লকডাউনের দ্বিতীয় দিন
নিজস্ব প্রতিবেদক : সারাদেশে দ্বিতীয় দিনের লকডাউন ছিল মঙ্গলবার। এসময়ে জনসমাগম এড়াতে বন্ধ ছিল রাজধানীসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোর শপিংমল ও দোকানপাট। ফলে সাধারণ মানুষসহ কিছু সংখক ব্যবসায়ীকে পড়তে হচ্ছে বিপাকে। গত কয়েকদিন ধরেই এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন রাজধানী ও তার আশেপাশের মার্কেটগুলোর ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা।
গত রোববার সকাল থেকেই লকডাউনে দোকান খুলে দিতে গাউসিয়া-নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা বিক্ষোভ করেছেন। মঙ্গলবার সকালেও একই দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন রাজধানীর নিউমার্কেট ও মিরপুরসহ একাধিক এলাকার ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, গতকাল বিক্ষোভকারীরা গাউছিয়া ও এর আশপাশ এলাকায় ছোট ছোট জটলা করে অপেক্ষা করছিলেন গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘোষণা শোনার জন্য। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দোকানপাট খোলা রাখার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত পায়নি বিক্ষোভকারীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই বাজারে বহু টাকার ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে তারা কাপড়-চোপড় আমদানি করে বিক্রি করেন। কিন্তু তারা কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। গত বছরেও করোনার কারণে তাদের ব্যবসায় ধস নামে। এ বছর এমন হলে তারা আর টিকতে পারবেন না।
এদিকে, মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরের পাশে বেলা ১১টার দিকে শতাধিক ব্যবসায়ী ব্যানার হাতে নিয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করছেন। তাদের দাবি, লকডাউনে যেন স্বল্প পরিসরে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার জন্য হলেও দোকানপাট খুলে দেওয়া হয়।
মানববন্ধনে অংশ নেওয়াদের মধ্যে একজন বলেন, আমরা পরিবার নিয়ে কীভাবে বাঁচবো। দোকান বন্ধ রাখলে তো উপার্জনের পথও বন্ধ। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ যেন স্বল্প পরিসরে হলেও দোকান খুলে দেওয়া হয়।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কাওরানবাজার ও তেজগাঁওয়ে ট্রাক সেলের সামনে গিয়ে দেখা যায় টিসিবির ট্রাক সেলে নেই স্বাস্থ্যবিধি। এসময় ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। তবে অনেক ক্রেতার মুখে এসময় মাস্ক ছিলো না। একেক জনের মধ্যে কোনো দূরত্ব নেই।
এবিষয়ে তেজগাঁওয়ের ট্রাকসেলের ডিলার মনির জানান, বহুবার বলার পরও এই অবস্থা। সবাই সবার তাড়া দেখাচ্ছে। যদিও সোমবার মন্ত্রীপরিষদ সচিব জানিয়েছেন, এটা লকডাউন নয়, কঠোর নিষেধাজ্ঞা।
দেখা গেছে, রাজধানীতে গণপরিবহন বন্ধ। তবুও সড়কে গাড়ির চাপ ছিল চোখে পরার মতো। গতদিনের তুলনায় রাজধানীর সড়কগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ ছিল তীব্র। ফলে অনেক সড়কের মোড়ে দেখা দেয় যানজট। আর ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা ছিলেন গাড়ির জট নিয়ন্ত্রণের ভূমিকায়। সড়কে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে প্রাইভেটকার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও রিকশা।
মঙ্গলবার সকাল থেকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, আসাদগেট, ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার ঘুরে দেখা গেছে, সরকারের বিধি-নিষেধ সত্ত্বেও অবাধে চলছে ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, অ্যাপেচালিত মোটরসাইকেল ও রিকশা। যদিও সরকারের নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী অ্যাপে চালিত মোটরসাইকেল বন্ধ রাখা হয়েছে তবুও রাস্তা থেকে ডেকে যাত্রী তুলছেন এসব বাইকাররা।
গণপরিবহন না থাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা গণপরিবহনের ভূমিকা পালন করছে। একাধিক যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে এসব বাহনে। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে ৪ থেকে ৫ জন যাত্রী তুলে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটছেনে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকরা। ফলে নিজস্ব পরিবহন ও অটোরিকশার কারণে অতিরিক্ত যানজট দেখা গেছে। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কুড়িল বিশ্বরোড থেকে লা মেরিয়ান এলাকায় প্রচ- যানজট দেখা যায়।
আবদুল জব্বার নামে এক জন জানান, বেলা ১১টায় তিনি কুড়িল বিশ্বরোড থেকে অটোরিকশায় ওঠেন। কিন্তু নতুন বাজার পৌছতে তার বেলা ১টা বেজে যায়। সিএনজিচালিত অটোরিকশার যাত্রীদের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, আমরা পরিস্থিতির শিকার। আমাদের তো অফিসে যেতে হবে। এদিকে রাস্তায় কোনো গণপরিবহন নেই। এখন আমরা কী করতে পারি। আমাদের এক প্রকার বাধ্য হয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চলাচল করতে হচ্ছে।
অ্যাপচালিত বাইকাররা বলেন, আমাদের তো পরিবার আছে। আমরা কী করব। রাস্তায় বের হলেই প্রতিটা যায়গায় পুলিশ ধরছে। চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার মামলা দিচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের কী খাওয়াবো? কেমন করে চলবে আমাদের পরিবার। কিভাবে বাসা ভাড়া দেব? সরকার যদি আমাদের দায়িত্ব নেয়, তাহলে আমরা সরকারের দেয়া কঠোর নির্দেশনা মেনে নেব। এমনকি ঘরের বাইরেও বের হব না।
এদিকে অবাধে চলছে ফুটপাতের দোকানগুলো। ক্রেতাদের ভিড়ও ছিল লক্ষণীয়। তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, আমরা কী করব। আমাদেরও তো সংসার আছে। গতবছরের লকডাউনে প্রচুর ক্ষতি হয়েছে আমাদের। দেনার দায়ে ডুবে আছি। এবারের লকডাউনে আমাদের বেঁচাবিক্রি একদমই কমে গেছে। কিভাবে দেনা শোধ করবো। কিভাবে পরিবারকে নিয়ে বেঁচে থাকব আমরা।
গণমাধ্যম কর্মী রাশেদ খান মিলন সকালের সময়কে জানান, গত দু’দিনে রাজধানীর চিত্র দেখে মনে হয় না যে দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। লকডাউনের কথা জেনেও অনেকে মানছেন না। যে যার মতো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাজধানীর অলিগলি রাজপথে।
দেখা গেছে, সকাল থেকে রাজধানীর রামপুরা বাড্ডা আবুল হোটেল ও কাকরাইল এলাকা যানজটে পরিপূর্ণ ছিল। সাধারণ মানুষের ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো। রিকশা, সিএনজি অটোরিকশা ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রাইভেটকারসহ ছোট ছোট যানবাহনের কারণে এ সময় শহরের কোথাও কোথাও যানজটের সৃষ্টি হয়। লকডাউনের মধ্যে চিরচেনা রাজধানী ঢাকার আজকের এই চিত্র দেখে মনে হয় না দেশে লকডাউন আছে।
পূর্বের অবস্থা দেখে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আসলে লকডাউন আছে কিনা এ নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। তারা এসব ঘটনায় প্রশাসনের নির্লিপ্ততাকে দায়ী করছেন। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায় অনেকে মাস্ক ছাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছেন। চা দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে অনেকে। আবার কেউ কেউ রিকশায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
রাজধানীতে গণপরিবহন না থাকায় অনেকেই নিজস্ব পরিবহনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ আবার রিকশা ভ্যান বা খোলা পিকআপ ভ্যানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাচ্ছেন। সরকারি অফিস-আদালত ও কলকারখানা খোলা থাকার কারণেই এই যানজটের কারণ মনে করছেন অনেকে।
রাজধানী ঢাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়ায় চালিত পরিবহন হিসেবেই পরিচিত। এটি এককভাবে যাত্রী পরিবহন করে থাকে। তবে সরকার ঘোষিত সাত দিনের কঠোর নিষেধাজ্ঞায় রাজধানীতে গণহারে যাত্রী পরিবহন করছেন অনেক অটোরিকশাচালক।
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় বাস ও লেগুনার মতো ডেকে ডেকে যাত্রী তুলছেন চালকরা। এতে বিচ্ছিন্নভাবে আসা যাত্রীরা গাদাগাদি করে ভ্রমণ করছে। ফলে সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়ছে।
করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়া সরকার গণপরিবহনে সামাজিক দূরত্বে ৫০ ভাগ যাত্রী পরিবহনের নিয়ম করে। কিন্তু এতেও সংক্রমণ আশানারুপ না কমায় সাত দিনের জন্য গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সিএনজিচালিত অটোরিকশায় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে করে দেদার যাত্রী তোলা হচ্ছে।
ফার্মগেট ওভারব্রিজের নিচে দেখা যায়, লাইন দিয়ে প্রায় ১০টির মতো অটোরিকশা দাঁড়িয়ে। সিএনজি-অটোরিকশার চালকরা ডেকে ডেকে গুলিস্তানের যাত্রী তুলছেন। প্রতিটি অটোরিকশায় ৪ থেকে ৫ জন করে যাত্রী নেয়া হচ্ছে। আর এসব অটোরিকশার গন্তব্য গুলিস্তান। ফার্মগেট থেকে গুলিস্তান যেতে জনপ্রতি ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৫০ টাকা।
সরকার সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে গণপরিবহন বন্ধ রেখেছে। তবুও এক অটোরিকশায় ৪ জন যাত্রী কেন জানতে চাইলে এক যাত্রী এই প্রতিবেদককে বলেন, সরকারের কথা বলে লাভ নাই।
এই প্রশ্নের জবাবে অপর এক চালক বলেন, রাস্তায় যাত্রী নেই, কিছু নেই। লোকাল যাত্রী নিয়ে কোনো মতে চলছি। ফার্মগেট থেকে গুলিস্তান যাত্রী টানছি। ৫০ টাকা করে প্রতিজন দেয়। বেশি সময় চালাতে পারি না। পুলিশ ঝামেলা করে। এর মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে চালাচ্ছি। কী করবো? আমাদেরও তো জীবন বাঁচাতে হবে।