লকডাউনের চতুর্থ দিন : রুট পারমিট বিভ্রান্তি!

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন রাজধানী স্বাস্থ্য

টিসিবির লাইনে ব্যবসায়ীরা
যাত্রী কম, কমছে না যানজট
সূচকের বড় পতনে শেষ সপ্তাহ

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় দেশে সাত দিনের লকডাউনের গতকাল ছিল চতুর্থদিন। তবে লকডাউনের মধ্যেও দেশের সিটি শহরগুলোতে চলছে গণপরিবহন। কিন্তু পরিবহনের রুট পারমিট নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন বাসচালকরা।
বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর গাবতলীর আমিন বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা থেকে সাভার পর্যন্ত যাওয়া গণপরিবহনগুলোকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘুরিয়ে ঢাকার পথে যেতে বলছেন। যার কারণে যাত্রীরা সেখানে নেমে পায়ে হেঁটে সাভারের দিকে যেতে হচ্ছেন। এদিকে, বাসচালকরা বলছেন তাদের রুট পারমিট সাভার পর্যন্ত রয়েছে। তাই তারা সাভার পর্যন্ত যাত্রী নিয়ে যেতে চান। কিন্তু সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সিটির বাইরে বাস চলাচল নিষেধ, তাই পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন।
ঠিকানা পরিবহনের বাসচালক মোহাম্মদ জব্বার মিয়া বলেন, লকডাউনের মধ্যে গণপরিবহন সীমিত আকারে চলছে। আমরা সরকারের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল করছি। আমাদের বাস নিউমার্কেট থেকে সাভার পর্যন্ত রুট পারমিট থাকলেও এখন আমিনবাজারের ওপাশে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। যাত্রী নিয়েছি সাভারের কথা বলে। কিন্তু আমিন বাজার এলাকায় এলেই পুলিশ আমাদের বাস ঘুরিয়ে ঢাকার দিকে যেতে বলছে। যার কারণে যাত্রীদের তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে আমাদের।
কফিল শেখ নামে এক যাত্রী বলেন, আমি সাভার যাবো। সেখানে আমার অফিস। বাসে উঠলাম সাভার বলে ডাকছে দেখে। কিন্তু এখন আমিন বাজার পর্যন্ত এসে নামিয়ে দিয়েছে। ভাড়া ঠিকই ৬০ শতাংশ বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন কীভাবে যাবো?
আমিনবাজার এলাকায় দায়িত্বরত মোহাম্মদ হুমায়ুন নামে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সকাল থেকেই রাজধানীর গণপরিবহনগুলো আমিন বাজার এলাকায় এসে ভিড় জমাচ্ছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সিটির বাইরে কোনো পরিবহন যেতে পারবে না। তাই আমরা সিটির বাইরে কোনো পরিবহন যেতে দিচ্ছি না। কিন্তু পরিবহন শ্রমিক বা চালক এবং যাত্রীরা সেটা কিছুতেই বুঝতে চাচ্ছেন না। তারা রুট পারমিটের কথা বলছেন। লকডাউনের জন্য যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেখানে রুট পারমিট দেখিয়ে তো কোনো লাভ নেই। আমরাতো সরকারি নির্দেশনা পালন করছি।
এদিকে, রমজানের আগেই চাল, ডাল তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে কয়েক দফা। এরই মধ্যে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধে দিশেহারা মানুষের ভরসা এখন টিসিবির ন্যায্যমূল্যের পণ্য। এদিকে নানা কৌশলে অপেক্ষাকৃত সস্তায় টিসিবির পণ্য কিনে ব্যবসার ধান্দায় নেমেছে কিছু অসাধু দোকানি। তারা স্ত্রী, সন্তান এমনকি ফুটপাতের মানুষদের ভাড়া করে দাঁড় করাচ্ছে টিসিবির পণ্য কেনার লাইনে।
বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর সায়েদাবাদ, গোলাপবাগ, গোপীবাগ কমলাপুর মুগদাসহ প্রতিটি এলাকায় ন্যায্যমূল্যের তেল, পেঁয়াজ, ডাল, চিনি কিনতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে যান ক্রেতারা। মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালে সামনে দাঁড়ানো দুটি ট্রাকের টিসিবির পণ্য নিতে কয়েকশ’ মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন। এসময় লাইনে দাঁড়ানো মোমেনা বেগম নামে এক নারীর সঙ্গে কথা হয়।
এই নারী বলেন, এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে লাইনে দাঁড়াইছি। আরও বড় লাইন ছিল। আমার সামনে আরও একশ’ মানুষ মনে হয় কিনছে। ন্যায্যমূল্যের লাইনে দাঁড়ানোর কারণ বলতে গিয়ে মোমেনা বলেন, দোকানে ভালো তেলের দাম ১৪০ টাকা কেজি। এখানে দুই কেজির দামে তিন কেজি তেল নিতে পারছি। লাইনে দাঁড়ানোর কষ্টের কথাও জানান তিনি। বলেন, সেই সকাল থেকে দাঁড়াইছি। এখনও পাচ্ছি না। অনেক মানুষ। বাসায় ছোট ছোট বাচ্চা রেখে আসছি। কী করবো, উপায় নাই।
মোমেনার মতোই তার পেছনে দাঁড়ানো আরেক নারী বলেন, আমি একটা কারখানায় কাম করতাম, লকডাউনের কারণে কাজ কাম না থাকায় কারখানা বন্ধ করে দিছে। ঝামেলায় পইড়া গেছি। ন্যায্যমূল্যের পণ্য নিতে লাইনের শেষে দাঁড়িয়ে আছেন পলাশ। ন্যায্য মূল্যের পণ্য নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পলাশ বলেন, অটো চালিয়ে আসতে দেরি হয়ে গেছে। সেই সকালে অটো নিয়ে বেরি হইছি। করোনার কারণে খ্যাপ একবারেই নাই। ঢাকায় মানুষইতো নাই।
এই অটোচালক বলেন, লকডাউনে ঢাকার মানুষ সব গ্রামে চলে গেছে। রাস্তায় সকাল বা বিকেলে খ্যাপ পাওয়া গেলেও সারাদিন পাই না। কাল থেকে কিছু টাকা জমিয়ে লাইনে মাল নিতে আসছি।
নিজের ভোগান্তির কথা বলতে গিয়ে এই চালক বলেন, এইভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পরতো ন্যায্যমূল্যের জিনিসও কিনবার পয়সা থাকবো না। যারা বাড়িতে গেছে হেরা মনে হয় না ঈদের আগে আসবে। অনেকের একাধিক পণ্য নেয়ার তথ্যও পাওয়া যায় ট্রাক ম্যানেজারের কাছ থেকে। তারা জানান অনেক অসাধু ব্যবসায়ী ন্যায্যমূল্যের পণ্য নিতে লাইনে দাঁড়ান।
তেল-পেঁয়াজ-চিনিসহ টিসিবির পণ্য নিতে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এমনই এক নারী। পণ্য নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে ওই নারী বলেন, এই মাল আমার না, আমারে জায়ের। আমার কাছে দিয়ে রাখছে। আমি মাল নেবো।
টিসিবির ট্রাকে কাজ করে শরীফ নামের এক কর্মচারী। তিনি বলেন, গত তিনদিন থেকে হাজার হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়াইতেছে। পণ্য দিতে দিতে অবস্থা খারাপ। শরীফের দাবি কিছু অসাধু দোকানদারও স্ত্রী সন্তানদেরকে এসব লাইনে দাঁড় করান। তারা দিনের দুই বা ততোধিক বার ট্রাক থেকে মাল কেনেন।
ট্রাকের একজন ব্যবস্থাপক নিজের নাম না বলার শর্তে বলেন, অনেক ব্যবসায়ী রাস্তার ভিক্ষুক বা পথশিশু ভাড়া করেও পণ্য কেনান। একবার পণ্য কিনতে দেন বিশ থেকে ত্রিশ টাকা। আমরা তাদেরকে প্রতিরোধ করতে পারি না। এরা সঙ্গবদ্ধ।
অপরদিকে, করোনার সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের তিনদিন পর বুধবার ভোর থেকেই রাজধানীর সড়কে চালু হয়েছে গণপরিবহন। পরিবহনের সংখ্যা আগের মত থাকলেও কমেছে যাত্রী সংখ্যা। অর্ধেক যাত্রী তোলার কথা থাকলেও বেশিরভাগ আসনই ফাঁকা থাকেছে। তবে মোড়ে মোড়ে যানজট আছে আগের মতোই।
বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে যানজটের চিত্র চোখে পড়লেও যাত্রী তেমন একটা দেখা যায়নি। যানজটের দিক থেকে অনেকটা চিরচেনা রুপেই ফিরেছে নগরী। বুধবারের মত আজও অর্ধেকেরও কম যাত্রী নিয়ে বেশিরভাগ আসন ফাঁকা রেখে চলছে গণপরিবহন।
জনভোগান্তির কথা ভেবে লকডাউনের মধ্যেই সরকার দেশের সিটি করোপরেশন এলাকা ও বিভাগীয় শহরে যানবাহন চলাচলের অনুমতি দেয়। ফলে চলাচল করছে বাস। রাজধানীতে পর্যাপ্ত গণপরিবহন থাকলেও যাত্রীর তেমন চাপ নেই। অফিস টাইমে যাত্রীদের বাসের জন্য ছোটাছুটির নিত্যদৃশ্য দেখা যায়নি। সড়কে পর্যাপ্ত বাস থাকলেও প্রতিটা স্ট্যান্ডে যাত্রীর অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায় বাসচালকদের।
সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর শ্যামলীতে কথা হয় ওয়েলকাম পরিবহনের স্টাফ আরমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, দুই দিন সড়কে আগের দিনগুলোর তুলনায় যাত্রী সংখ্যা অনেক কম। সরকার লকডাউন দেয়ার কারণে অনেকেই বাড়িতে চলে গেছেন। রাস্তায় তেমন যাত্রী নাই । দুই সিটে একজন নেয়ার কথা থাকলে ও আমরা যাত্রী না পাওয়ায় অনেক সময় দুই সিট খালি রেখেই গাড়ি চালাতে হচ্ছে।
যাত্রী লিয়ন বলেন, আমি বাসে উঠেছি শ্যামলী থেকে। বাসস্ট্যান্ডে এসেই বাস পেয়েছি। শাহবাগ যাবো। আশা করছি বেশি সময় লাগবে না। তাছাড়া বেশিরভাগ গাড়ির সিট ফাঁকা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটা গাড়িতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখার নির্দেশনা দেয়া হলেও আজও গণপরিবহনে ছিল না কোনো হ্যান্ড স্যানিটাইজার।
টানা তিনদিনে দেশের উভয় পুঁজিবাজারে সূচকের বড় উত্থানের পর পতন দিয়ে শেষ হলো সপ্তাহ। এদিন উভয় পুঁজিবাজারে লেনদেনের পাশাপাশি কমেছে বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিটের দর। ডিএসই ও সিএসই সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) লেনদেন হয়েছে ৪৭৫ কোটি ৮৭ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। যা আগের দিনের তুলোনায় ১০৬ কোটি টাকা কম লেনদেন হয়েছে। বুধবার ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৫৮২ কোটি ৫২ লাখ ২৯ হাজার টাকা।
এদিন ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া ৩৪৬টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৪৭টির, কমেছে ২৬৪টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৩৫টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিটের দর। বৃহস্পতিবার সিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ২৪ কোটি ১৮ লাখ ২৮ হাজার ৬১৫ টাকা। যা আগের দিনের তুলনায় ছয় কোটি টাকা কম। এদিন সিএসইর লেনদেনে অংশ নেয়া ২১৫টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৪৬টি কোম্পানির। দর কমেছে ১৫৪টি কোম্পানির। অপরিবর্তিত রয়েছে ১৫টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিটের দর।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসই-এক্স সূচক ৮২ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে পাঁচ হাজার ২৫৪ পয়েন্টে। ডিএসই শরিয়াহ সূচক ১৬ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে এক হাজার ১৯৭ পয়েন্টে এবং ডিএসই-৩০ সূচক ২০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে এক হাজার ৯৯০ পয়েন্টে।
অপর দিকে, সিএসইর সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১৯৭ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১৫ হাজার ২৩৭ পয়েন্টে। সিএসইএক্স সূচক ১১৮ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে নয় হাজার ১৯৩ পয়েন্টে। সিএসই-৩০ সূচক ১১৩ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১১ হাজার ৬৭৫ পয়েন্টে। সিএসই-৫০ সূচক ১৩ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে এক হাজার ১৫৬ পয়েন্টে। সিএসআই ১৪ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৯৬৮ পয়েন্টে।


বিজ্ঞাপন