*আগামী ১৪ দিন কঠিন সময়
*নতুন আক্রান্ত ৫৫২
*মৃত্যু বেড়ে ১৭৫
মহসীন আহমেদ স্বপন : দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। সে মাসে মোট শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৫১ জন। এপ্রিলে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় সাত হাজার ৬১৬ জনে। গত কয়েক দিনে প্রতিদিনই নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে চার-পাঁচশ বা তারও বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদিন যে হারে পরীক্ষা হচ্ছে সেটাও যথেষ্ট নয় এবং এটা পুরো দেশের চিত্রও নয়। এখনও দেশ সংক্রমণের চূড়ায় নয়। পরীক্ষা সংখ্যা বাড়ালে এবং সাধারণ ছুটি শিথিল করে আনা হলে মে মাসে অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ১৪ দিন কঠিন সময়। তাই ভীষণ সতর্কতা নিয়ে পরিকল্পিতভাবে পার করতে হবে। যদি সেটা না হয় তাহলে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যু এবং রোগী দুটোই দেখা যাবে মে মাসে।
গত ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ৮ এপ্রিল পর্যন্ত এক মাসে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ২১৮ জন। এরপর রোগী বাড়তে থাকে। ১৮ এপ্রিল রোগী শনাক্ত হয় ৩০৬ জন। এরপর সংখ্যা শুধুই বেড়েছে। ২০ এপ্রিল ৪৯২ জন, ২৪ এপ্রিল ৫০৩ জন, ২৮ এপ্রিল ৫৪৯ জন এবং গত ২৯ এপ্রিল ৬৪১ জন। ৩০ এপ্রিল শনাক্ত হওয়া রোগী সংখ্যা তার আগের দিনের চেয়ে কমে দাঁড়িয়েছিল ছিল ৫৬৪ জন। ১ মে ৫৭১ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫৫২ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে সর্বমোট করোনা রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৮ হাজার ৭৯০। এছাড়া নতুন করে মারা গেছেন আরও ৫ জন। যাদের ৩ জন পুরুষ এবং ২ জন নারী। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন আরও ৩ জন। এ নিয়ে মোট সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ১৭৭ জন।
স্থাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে জানান, আগামী ৩১ মে পর্যন্ত ৪৮ হাজার থেকে ৫০ হাজার মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন এবং মারা যেতে পারেন ৮০০ থেকে এক হাজার মানুষ। গত ২১ এপ্রিল করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও প্রতিকারে গৃহীত কার্যক্রম পর্যালোচনা এবং পরবর্তী করণীয় বিষয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভায় তিনি এ তথ্য জানান।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, কোনও মডেলিংই প্রকৃতপক্ষে বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। কিন্তু মডেলিং করা হয় প্রস্তুতিতে সাহায্য করার জন্য। তবে মে মাসের মাঝামাঝিতে করোনার ‘পিক টাইম’ দেখা দিতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ডা. আলমগীর।
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুতে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) কোভিড-১৯-এর নমুনা পরীক্ষা করা হলেও বর্তমানে দেশে পরীক্ষা হচ্ছে ২৮টি ল্যাবরেটরিতে। এরমধ্যে রাজধানী ঢাকায় ১২টি ও ঢাকার বাইরে ১৬টি প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি তিনটি হাসপাতালকে করোনা পরীক্ষার জন্য অনুমতি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। যদিও এই হাসপাতালগুলো কেবল তাদের ভর্তি হওয়া রোগীদের পরীক্ষা করাতে পারবে।
সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইন (এসইউটিডি)-এর ডেটা ড্রাইভেন ইনোভেশন ল্যাবের গবেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, মে মাসে বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ ৯৯ শতাংশ কমে যেতে পারে। তবে বাংলাদেশ থেকে ভাইরাসটির পুরোপুরি বিদায় নিতে সময় লাগতে পারে ১৫ জুলাই পর্যন্ত। আর সারা বিশ্ব থেকে করোনা পুরোপুরি বিদায় নিতে পারে ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে। যদিও এর সঙ্গে একমত নন বাংলাদেশি চিকিৎসকরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘লকডাউন শিথিল করলে রোগী সংখ্যা বেড়ে যাবে। কিন্তু লকডাউন লম্বা করে দেয়া হলে কেসগুলোকে সেটেল ডাউন করে ডিলে করে দেয়া হবে। এভাবে যদি ডিলে করে দেয়া হয় তাহলে আর সংক্রমণের চূড়ায় না যাওয়া হলেও এ পরিস্থিতি চলতে থাকবে।’ সিঙ্গাপুরের দেয়া তথ্যের সঙ্গে একমত নন অধ্যাপক রোবেদ আমিন।
দেশের ২৮টি জায়গায় নমুনা পরীক্ষা হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চল, উপজেলা এবং অনেক জেলায়ও পরীক্ষা করানো যাচ্ছে না মন্তব্য করে অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, তাহলে পুরো দেশের চিত্র তো এখনও আমরা পাচ্ছি না। বাংলাদেশে আসলে মোট কতজন আক্রান্ত সেটা এখনও আমরা জানি না। কেবল পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে একটা অঙ্ক করে যাওয়া হচ্ছে।
চীনের উহানের চেয়ে ঢাকার অবস্থা খারাপ মনে হচ্ছে’ মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, মানুষ লকডাউন মানছে না। ঢাকা শহরের সংক্রমিত মানুষের হার এর সঙ্গে মেলালেই সেটা বোঝা যায়।
চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক আতিক আহসান বলেন, মে মাস আমাদের জন্য ভালো কিছু আনবে না। খারাপ যা হতে পারে সেটা মে মাসের মধ্যেই দেখবো। এর পরে ধীরে ধীরে রোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করবে।
তিনি বলেন, সারা দেশে রোগী ছড়িয়েছে এবং সবাইকে শনাক্ত করা যায়নি। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে রোগী বাড়বে একথা আগেই বলা হয়েছিল। সে অনুযায়ী মধ্য এপ্রিল থেকেই রোগী বাড়তে থাকে। আর অন্যান্য দেশের ট্রেন্ড বলছে, রোগী বাড়তে শুরু করলে সেটা ৩০ দিন পর্যন্ত বেড়েই যায়, তবে আমাদের দেশে এই ৩০ দিনের সঙ্গে অন্য রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে সাধারণ ছুটি শিথিল, পোশাক কারখানা এবং রেস্টুরেন্ট খুলে দেওয়ার কারণে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ সর্বোচ্চ রোগী বা পিক টাইমটা দেখা যাবে। সেটা রোগী শনাক্ত এবং মৃত্যু-দুই ক্ষেত্রেই। তাই মে মাস আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর। তবে আশার কথা, তার পরের মাস থেকেই রোগী কমতে শুরু করবে।
বর্তমানে যেভাবে রোগী প্রতিদিন রিপোর্ট হচ্ছে তাতে সংক্রমণটা নিয়ন্ত্রণে নেই মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বলেন, বর্তমানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ব্যবস্থা রয়েছে সেটা যথেষ্ট নয়। লকডাউন যদি ধীরে ধীরে তুলে নেয়া হয় তাহলে সংক্রমণ বাড়বে এবং বাড়তেই থাকবে। পুরো মে মাসেই সংক্রমণ হতেই থাকবে।
বিশ্বব্যাপী মহামারি রূপ নেয়া করোনাভাইরাসে প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। বাংলাদেশেও আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও ৫৫২ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৮ হাজার ৭৯০ জনে। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১৭৫ জনে।
করোনা ভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অনলাইন বুলেটিনে শনিবার দুপুরে এ তথ্য জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।
তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ৬ হাজার ১৯৩ জনের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে ৫ হাজার ৮২৭ জনের। এ নিয়ে সর্বমোট পরীক্ষা করা হয়েছে ৭৬০৬৬টি নমুন। গত ২৪ ঘণ্টায় ৫৫২ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে সর্বমোট করোনা রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৮ হাজার ৭৯০। এছাড়া নতুন করে মারা গেছেন আরও ৫ জন। যাদের ৩ জন পুরুষ এবং ২ জন নারী। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন আরও ৩ জন। এ নিয়ে মোট সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ১৭৭ জন।
ডিসেম্বরে প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে বেশিরভাগ দেশই ভাইরাসটিতে তেমন পাত্তা দেয়নি। অনেক দেশই ধারণা করেছিল, এটি চীনা ভাইরাস এবং এর সংক্রমণ হয়তো ইউরোপ-আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়বে না। এজন্য সেখানকার দেশগুলো তেমন কোনো পদক্ষেপও নেয়নি। ফলও দিতে হচ্ছে তাদের। কারণ সংক্রমণ সংখ্যার দিক থেকে প্রথম দেশগুলোর তালিকার মাঝেই নেই চীন।
বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হলে বাড়ানো হয় সতর্কতা। ভাইরাসটি যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য মার্চেই ব্যবস্থা নেয় বাংলাদেশ সরকার। বন্ধ ঘোষণা করা হয় সব সরকারি-বেসরকারি অফিস। পঞ্চম দফায় সেই ছুটি বাড়ানো হয়েছে আগামী ৫ মে পর্যন্ত।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের পদক্ষেপ অনেকটা এ রকমই। তবে এর মাঝেও কিছু কিছু দেশ তাদের দেয়া লকডাউন কিছুটা শিথিল করছে। স্পেন, জার্মানি ও ভারত সেই পথে হেঁটেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালিও তেমনটাই ভাবছে।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যা ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটার তথ্যানুযায়ী শনিবার সকাল পৌনে ৯টা পর্যন্ত মহামারি করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২ লাখ ৩৯ হাজার ৫৬২ জন। এছাড়া এ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ৩৪ লাখ ৮২৯ জনের শরীরে। এরইমধ্যে ২১০টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়েছে করোনা ভাইরাস।
আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১০ লাখ ৮১ হাজার ৫৯৯ জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ২০ লাখ ৭৯ হাজার ৬৩৮ জন। এদের মধ্যে ২০ লাখ ২৮ হাজার ২৮৩ জনের শরীরে মৃদু সংক্রমণ থাকলেও ৫১ হাজার ৩৫৫ জনের অবস্থা গুরুতর।