আড়াই’শ বাংলাদেশী বন্দি থাকার তথ্য

অপরাধ আইন ও আদালত

লিবিয়ায় মানবপাচার চক্রের ৫০ টর্চার সেল

 

 
নিজস্ব প্রতিবেদক: মানবপাচারকারী চক্রের লিবিয়ার বেনগাজীতে প্রায় অর্ধশত টর্চারসেলের সন্ধান পেয়ে গোয়েন্দারা। এসব টর্চারসেলে বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের লোকজন নিয়ে আটকের পর নির্যাতন চালিয়ে লাখ লাখ টাকা আদায় করা হচ্ছে। তারই একটি টর্চারসেলে নির্যাতনের পর টাকা আদায় করতে গিয়েই গত ২৮ মে ২৬ বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
জানা গেছে, লিবিয়ার ২৬ বাংলাদেশীকে হত্যার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যদের খোঁজে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে মাঠে নামে। আর ওই মানবপাচার ও হত্যাকা-ের ঘটনায় দেশের বিভিন্ন তানায় বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই মামলায় পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব, সিআইডি ও গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয় অন্তত দেড় ডজনেরও বেশি মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত পাচারকারীদের জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে, লিবিয়ার বেনগাজীসহ বিভিন্ন শহরে পায় ১০টি ক্যাম্পে অন্তত আড়াইশ শ্রমিক আটককে আটক রাখা হয়েছে।
পুলিশ সদরদপ্তরে এক সুত্র জানায়, লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের বিভিন্ন টর্চারসেলে বাংলাদেশী বন্দী শ্রমিকদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে উদ্বারের চেষ্টা করা হচ্ছে।
গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র জানায়, মানবপাচার করতে লিবিয়ায় নোয়াখালীর কাজী ইসমাইলের নেতৃত্বে ৪৫ জনের একটি বাংলাদেশি দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে। তাদের মালিকানাধীন লিবিয়ার বেনগাজীর বিভিন্ন শহরে প্রায় ২২টি নির্যাতন ক্যাম্প বা টর্চারসের রয়েছে। আর দেশের ভেতরে ১১টি অঞ্চলে ভাগ হয়ে দালাল চক্রটি চারটি আন্তর্জাতিক রুট ব্যবহার করে ইউরোপে মানবপাচার করে আসছে। লিবিয়ার মিসদাহ মরুভূমিতে ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যার ঘটনায় ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি।
এরপর বেশ কয়েকজনকে মানবপাচারে জড়িতদের গ্রেফতারের পর নির্যাতন ক্যাম্পের সন্ধান পায় পুলিশ। পরে আরও কয়েকজন পাচারকারীকে গ্রেফতারের পর গোয়েন্দারা জানতে পারে লিবিয়ার বেনগাজীতে প্রায় ৫০টি নির্যাতন ক্যাম্প রয়েছে। বাংলাদেশের পাচারকারীচক্র এই ক্যাম্পগুলো পরিচালনা করছে। এই চক্রের অর্ধশত সদস্য বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানবপাচার করছে।
এর আগে গোয়েন্দা পুলিশ মানবপাচারকারীদের অন্যতম ৬জনকে গ্রেফতার করেছিল। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, জাহাঙ্গীর মিয়া, আকবর আলী, বাদশা মিয়া, সুজন, নাজমুল হাসান ও লিয়াকত শেখ ওরফে লিপু। এ সময় তাদের হেফাজত হতে চারটি পাসপোর্ট, দুইটি মোবাইল ফোন ও টাকার হিসাব সম্মলিত দুইটি নোটবুক উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার পাচারকারীদের কয়েকজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। সম্প্রতি সিআইডি পুলিশের হাতে ওই মানবপাচারকারীচক্রের আরও চার সদস্যকে গ্রেফতার রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম মানবপাচারকারী চক্রকে ধরতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে আসছে। আর গ্রেফতারকৃত কয়েকজনের স্বীকারোক্তি ও ডিবির তদন্তে অনেক গোপন তথ্য বেরিয়ে আসছে।
অপরদিকে লিবিয়ার বেনগাজীসহ বিভিন্ন শহরে ১০টি ক্যাম্পে আড়াইশ শ্রমিক আটক থাকার তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। আর সেখানে আটককৃতদের অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা চলছে। গোয়েন্দারা এখন পাচারকারী দেশীয় চক্রের পলাতকদেরকে ধরতে অভিযান চারিয়ে আসছে। প্রায় অর্ধশত মানবপাচারকারী গোয়েন্দা জালে রয়েছে বলে জানা গেছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, লিবিয়ার বিভিন্ন এস্টেটে কাজ ও লিবিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশি দালালরা অন-অ্যারাইভাল ও ট্যুরিস্ট ভিসার মাধ্যমে লোকজনকে লিবিয়ায় পাচার করে। আর পাচারের পর ভিকটিমদের লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক রেখে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করে। ভিকটিমদের কান্নাকাটি, আকুতি-মিনতি করা অডিও অথবা সরাসরি মোবাইলে কথাবর্তা বাংলাদেশে অবস্থানরত ভিকটিমদের স্বজনদের পাঠিয়ে অর্থ আদায় করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, লিবিয়াতে যে মিলিশিয়া গ্রুপ আছে তাদের সহযোগিতায় এ ক্যাম্পগুলো চালায় তারা। বাংলাদেশ থেকে অর্থের বিষয়ে একটা লেনদেন তৈরি করে থাকে। সেই বিষয়টি গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছে। এছাড়া, এই মানবপাচারে যারা জড়িত এবং যারা ইতোমধ্যে লিবিয়াতে অবস্থান করছে এবং লিবিয়া থেকে যারা এই অর্থের লেনদেন করে তাদের ধরার জন্য আইনী প্রক্রিয়ায় চেষ্টা করা হচ্ছে। এরআগে ২৬বাংলাদেশিকে হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশে ভিকটিমদের আত্মীয়-স্বজন মাদারীপুর রাজৈর থানা, কিশোরগঞ্জের ভৈরব থানায় মানবপাচার বিরোধী আইনে দুটি মামলা হয়। এরপর দেশের বিভিন্ন থানায় আরও কয়েকটি মামলা করেন নিহতদের স্বজনেরা। শুধু তাই নয়, র‌্যাব-৩ এর গোয়েন্দারা ছায়া তদন্ত করে নিশ্চিত হবার পর মানবপাচারের সাথে জড়িত চক্রটির অন্যতম হোতা কামাল হোসেন ওরফে হাজি কামালকে রাজধানীর গুলশান শাহজাদপুর থেকে গ্রেফতার করে। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন।
র‌্যাব সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃত কামাল হোসেন ওরফে হাজি কামাল মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর যাবত এই মানবপাাচরের মত অপরাধ করে আসছে। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর প্রার্থমিক জিজ্ঞাসাবাদের মানবপাচারের সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্রটি বিদেশি চক্রের যোগসাজসে অবৈধভাবে বাংলাদেশি নাগরিকদের বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করে আসছিল। চক্রটি তিনটি ধাপে মানবপাচারের কাজ সম্পন্ন করত। চক্রের দেশীয় এজেন্টরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষদের অল্প খরচে উন্নত দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করে থাকে। আর ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অনেকেই তাদের প্রস্তাবে সাড়া দেয়। ইচ্ছুকদের বিদেশে গমনের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকেট ক্রয়- প্রভৃতি কার‌্যাবলী এই সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়ে থাকে। পরবর্তীতে তাদের এককালীন বা ধাপে ধাপে কিস্তি নির্ধারণ করে ইউরোপের পথে পাড়ি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।


বিজ্ঞাপন