নিজস্ব প্রতিবেদক : সারা দেশে অফিস আদালতসহ সর্বত্র কর্মচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। তৈরী পোশাক শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের দুই প্রধান সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ ঘোষণা দিয়েছিল একসাথে না খুলে এলাকাভিত্তিক পর্যায়ক্রমে সব কারখানা খোলা হবে। তাদের সে ঘোষণা কার্যকর হয়নি। অনেকটা একযোগে সব কারখানা খুলে ফেলেছেন মালিকরা। বলা হয়েছিল শুধুই নিটিং, ডায়িং ও স্যাম্পল (নমুনা) সেকশন খোলা হবে। বাস্তবে বেশির ভাগ কারখানাতেই কাজ চলছে সব সেকশনে। বলা হয়েছে কেবল কারখানার আশপাশে অবস্থানকারী শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হবে, বর্তমানে অধিকাংশ কারখানায়ই কাজ চলছে পুরোদমে। সমিতির নেতারা সরকারের কাছে কথা দিয়েছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা করে কাজ করানো হবে। বাস্তবে এটা সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য সব ক্ষেত্রেই মালিকপক্ষের অভিযোগের আঙুল শ্রমিকদের দিকে। তাদের দাবি, বাধা উপেক্ষা করে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিচ্ছে। আর শ্রমিকরা বলছেন, চাকরি হারানো আতঙ্কে পেটের দায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজে যোগদান করতে হচ্ছে।
করোনা মোকাবেলার জন্য গত ২৬শে মার্চ থেকে সরকার যে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল তা দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। ৫ মে পর্যন্ত সর্বশেষ পঞ্চম দফায় ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, এই ছুটি শেষ হওয়ার পর কি হবে? নতুন করে কি ছুটি দেয়া হবে নাকি লক ডাউন বা সাধারণ ছুটি তুলে নিয়ে স্বাভাবিক কর্মচাঞ্চল্য শুরু হবে? এখন পর্যন্ত সরকার এই ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি, তবে আজ রবিবার এই নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নেতৃত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
এই বৈঠকে সশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের যোগ দিতে বলা হয়েছে। সম্মিলিতভাবে তাঁরা এই ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হবে নাকি আস্তে আস্তে সীমিত আকারে কাজকর্ম শুরু হবে সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পরে এই সিদ্ধান্ত সুপারিশ আকারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরণের কথা। প্রধানমন্ত্রীই পরবর্তীতে এই ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন। তবে সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে যে, অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্যে সরকার কিছুদিনের জন্য হলেও কিছুদিনের জন্য ছুটি বাড়াতে চাচ্ছে না। বরং ছুটি না বাড়িয়ে কিছু কিছু কর্মচাঞ্চল্যের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাপন ফিরিয়ে আনতে চায়।
এদিকে, গত বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকাসহ এর আশপাশের সাভার, গাজীপুর, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত তৈরী পোশাক কারখানায় খবর নিয়ে এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ কারখানাতেই কাজ চলছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী পোশাকের যে চাহিদা তৈরি হবে তা পূরণে ব্যস্ত বায়িং হাউজগুলোও। তাদের হাতে প্রচুর অর্ডার। ধরতে না পারলে এ অর্ডার চলে যাবে অন্য দেশে। অর্ডার দেয়ার আগে বায়িং হাউজগুলো দেখতে চায় সংশ্লিষ্ট কারখানাটি চালু আছে। ফলে বাধ্য হয়ে অনেক মালিক কারখানা খোলা রেখেছেন।
আশুলিয়ার একটি কারখানার মালিক এ প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের হাতে এখন প্রচুর কাজ। নতুন অর্ডারও আছে। এখন যদি অর্ডার ধরতে না পারি তবে কারখানা বন্ধ করে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। সম্পূর্ণ ঋণের ওপর নির্ভর করে গড়া কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে, করোনা থেকে বেঁচে গেলেও আমি জীবিত থাকতে পারব না। কাজেই বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কারখানা খুলেছি। তিনি বলেন, এমন তো নয় যে আমি ঘরে বসে আছি আর শ্রমিকদের কারখানায় এনেছি! জীবনের ঝুঁকি তো আমারও আছে? আমিও কাজ করছি, শ্রমিকরাও করছে। ওরা মারা গেলে তো আমিও মরব! তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান ধরে রাখতে না পারলে বেঁচে থাকার কোনো মানেই নেই!
প্রায় একই ধরনের মন্তব্য এসেছে শ্রমিকদের পক্ষ থেকেও। রামপুরার একটি কারখানায় অপারেটরের কাজ করেন বরিশালের মেয়ে রোকসানা। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, কাজে এসেছে নিজের গরজে। মালিকরা যতই বলুক চাকরি যাবে না। কারখানা রাখতে না পারলে চাকরি রাখবে কিভাবে! পেটের দায়ে চাকরি করেন জানিয়ে রোকসানা বলেন, কাজ না করলে কি চাকরি থাকবে? আর চাকরি না করলে খাবো কী? করোনার কারণে না খেয়ে বাসায় মরার চেয়ে কাজ করতে করতে কারখানায় মরাই ভালো বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ দিকে বেশির ভাগ কারখানায় ঝুঁকির মধ্যে কাজ চললেও সাভার-আশুলিয়ার কয়েকটি কারখানার মালিকপক্ষ কারখানা চালু করতে চাইলেও শ্রমিকদের অনীহার কারণে সম্ভব হয়নি।
এ ছাড়া ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদ, বকেয়া মজুরি ও লে-অফ করা কারখানা খুলে দেয়াসহ বিভিন্ন দাবিতে সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের বেশ কিছু কারখানার শ্রমিকেরা নিয়মিত বিক্ষোভ করেছেন। যদিও বিজিএমইএ-বিকেএমইএ থেকে বলা হয়েছে, মালিকরা যেন আপাতত কোনো শ্রমিক ছাঁটাই না করেন। বিজিএমইএর অনুরোধ রক্ষা করা অনেক কারখানার পক্ষেই সম্ভব হবে না জানিয়ে চাকরি হারানো আতঙ্কে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন বলে জানা গেছে।
প্রায় সব কারখানায় এবং প্রায় সব শ্রমিককে দিয়ে কাজ করানো প্রসঙ্গে কারখানার মালিকদের দাবি, শ্রমিকরা চাচ্ছে কাজ করতে। কারণ, কাজ না করে সম্পূর্ণ বেতন পাবে এমন আশা তারা করতে পারছে না। এক অংশকে কাজে নিলে অন্যদের চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে। এ কারণে যারা কাজ করতে চায় আমরা সবাইকেই কাজের সুযোগ দিচ্ছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা প্রসঙ্গে তাদের দাবি, বেশির ভাগ কারখানাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে উৎপাদন চালাচ্ছে। তবে কারখানার বাইরে শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা কঠিন। সে জন্য স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি প্রশাসনের সহযোগিতা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিভিন্ন পরামর্শের আলোকে বিজিএমইএ সদস্য কারখানাগুলোর জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করে সেটি মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছে। তাতে কারখানায় প্রবেশের সময় হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, কর্মীদের জুতায় জীবাণুনাশক স্প্রে ও শরীরের তাপমাত্রা মাপতে থার্মোমিটার ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া কারখানার ভেতরে কর্মীদের পরস্পরের কাছ থেকে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা, প্রতিবার টয়লেট ব্যবহারের পর তা জীবাণুমুক্ত করা, প্রতিদিন মেশিন জীবাণুমুক্ত করা, খাবারের সময় শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিতের নির্দেশনা দেয়া হয়। বিকেএমইএ অনুরূপ কিছু নির্দেশনা তাদের সদস্যদের দিয়েছে। যদিও বাস্তবে এগুলো অনেকাংশেই মানা হচ্ছে না। কারখানাগুলোয় কাজ চলছে অনেকটা আগের মতোই। কিছু কারখানা শ্রমিকদের অবস্থানগত দূরত্ব একটু বাড়ালেও বেশির ভাগ কারখানায় তা করা হয়নি। অনেক কারখানায় শ্রমিকদের হাত সেনিটাইজ করা এবং মাস্ক সরবরাহের কাজটিও যথাযথভাবে করছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। গার্মেন্ট শ্রমিকরা রাস্তাঘাটেও চলাফেরা করছে দলবেঁধে। ফলে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েই যাচ্ছে। সেইসাথে বাড়ছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিও।
প্রধানমন্ত্রী এই ব্যাপারে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ এবং সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছেন। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, সামনে ঈদ এবং ঈদের সময় সবকিছু বন্ধ রাখা হলে অর্থনীতির উপর একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একারণেই ঈদকে সামনে রেখে স্বল্প দিনের জন্য সীমিত আকারে আর শর্ত সাপেক্ষে কিছু কিছু অফিস-কারখানা খুলে দেয়া দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন এরকম একজন উর্ধ্বতন চিকিৎসক জানিয়েছেন যে, ছুটি হয়তো থাকবে না, কিন্তু কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে ধাপে ধাপে সরকার স্বাভাবিক কর্মচাঞ্চল্যে ফেরার প্রক্রিয়া নিতে চায়। আর এক্ষেত্রে সরকার যেসব নির্দেশনা দিবে, তাঁর মধ্যে থাকতে পারে-
১. সামাজিক, রাজনৈতিকসহ সকল ধরণের গণজমায়েত বন্ধ থাকবে পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত। যেমন এই রোযার মাঝেই কোন রকম বিধিনিষেধ না থাকলে ইফতার বা সেহেরী পার্টি করতে পারে অনেকে, ঈদ পূনর্মিলনী অনুষ্ঠান ইত্যাদি নানারকম সামাজিক সমাবেশ করতে পারে অনেকে। অনেকে আবার রাজনৈতিক সমাবেশের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারেন এবং রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ডাকতে পারেন। সেগুলো যেন না হয়, সামাজিক দুরত্ব ক্ষতিগ্রস্ত এমন কোন ধরণের পাবলিক গ্যাদারিং বা জনসমাগম পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। যদি ছুটি শেষও হয়, তাহলে এটা হবে সরকারের প্রধান নজরদারির বিষয়।
২. দোকানপাট খোলা থাকলেও সেখানে সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করে কেনাকাটা করে, সে ব্যাপারে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করবে। গণপরিবহন চালু করার ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। কারণ ছুটি শেষ হলে যে শ্রমজীবী, কর্মজীবী মানুষগুলো ঢাকার বাইরে চলে গিয়েছিল তাঁদেরকে ঢাকায় নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে গণপরিবহন চালুর বিকল্প নেই। বরং গণপরিবহন চালু করতে গেলে তা সীমিত আকারে চালু করা হবে এবং সেখানেও যেন সামাজিক দুরত্বটা বজায় রাখা হয়- সেটা নিশ্চিত করা হবে। ঈদ এবং অর্থনীতিকে চালু রাখার জন্য লকারখানাগুলোকে যে ধাপে ধাপে চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে বলে সরকারি নীতিনির্ধারক মহল থেকে আভাস পাওয়া গেছে। সেখানে কারখানাগুলোকে আগে সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে হবে এবং এরপরেই কারখানাগুলো খোলা হবে।
তবে এই ছুটিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদে জামায়াতে নামায পড়াসহ আরো কিছু বিষয়ে বিধিনিষেধ অব্যহত রাখা হবে বলে জানা গেছে। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় কমিটি এবং টেকনিক্যাল কমিটি- দুটো কমিটিই এই ব্যাপারে কাজ করছে। তাঁরা যে সুপারিশ দিবে সেই সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এ প্রসঙ্গে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি শতভাগ মেনে চলা কঠিন। আমরা দেখেছি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চেষ্টা করেও রাজধানীর বাজারগুলোতে সামাজিক দূরত্ব পুরোপুরি নিশ্চিত করতে পারেনি। তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
প্রসঙ্গত, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের ছোবলে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী মারা গেছেন ২ লাখ ৩৯ হাজার ৫৬২ জন। এছাড়া এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৪ লাখ ৮২৯ জন। শনিবার সকাল পৌনে ৯টা পর্যন্ত এ সংখ্যা নিশ্চিত করেছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যা ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটার। এরইমধ্যে ২১০টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়েছে করোনা ভাইরাস। আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১০ লাখ ৮১ হাজার ৫৯৯ জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ২০ লাখ ৭৯ হাজার ৬৩৮ জন। এদের মধ্যে ২০ লাখ ২৮ হাজার ২৮৩ জনের শরীরে মৃদু সংক্রমণ থাকলেও ৫১ হাজার ৩৫৫ জনের অবস্থা গুরুতর।