রং তুলিতে আঁকা আহমিদার স্বপ্ন

অন্যান্য জীবন-যাপন বিবিধ

বনি আমিন খান : আহমিদা ইসলাম নূর। বয়স ১২ বছর। এক ভাই, এক বোন, বাবা-মা আর দাদি কে নিয়ে পাঁচ জনের টানাপোড়নের সংসার। ঢাকা শহরের পশ্চিম নন্দিপাড়া ১নং মাদ্রাসা রোডের বস্তির ছোট একটি রুমে আহমিদা তার পরিবারের সাথে খুব কষ্টে দিনাতিপাত করে। খুবই শান্ত স্বভাবের মিষ্টি একটি মেয়ে আহমিদা। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে আহমিদা। চোখে-মুখে মলিনতার ছাপ কিন্তু তবুও আহমিদা স্বপ্ন দেখতে ভূলেনা। সে সকল বাধা অতিক্রম করে সাফল্যের চূড়ায় জয়ের পতাকা উড্ডয়ন করতে চায়। সে একজন ভাল গায়ক হতে চায়। দৈনন্দিন এই স্বপ্নকে কল্পনার রং তুলিতে এঁেক ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে আহমিদা।


বিজ্ঞাপন

নরসিংদি জেলার রায়পুরা থানার জাহাঙ্গীর নগর গ্রামে বাবা-মা, ভাই বোনের সাথে বাস করতেন আহমিদার মা কোহিনূর বেগম। কোহিনুর বেগমের বড় বোন শাহীনূর আক্তার। শাহিনুর পেশায় ছিলেন শিক্ষক। সুনামগঞ্জ জেলার মঙ্গলকাটা হাই স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করতেন। একই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন আমিনুল ইসলাম নামের এক যুবক। যিনি আহমিদার বাবা। আহমিদার বাবা আমিনুল একদিন কোহিনুরকে স্কুল প্রাঙ্গণে তার বোন শাহীনুরের সাথে দেখতে পায় এবং তাকে তার মনে ধরে। তিনি কোহিনুরকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। শাহীনুরের সাথে একই স্কুলে চাকুরির সূত্র ধরে আমিনুল ইসলাম বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার সুযোগ পায়। তাই সুযোগ বুঝে আমিনুল মিথ্যা সম্পদের গল্প বলে-ঢাকা শহরে বাড়ি আছে, গ্রামের বাড়িতে সম্পদ আছে ইত্যাদি বানোয়াট কথা বলে পাত্রী পক্ষকে ধু¤্রজালের মধ্যে ফেলে কোহিনূরকে বিয়ে করতে সফল হয়।

বিয়ের পর আমিনুলের আসল চিত্র ফুটে উঠে আহমিদার মা কোহিনুরের কাছে। সে চোখে মুখে ধোঁয়াসা দেখতে লাগলেন। আসলে বাস্তবে আমিনুল ইসলামের কোন সম্পদ ছিলনা। যাক তবুও স্বামী। কোহনুর মেনে নিয়ে স্বামীর ভালবাসায় সিক্ত হয়ে সুখেই দিনকাল কাটাচ্ছিল। শিক্ষকতা করে মোটামুটি ভালো ভাবে সংসার চলছিল আমিনুল-কোহিনূরের। এক মেয়ে, ছেলে আর শাশুড়িকে নিয়ে সুনামগঞ্জে মঙ্গলকাটায় একটি বাসায় বাস করতো কোহিনূর। আহমিদা তখন মঙ্গলকাটায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২য় শ্রেণীতে আর আহমিদার ভাই কৌশিক ৩য় শ্রেণীতে পড়ে। আহমিদা ভালো ছবি আঁকে, গান গায়, পড়ালেখায় খুব মনোযোগী।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সুখ বুঝি বেশি দিন কপালে সয়না। ২০১৬ সালে আহমিদার বাবা আমিনুল এক ষড়যন্ত্রের শিকার হন। জানুয়ারি’২০১৬ সালের স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তির টাকা স্কুল কমিটির সভাপতির হাতে তুলে না দেওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে টাকা আতœসাধ করার মিথ্যা অপবাদ এনে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি আমিনুল ইসলামকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করে।

চাকুরীই ছিল তাদের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। চাকুরি চলে যাবার পর থমকে যায় গোটা পরিবার। আহমিদা ও তার ভাইয়ের শিক্ষা জীবন মুহুর্তেই শুকনো পাতার মর্মর শব্দের মতো ঝরেপড়ে, বাধা গ্রস্থ হয় সামনে এগিয়ে চলার নির্ভেজাল স্বপ্ন। আহমিদার রং নেই, ড্রইং খাতা নেই, স্কুলে লেখার খাতা কলম নেই, ঠিকমত তিনবেলা খাবার নেই। সব মিলিয়ে হতাশাগ্রস্থ আমিনুল সিদ্ধান্ত নেয় ধুকে ধকে মরার চেয়ে বাঁচার মতো বাচঁতে হলে টাকা উপার্জনের জন্য পাড়ি জমাতে হবে ঢাকা। যেই কথা সেই কাজ ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে কাজের সন্ধানে পাড়ি জমান রাজধানী শহর ঢাকায়।

শুরু হয় নতুন উদ্দ্যমে নতুন করে বাচাঁর লড়াই। নন্দিপাড়া ১নং মাদ্রাসা রোডে আমিনুল ইসলাম এর বড় ভাই তাকে একটি রুম দেন থাকার জন্য। আমিনুল ইসলাম টিউশনি করে আর কহিনূর ইসলাম সেলাই কাজ করে পাঁচ জনের পরিবারকে নিয়ে কোন রকম টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে। ঢাকায় এসেও আহমিদার ৬ মাস পড়ালেখা বন্ধ থাকে। আর কৌশিককে একটি আবাসিক এতিমখানায় ভর্তি করে দেওয়া হয়। জুলাই-২০১৬ সালে আহমিদাকে তার মা মাদারটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২য় শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। বাসা থেকে স্কুলটি ১.৫ কিলোমিটার দূর হওয়ায় আহমিদা একা আসা যাওয়া করা কষ্ট সাধ্য ছিল। তাই তিন মাস পর আবারো আহমিদার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। আশে পাশে কিন্ডার গার্টেন ও প্রাইভেট স্কুল থাকলেও টাকার অভাবে আহমিদাকে কোথাও ভর্তি করা সম্ভব হয়নি।
আহমিদা বাসায় থাকে আর মায়ের সেলাইয়ের কাজে সহযোগিতা করে। আর চোখে মুখে স্বপ্ন লালন করে যে, সে মায়ের সাথে সেলাই করে মাটির ব্যাংকে টাকা জমিয়ে স্কুলে ভর্তি হবে আর গান শিখবে।

২০১৭ সালের জানুয়ারী মাসে শিক্ষক আকলিমা কোহিনূর আক্তারের সাথে কথা বলেন। সেকেন্ড চান্স এডুকেশন (পাইলট) প্রোগ্রাম এর জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন এর অধীনে পরিচালিত নন্দিপাড়া ১নং রোড আশার আলো শিশু শিখন কেন্দ্রের কথা জানান। শিক্ষক বলেন, ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের জন্য এই স্কুল। এ স্কুলে আহমিদার প্রতিভাকে মূল্যায়ন করা হবে। আহমিদা পড়ালেখার পাশাপাশি আপনাকে সেলাই কাজে সহযোগিতা করতে পারবে। আশার আলো স্কুলের কথা শুনে কোহিনূরের চোখে পানি জমে যায়। তিনি বলেন, এই আশার আলো স্কুল আহমিদার জীবনে আশার ফুল ফুটাবে। আহমিদা আশার আলো স্কুলে ২য় শ্রেণী/সবুজ দলে ভর্তি হয়। আহমিদা পড়ালেখার খুব ভালো। ক্লাসের সবাই আহমিদাকে পছন্দ করে। আহমিদা খুব সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকে। আহমিদা আশার আলো স্কুলে পড়ালেখা করে আর “লিনাস বিউটি পার্লারে” বিকাল ৩.০০ টা থেকে রাত ৮.০০ টা পর্যন্ত কাজ করে মাসিক ১,৫০০/- টাকা আয় করে পরিবারকে সহযোগিতা করে।

আহমিদা সকালে আশার আলো স্কুলে পড়ালেখা করে আর বিকালে পার্লারে কাজ করে। এভাবে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আহমিদা ৪র্থ শ্রেণি/ গোলাপী দল উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো অধীনে জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন কর্তক পরিচালিত স্কুলে প্রতিযোগিতামূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সফলতার সাথে অধ্যায়ন করেছে। ছবি আঁকায় সে খুবই পারদর্শী। নিজের কন্ঠে সুন্দও গান করাসহ আরো অনেক গুণে গুণাম্বিত। তার এতো গুণ দেখে সি.এম.সি সভাপতি নুরুল হক নন্দিপাড়া ১নং রোড উইজডম কিন্ডার গার্ডেন ০১/০১/২০২০ তারিখে মূলশ্রোত ধারায় পদার্পনের লক্ষ্যে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। উইজডম কিন্ডারগার্টেন তাকে বিনা বেতনে পড়ালেখার করার জন্য সুযোগ করে দেন।

আহমিদা এখন অনেক খুশি। তার মুখে এখন আর মলিনতা নেই। সে এখন নিজেই নিজের দায়িত্ব নিতে শিখেছে। সে বড় হয়ে তার স্বপ্œ পূরণের মধ্য দিয়ে বাবা-মাকে সহযোগিতা করে ধন্য হতে চায়। আহমিদার মা কোহিনুর বেগম তার মেয়ের ধাপে ধাপে সফলতা অর্জনের পিছনে জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। তিনি বলেছেন, ‘‘ উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকলে আমার আহমিদার জীবনের আলো নিভে যেত। এই স্কুল থেকে পড়ালেখা করে অনেক বড় হওয়া যায়। এই স্কুল আমার মেয়েকে কাজের ফাঁকে পড়ালেখার সুযোগ করে দিয়েছে। আর আমার মেয়েকে প্রতিভাকে মূল্যায়ন করেছে’’।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এর অর্থায়নে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো’র সরাসরি তত্ত্বাবধানে জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন তার সহযোগী সংস্থা- সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা (সাস) ও এসোসিয়েশন ফর ডেভেলপমেন্ট এন্ড সোশ্যাল ওয়ার্ক (এডিএস) কে সাথে নিয়ে স্কুল থেকে ঝরেপড়া এবং কখনোই স্কুলে পড়েনি এমন শিক্ষার্থীদের নিয়ে ঢাকা, সিলেট ও গাইবান্ধা জেলায় ত্রিশ হাজার শিক্ষার্থীকে ১হাজার শিখন কেন্দ্রের মাধ্যমে এবিএএল পদ্ধতির পাঠদান দিয়ে আসছে। স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং শিক্ষায় ঝড়ে পড়ার হার কমানোসহ মেয়েরা যাতে সমমর্যাদা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন।

সেন্টার ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি জনাব নূরুল হক (ব্যবসায়ী) মন্তব্য করেন, ‘‘আহমিদা একটি মিষ্টি মেয়ে। সে বহু গুণে গুণাম্বিত। তার ভবিষ্যৎ যেন উজ্জ্বল হয়, সে জন্য আমি সাধ্যমত তার খোঁজ-খবর রাখব। পড়া লেখা প্রতিটি শিশুর অধিকার। তার স্¦প্ন পূরণে আমাদের সকলের সম্মিলিত ভাবে কাজ করা জরুরী।

শেষ কথা: জীবনে চলার পথে শত বাধা বিপত্তি থাকবেই কিন্তু এইসব বাধা কখনো প্রকৃত মেধাকে লুকিয়ে রাখতে পারবে না। সুপ্ত প্রতিভা একদিন জাগ্রত হয়ে আলো ছিনিয়ে আনবেই। দেশের কল্যাণে এইসব সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করে দেশ গড়ার কারিগর তৈরী করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক : ডকুমেন্টেশন অফিসার, এসসিই প্রোগ্রাম, জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন।