ড: ফারহানা : বিশ্বাস হচ্ছে না? শুনতে খারাপ লাগছে? গা রি রি করছে? লাগুক! কারণ যে সত্যিটা আপনারা লোকলজ্জার ভয়ে কার্পেটের নিচে চাপা দিয়ে রাখেন, সেই সত্যিটা আজ আপনাদের মুখের ওপর ছুঁড়ে মারব।

আপনারা ভাবেন, “বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে” একটা ভালোবাসা-হীন, সম্মান-হীন সম্পর্ক টেনে নিয়ে যাওয়াটা একটা মহৎ আত্মত্যাগ। বাহ! কী দারুণ ভণ্ডামি! আপনারা এটাকে ‘ত্যাগ’ বলেন, আমি বলি ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত একটা খুন। এটা আপনার সন্তানের আত্মার খুন, ওর ভবিষ্যৎ অনুভূতির খুন, ওর সুস্থ সম্পর্কের ধারণার খুন।
আপনারা যে “সুখী পরিবার”-এর নাটকটা রোজ ডাইনিং টেবিলে করেন, দেয়ালের ওপাশে কান পাতলেই সেই নাটকের আসল রূপ বেরিয়ে আসে। আপনাদের চাপা দীর্ঘশ্বাস, দাঁতে দাঁত চেপে বলা অপমান, পরস্পরের প্রতি তীব্র ঘৃণা আর শীতল অবহেলা… ভাবছেন আপনার বাচ্চাটা অবুঝ? ও কিছুই বোঝে না?

ঘোড়ার ডিম বোঝে! আপনার সন্তান আপনাদের নিঃশব্দ ঘৃণা পড়তে শেখে। ও ভালোবাসার প্রথম পাঠ নেয় আপনাদের এই অভিনয়ের সংসার থেকে। ও শেখে যে, ভালোবাসা মানে একসাথে থেকেও একা থাকা। ভালোবাসা মানে, আপোস নয়, আত্মসমর্পণ। ভালোবাসা মানে, একে অপরকে সহ্য করা, সম্মান করা নয়।

এবার আসল কথায় আসি। যে কথাটা শুনলে আপনাদের ‘সুশীল’ সমাজের গায়ে ফোস্কা পড়বে। আপনারা কি জানেন, আপনাদের এই বিষাক্ত দাম্পত্য ওর যৌন জীবনকেও চিরদিনের মতো পঙ্গু করে দিচ্ছে?
হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। যৌনতা । শব্দটা শুনেই চোখ নামিয়ে নিলেন? এটাই তো আপনাদের সমস্যা। আপনারা সেক্স নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পান, কিন্তু একটা সেক্স-বিহীন, ভালোবাসা-বিহীন সম্পর্কের কারাগারে বাচ্চাকে বড় করতে লজ্জা পান না।
ভাবুন তো একবার : যে ছেলেটা তার বাবাকে মায়ের ওপর চিৎকার করতে দেখে, তাকে শারীরিক বা মানসিকভাবে শাসন করতে দেখে, সে বড় হয়ে ভালোবাসার প্রকাশ আর আগ্রাসনের তফাৎ করতে পারবে তো? সে কি তার সঙ্গীর ওপর অধিকার ফলানোকেই পৌরুষ ভাববে না? তার কাছে কি জোর করাটাই ভালোবাসার নামান্তর হয়ে উঠবে না?
যে মেয়েটা তার মাকে সারাজীবন বাবার কাছে দাবিয়ে থাকতে দেখে, অপমান সহ্য করে “সংসার টেকাতে” দেখে, সে কি বড় হয়ে একটা সুস্থ সম্পর্ক চিনতে পারবে? সে কি ভালোবাসার নামে অত্যাচার আর অবহেলাকেই নিজের ভাগ্য বলে মেনে নেবে না? তার কাছে কি শারীরিক ঘনিষ্ঠতা মানে শুধুই পুরুষের চাহিদা মেটানোর একটা দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াবে না?
আপনারা ওদের হাতে তুলে দিচ্ছেন ভালোবাসার এক বিকৃত অভিধান। এই অভিধান দেখে ওরা যখন নিজেদের সম্পর্ক গড়তে যায়, তখন ওরা হয় শিকারী, নয়তো শিকার। ওরা ভালোবাসতে ভয় পায়, প্রতিশ্রুতিতে আতঙ্কিত হয়। intimacy ওদের কাছে একটা অস্বস্তিকর বোঝা মনে হয়। ওদের ভেতরটা একটা শূন্য মরুভূমি হয়ে যায়, যেখানে কোনো অনুভূতি দানা বাঁধে না। ওরা হয়তো একাধিক সম্পর্কে জড়ায়, কিন্তু কোথাও শান্তি পায় না। কারণ, শান্তির নীড় কাকে বলে, সেটা ওরা নিজের বাড়িতেই কোনোদিন দেখেনি।
আপনারা সন্তানের জন্য ভালো স্কুল, ভালো পোশাক, ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু যে মানসিক স্বাস্থ্যের ভিতটাই আপনারা প্রতিদিন একটু একটু করে ভেঙে দিচ্ছেন, তার কী হবে? ভাঙা মন নিয়ে ও কোন ভবিষ্যৎ গড়বে? কার বিছানায় গিয়ে সে আপনাদের দেওয়া শৈশবের ক্ষতগুলোকে ভুলতে চাইবে?
তাই, এবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে শেষ প্রশ্নটা করুন। আপনি আপনার সন্তানের জন্য একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ চান, নাকি নিজের “স্ট্যাটাস” আর “সম্মান” বাঁচানোর জন্য ওর ভেতরটা প্রতিদিন খুন করতে চান?
ভেবে দেখেছেন কি, আপনাদের এই “মহৎ ত্যাগ”-এর দামটা আপনার সন্তানকে তার সারাটা জীবন ধরে, প্রতিটা সম্পর্কে, প্রতিটা রাতে নিজের শরীর আর মন দিয়ে শোধ করতে হবে কিনা?