবাহিকভাবে এলোমেলো আচরণ করেছে, অনর্গল মিথ্যাচার করেছে, সন্দেহের তীর বারবারই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেদের দিকে নিয়ে গেছে।
ঘটনার চারদিনের মাথায় তৎকালীন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শৈবাল সাহা পার্থ নামক একজন সাধারণ তরুণকে গ্রেপ্তার করে। চারদিন গুম করে রেখে এরপর তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। চৌদ্দ দিন রিমান্ডে নির্যাতন করে তাকে দিয়ে স্বীকার করানো হয় যে, সে একুশ আগস্টের গ্রেনেডহামলার সাথে জড়িত। তাকে দিয়ে বলানো হয়— এলিফ্যান্ট রোডের একটা সাইবার ক্যাফে থেকে তিনি কোনো এক দৈনিক পত্রিকাকে ইমেইল পাঠিয়েছেন শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়ে।
প্রকৃতপক্ষে, পার্থ ঐ সাইবার ক্যাফে থেকে চাকরির আবেদন করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইমেইল পাঠাতেন, একই ক্যাফের একই কম্পিউটার থেকে একটা উগ্রবাদী গোষ্ঠী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়ে ইমেইল করেছিল। এই ব্যাপারটাকে পুঁজি করে পার্থকে বলির পাঁঠা বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। পার্থ চেন্নাইয়ে পড়ালেখা করেছিলেন বিধায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সুবিধা হয়েছিল। বাহিনী প্রচার করতে পেরেছিল— পার্থ ভারতের দালাল, ভারতের স্বার্থ হাসিল করার জন্যই ভারতের এই ‘দালাল’ শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছেন।
একজন সাধারণ তরুণ একাই একুশে আগস্টের গ্রেনেডহামলার মতো এত প্রলয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবেন— এমন স্থূল পাণ্ডুলিপিও বিএনপির আমলে বাংলাদেশে রচিত হয়েছিল। কিন্তু এই আষাঢ়ে গল্প হালে পানি পায়নি। আদালত শেষ পর্যন্ত পার্থকে জামিন দিয়ে দেয় এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোখলেছুর রহমান নামক একজন সাবেক ওয়ার্ড কমিশনারকে গ্রেপ্তার করে পার্থের মতো একইভাবে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতেও ফায়দা হয়নি।
কোনোকিছুতেই সুবিধে করতে না পেরে, পরের বছর, ২০০৫ সালের জুন মাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নোয়াখালী থেকে মো. জালালকে গ্রেপ্তার করে ঢাকায় নিয়ে আসে; যিনি এই লেখার আলোচ্য জজ মিয়া। গ্রেপ্তারকালে তার বয়স ছিল পঁচিশ। তাকেও পার্থ ও মোখলেছের মতো নির্যাতন করা হয়।
দীর্ঘদিন অজ্ঞাত স্থানে রেখে জজ মিয়াকে বেধড়ক পেটানো হয়, বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়, অবলম্বন করা হয় নির্যাতনের সম্ভাব্য সব প্রক্রিয়া। তাকে স্বীকার করতেই হবে যে, ঢাকার শীর্ষসন্ত্রাসীদের যোগসাজশে তিনিই আওয়ামি লিগের সমাবেশে গ্রেনেডহামলা করেছেন। স্বীকার করলে তাকে রাজসাক্ষী করা হবে, পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণের জন্য সরকারের তরফ থেকে মাসে-মাসে ভাতা দেওয়া হবে, কারাগারে বিলাসী জীবন যাপন করতে দেওয়া হবে, সরকারি খরচে বোনের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে, স্বীকারোক্তি দেওয়া হয়ে গেলে (জজ মিয়াকে) বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
স্বীকার না করলে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে কিংবা ক্রসফায়ার দেওয়া হবে। (ক্রসফায়ারের) সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে যখন ক্রসফায়ারের মহড়া দেওয়া হয়, জজ মিয়া তখন স্বীকারোক্তি দেন যে, তিনিই শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য আওয়ামি লিগের সমাবেশে এই হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছেন। স্বীকারোক্তি দেওয়ার আগ পর্যন্ত জজ মিয়াকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে কারাগারের কনডেম সেলে রাখা হয়। কনডেম সেলে রাখা হয় ফাঁসির আসামিদেরকে। ডিবিসি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জজ মিয়া দাবি করেছেন কারাগারে তাকে দেখতে পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শকও গিয়েছিলেন। মহাপরিদর্শককে তিনি অনুরোধ করেছিলেন ডান্ডাবেড়ি খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার জন্য। কিন্তু মহাপরিদর্শক নাকি জজ মিয়াকে বলেছিলেন স্বীকারোক্তি দেওয়ার আগ পর্যন্ত ডান্ডাবেড়ি না খোলার ব্যাপারে ‘ওপরের মহলের নির্দেশ’ আছে। এই ওপরের মহল যে তৎকালীন সরকার, তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
মজার ব্যাপার হচ্ছে— গ্রেনেড দেখতে কেমন, বোমা আর গ্রেনেডের পার্থক্য কী; জজ মিয়া তাও জানতেন না। একজন বাস কনডাক্টর বা সিডিবিক্রেতার এসব জানারও কথা না। আন্তর্জাতিক যুদ্ধক্ষেত্রে যেসব গ্রেনেড ব্যবহৃত হয়, একুশে আগস্টের হামলায় ব্যবহার করা হয়েছিল সেইসব আর্জেস গ্রেনেড। এসব গ্রেনেড সম্পর্কে দেশের শীর্ষসন্ত্রাসীদেরও জানার কথা না; জানার কথা কেবল তাদের, যারা সামরিক বাহিনীর সাথে জড়িত বা যাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে। যা হোক, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে কী কী বলতে হবে; জজ মিয়াকে কারাগারে তা প্রতিদিন মুখস্থ করানো হতো। স্বীকারোক্তিতে তিনি আরো যেসব সন্ত্রাসীর সম্পৃক্ততার কথা বলবেন; তাদের নামসহ ছবি তার টেবিলের ওপর রেখে দেওয়া হতো, যাতে তিনি আদালতে তাদেরকে নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করতে পারেন। অর্থাৎ যত রকম সাবধানতা অবলম্বন সম্ভব, জজ মিয়া ইশুতে এর সবকিছুই সরকার বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তখন অবলম্বন করেছিল বা করার চেষ্টা করেছিল।
জজ মিয়া যে বলির পাঁঠা, তাকে নিয়ে ফাঁদা সরকারি গল্পের গাঁথুনি যে যারপরনাই দুর্বল; ২০০৫ সালেরই জুন মাসে এ নিয়ে ‘প্রথম আলো’য় দুটো প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বিব্রত ও বিরক্ত হলেও সরকার জজ মিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করে দেয়নি। জজ মিয়া বিএনপির আমলে মুক্তি পেলে বিএনপির জন্য তা ভয়ংকর বুমেরাং হয়ে দাঁড়াত। মুক্তি পাওয়ার জন্য তাকে চার বছর অপেক্ষা করতে হয়। বিএনপির পতনের পর, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আদালতে জজ মিয়া নির্দোষ প্রমাণিত হন এবং ২০০৯ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান। বলা হয়ে থাকে— সিআইডির তিন পুলিশকর্মকর্তা জজ মিয়া নাটকের পাণ্ডুলিপি রচনা করেছিলেন। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে ঐ তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়, একুশে আগস্টের গ্রেনেডহামলার মূল মামলায়ও আসামি হিশেবে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তারা এখন জামিনে আছেন। জজ মিয়াকে যারা ফাঁসাতে চেয়েছিলেন, ভাগ্যের নির্মম পরিহাস— খোদ তাদেরকেই কারাগারে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। পুলিশের এককালের মহাপরাক্রমশালী মহাপরিদর্শক, এনএসআই-ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালকদেরকেও একুশে আগস্ট-মামলায় জেল খাটতে হয়েছে; ক্ষমতায় থাকাকালে যা ছিল তাদের কল্পনারও ঊর্ধ্বে। এই মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মুফতি হান্নান আর জামায়াতে ইসলামির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি আগেই কার্যকর হয়ে গেছে ভিন্ন-ভিন্ন মামলায়। সাজাপ্রাপ্ত হারিছ চৌধুরী (বেগম খালেদা জিয়ার ২০০৪ সালের রাজনৈতিক সচিব) করোনায় মারা গেছেন পান্থপথে আত্মগোপনে থাকাবস্থায়। বিএনপির সাবেক দুই মন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু আর লুৎফুজ্জামান বাবর এই মামলায় কারাভোগ করছেন, পিন্টুর ভাই মওলানা তাজুল ইসলাম ঘটনার পরপরই সাউথ আফ্রিকায় পালিয়ে গেছেন। উল্লিখিতদের ধারণা ছিল একুশে আগস্টকে তারা হজম করে ফেলতে পারবেন। কিন্তু তারা তা হজম করতে পারেননি। নিজ দেহের চেয়ে বড় আকারের খাদ্য কোনো প্রাণীই হজম করতে পারে না।
একুশে আগস্টের গ্রেনেডহামলার দায়ভার চাপিয়ে দেওয়ার জন্য তৎকালীন সরকার একাধিক ব্যক্তির ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেও সেসব ব্যক্তির নাম ‘বাগধারা’ হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জজ মিয়ার নাম। এখনও, ঘটনার সাথে সম্পর্কহীন কাউকে কোনো মামলার সাথে জড়ানোর চেষ্টা করা হলে সাথে-সাথে লোকে বলে ওঠে— ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজানো হচ্ছে। কালের পরিক্রমায় ব্যাকরণবইয়েও ‘জজ মিয়া’ একদিন হয়তো বাগধারা হিশেবে ঠাঁই পেয়ে যাবে। এমনকি কোনো-কোনো বিএনপি-নেতাও ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ অর্থে ‘জজ মিয়া’ বাগধারাটা অসাবধানতাবশত ব্যবহার করে ফেলেন। শৈবাল সাহা পার্থ বা মোখলেছুর রহমান একুশে আগস্ট ইশুতে জাতীয়ভাবে পরিচিতি পাননি বা বাগধারায় পরিণত হননি, হয়েছেন জজ মিয়া। কারণ জজ মিয়ার গ্রেপ্তারকে বিএনপিনেতারা একুশে আগস্ট ইশুতে সরকারের বড় সাফল্য হিশেবে প্রচার করেছিলেন, জজ মিয়াকে ঘটনার হোতা হিশেবে গণমাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তখন বিএনপিনেতারা জজ মিয়াকে লুফে না নিলে জজ মিয়া কিংবদন্তিতে পরিণত হতেন না, বিএনপিও একুশে আগস্ট ইশুতে ‘ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট’ পেয়ে যেতে পারত।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি বিএনপি সরকারের অসহযোগিতার কারণে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, এফবিআই, ইন্টারপোল তদন্ত শেষ না করেই ফিরে গিয়েছিল। সরকার এরপর একজন বিচারপতিকে (জয়নুল আবেদিন) দিয়ে একসদস্যবিশিষ্ট একটা বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনও গঠন করেছিল। সেই কমিশন প্রতিবেদনে বলেছিল— বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী গোয়েন্দাসংস্থা ভাড়াটে সন্ত্রাসীদেরকে দিয়ে আওয়ামি লিগের সমাবেশে গ্রেনেডহামলা চালিয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্রই যদি হামলা চালায়, তা হলে জজ মিয়া কীভাবে হামলার পরিকল্পনাকারী হন; আবার জজ মিয়া পরিকল্পনাকারী হলে সেই পরিকল্পনায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র কীভাবে যুক্ত হয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পরাক্রমশালী গোয়েন্দাসংস্থা সামান্য একজন সিডি-বিক্রেতার (জজ মিয়া) সাথে যোগসাজশ করে কীভাবে হামলা চালায়— তৎকালীন বিএনপি সরকার জাতিকে এই সমীকরণ মিলিয়ে দেখাতে পারেনি, অঙ্কে গোলমাল বাঁধিয়ে ফেলেছিল। জজ মিয়া নাটক না ফাঁদলে বিএনপি এই দাবিতে অনড় থাকতে পারত যে, প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দাসংস্থাই হামলা পরিচালনা করেছে। কিন্তু সমীকরণ বারবার ভিন্ন-ভিন্ন উপায়ে মিলিয়ে দেখাতে গিয়ে বিএনপি ভুলক্রমে জজ মিয়াকে বাজারজাত করে ফেলেছে এবং এই এক ভুলের কারণেই গ্রেনেডগণিতে ফেল করে বসে আছে। আষাঢ়ে গল্পের যত পাণ্ডুলিপি ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি রচনা করেছে, এর কোনোটারই সফল বাস্তবায়ন তারা করে দেখাতে পারেনি; প্রত্যেকবারই ধরা পড়েছে। মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বিএনপিকে বারবার ডুবিয়েছে।
২০০৬ সালের পর থেকে বিএনপি যে অদ্যাবধি ক্ষমতার বাইরে আছে, এর পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে দুটো ঘটনা। দুটোই ঘটেছে ২০০৪ সালে। একটা হলো নির্দিষ্ট একজন বিচারপতিকে (কেএম হাসান) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানানোর জন্য প্রধান বিচারপতিদের অবসরগ্রহণের বয়স টেম্পারিং করে সংবিধানসংশোধন, অন্যটা একুশে আগস্টের গ্রেনেডহামলা। ঐ সংবিধানসংশোধনের কারণেই ২০০৭ সালে দুই বছরব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল এবং ষোলো বছর পর দেশে ফের সেনাশাসন নেমে এসেছিল। আর একুশে আগস্টের গ্রেনেডহামলার কারণেই অনির্দিষ্টকালের জন্য বিএনপির রাজনৈতিক কবর-রচনা হয়ে গিয়েছিল।
ঐ হামলা না ঘটলে বা না ঘটালে বিএনপিকে এতদিন ক্ষমতার বাইরে থাকতে হতো না। এই এক একুশে আগস্টই রাজনীতি থেকে বিএনপিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ছিটকে দিয়েছে। পুরোনো প্রতাপে রাজনীতিতে ফিরে আসা বিএনপির জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে সেরেফ একুশে আগস্টের জন্য। পরিতাপের বিষয় হলো— একুশে আগস্ট নিয়ে বিএনপির কোনো অনুশোচনা নেই, আত্মসমালোচনা নেই; দলটির সাধারণ কর্মীরাও একুশে আগস্ট ইশুতে কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন না। অন্তত একটা ব্যাপারে বিএনপির যদি অনুতাপ থাকত, তা হলে বিএনপি ইতিহাসের কিছুটা দায়মুক্তি পেত। একুশে আগস্টের ব্যাপারে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন— ‘না না, এগুলো কোনো ক্ষতই না। এটা জাতির দুর্ঘটনা। জাতীয় জীবনে এ রকম বহু দুর্ঘটনা ঘটে। পৃথিবীর বহু দেশে এ রকম বহু দুর্ঘটনা আছে। এটা নিয়ে কোনো জাতি সারাজীবন কান্নাকাটি করে না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ওগুলো কোনো বিষয়বস্তুই না।’
একুশে আগস্টের হত্যামামলায় আদালত উনিশজনকে মৃত্যুদণ্ড, উনিশজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং এগারোজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দিয়েছে; যাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন বা আছেন। বিএনপি-আমলের গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এই তালিকায় আছেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আছেন বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) তারেক রহমানও। যদি ধরেও নেওয়া হয় তৎকালীন সরকারের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কেউই বা বিএনপির কোনো নেতাই কোনোভাবে এই ঘটনার সাথে সামান্যতমও সম্পৃক্ত নন; বরং প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দাসংস্থাই ঘটনা ঘটিয়েছে বা খোদ শেখ হাসিনাই ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন অথবা ভিনগ্রহ থেকে এলিয়েনরা গুলিস্তানে এসে কর্ম সম্পাদন করে গেছে; তাতেও ঘটনার দায় থেকে বিএনপি পার পায় না। কারণ— ঐ এক জজ মিয়া। জজ মিয়াকে আমদানি করেই একুশে আগস্টের দায় বিএনপি অজ্ঞাতসারে সরাসরি নিজদের ঘাড়ে তুলে নিয়ে বসে আছে, আর নামাতে পারছে না।
গ্রেনেডহামলার বছরেই, ২০০৪ সালে, বাংলাদেশে আরো একটা প্রলয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম) হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ২০০৪ সালের পহেলা এপ্রিল চীন থেকে দশ ট্রাক অস্ত্র আসে। তৎকালীন বিএনপি সরকারের নির্দেশে দেশের গোয়েন্দাসংস্থাগুলো অস্ত্রের ঐ চোরাচালান চট্টগ্রামে খালাশ করে আসামে উলফার কাছে পাচার করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু চালে সামান্য ভুলের কারণে সেই চোরাচালান ধরা পড়ে যায়, বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল সেই ঘটনা। এই অস্ত্রচোরাচালানের মামলায় বিএনপিনেতা লুৎফুজ্জামান বাবর আর জামায়াতে ইসলামির তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামির ফাঁসির আদেশ হয়েছে ঘটনার এক দশক পর (যদিও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় নিজামির ফাঁসি ইতোমধ্যেই কার্যকর হয়ে আছে)।
কিন্তু বিএনপির শাসনামলে ঘটনা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল চট্টগ্রামের এক মহিলা মেম্বারের ওপর। বাবরের নির্দেশে পুলিশ তড়িঘড়ি করে একটা মামলা করেছিল; যাতে আসামি করা হয়েছিল অস্ত্রবহনকারী জাহাজের মাঝিমাল্লাদেরকে, জেটি শ্রমিকদেরকে আর প্রধান আসামি করা হয়েছিল ইউনিয়ন পরিষদের এক মহিলা মেম্বারকে। চট্টগ্রামের সেই মেম্বারের নাম বদনী বেগম (ওরফে মরিয়ম)। সেই মামলায় বদনী চার মাস কারাভোগ করেছেন, মামলার ঘানি টেনেছেন দশ বছর।
দশটা ট্রাকে ভর্তি করে শত কোটি টাকার অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র, দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম অস্ত্রচোরাচালান, যা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব না— বিএনপি সরকার সেই ঘটনা থেকে পার পেতে চেয়েছিল সামান্য একজন মহিলা মেম্বারের ঘাড়ে ভর করে। বিএনপির শীর্ষনেতৃত্ব যে কতটা স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন, তা বদনীকাণ্ড থেকে আরো একবার প্রমাণিত হয়। বড়-বড় অপরাধ সামাল দিতে গিয়ে বিএনপি বরাবরই ভজকট পাকিয়ে ফেলে। জজ মিয়া ইতিহাসে পাকাপোক্ত স্থান পেয়ে গেলেও বদনী বেগম কখনও অতটা আলোচিত হননি। এটা বদনী বেগমের দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য— বলতে পারছি না।
বদনী বেগম, শৈবাল সাহা পার্থ, মোখলেছুর রহমান, জজ মিয়া— বিএনপির স্থূলবুদ্ধির চার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ক্ষমতায় থাকাকালে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভোগা বিএনপি ভেবেছিল তারা যাচ্ছেতাই করে পার পেয়ে যাবে। কিন্তু ইতিহাস তাদেরকে সেই সুযোগ দেয়নি। একুশে আগস্ট আর জজ মিয়া উড়ন্ত বিএনপিকে আসমান থেকে সপাটে টেনে নামিয়ে ভূপাতিত করেছে। বিএনপি যদি জোঁক হয়, জজ মিয়া লবণ। শরীরে লবণ পড়লে জোঁক যেভাবে মরে নিস্তেজ হয়ে যায়, সেরেফ ‘জজ মিয়া’ নামটা শোনামাত্র বিএনপির সমস্ত নেতাকর্মী সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে নিশ্চুপ হয়ে যায়। জজ মিয়া প্রসঙ্গ তুললেই বিএনপির সমর্থকরা এলোমেলো আচরণ করা শুরু করে দেয়, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে, বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেয় অথবা ‘বাবা আদমের আমল থেকেই যুগে-যুগে জজ মিয়া নাটক মঞ্চস্থ হয়ে আসছে’ বলে স্বীয় দলের ঐতিহাসিক অপরাধকে লঘু করার চেষ্টা করে; কোনোভাবেই স্বীকার করবে না— জজ মিয়ার সাথে বিএনপি অন্যায় করেছে কিংবা একুশে আগস্ট ইশুতে বিএনপির কোনো ধরনের দায় আছে। তাদের বক্তব্য শুনে মনে হবে একুশে আগস্টের গ্রেনেডহামলা ইউরেনাস, নেপচুন বা প্লুটো থেকে আসা এলিয়েনদের কাজ।
যদি সম্ভব হতো, বিশ্বের সমস্ত ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে আগস্টের একুশ তারিখটাকে বিএনপির নেতাকর্মীরা ছিদ্র করে ফেলত। বিএনপির বর্তমান ক্যালেন্ডারে বিশে আগস্ট আছে, বাইশে আগস্ট আছে; একুশে আগস্ট নেই। বিএনপি একুশে আগস্ট থেকে পালাতে চায়; কিন্তু একুশে আগস্ট বিএনপিকে পালাতে দেয় না, দেবে না। অতিপ্রাকৃত জজ মিয়া বিএনপির জন্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গল, বিএনপির কাছে যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এক ‘জজ মিয়া নাটক’-এর কারণেই একুশে আগস্টের অক্টোপাস বিএনপিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। জজ মিয়া নামক অক্টোপাস থেকে বিএনপির মুক্তি নেই, জজভূত বিএনপিকে তাড়া করবেই। ইতিহাসের পাতা থেকে বিএনপি জজ মিয়াকে কখনও গিলতেও পারবে না, ফেলতেও পারবে না।
জজ মিয়া কে, কাদেরকে বা কাকে আড়াল করার জন্য, কেন তাকে একুশে আগস্টের সাথে জড়ানো হয়েছিল এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, এই ধাঁধার সুরাহা না করে, এই ঐতিহাসিক অক্টোপাসকে পাশ কাটিয়ে বিএনপি ভবিষ্যতে কখনোই নিশ্চিন্তে রাজনীতি করতে পারবে না। অমাবস্যা-পূর্ণিমায় নোয়াখালীর জজ মিয়া বিএনপির গিরায়-গিরায় শিরায়-শিরায় মরণপীড়া সৃষ্টি করবেই।