ঈদে পর বাড়ল মৃতু-আক্রান্ত
সেকেন্ড ওয়েভের মাঝমাঝি
এমএ স্বপন : মহামারি করোনাভাইরাস শুরু থেকেই দাপট দেখিয়ে আসছে বিশ্বে। করোনার প্রথম ঢেউয়ের থেকে দ্বিতীয় ঢেউ অনেকটা খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এ ভাইরাসকে মোকাবিলা করতে অনেক গবেষক নানা গবেষণাও করেছে। এবার করোনাভাইরাস নিয়ে ভয়াবহ তথ্য দিল ইতালীয় গবেষক। দেশটির ১৬২ জন আক্রান্ত রোগীর উপর চালিত এক গবেষণায় এমন ফলাফল পাওয়া গেছে বলে জানান ইতালির মিলানের সান রাফায়েল হাসপাতাল। সম্প্রতি তিনি এই ভয়ঙ্কর তথ্য তুলে ধরেন। ইতালীয় গবেষকের দাবি, করোনাভাইরাসের জীবাণু মানব দেহের রক্তে সর্বোচ্চ আট মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
করোনা আক্রান্তদের শরীরে এন্টিবডি তৈরি হবার পর ও সুস্থ হবার পর রক্তে করোনা ভাইরাসের জীবাণু ৮মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকে। এমন তথ্যে নড়াচড়ে বসেছেন বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা।
গত সপ্তাহে ইতালির আইএসএস জাতীয় স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের গবেষকরা এমন তথ্য প্রদান করেন যে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর রক্তে করোনা ভাইরাস জীবাণু আট মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
তবে আক্রান্ত হবার ১৫ দিনের মধ্যে যাদের শরীরে শতভাগ এন্টিবডি তৈরি হয়নি, তাদের ক্ষেত্রে এই জীবাণু রক্তে আটমাস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
যদি কেউ আক্রান্ত হয়ে ১৫ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায় তাদের শরীরের রক্তে আর কোনো জীবাণু থাকার সম্ভাবনা নেই। এমন তথ্য বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
মানুষ কোভিড আক্রান্ত থেকে সুস্থ হয়ে যে এন্টিবডি প্লাজমা অসুস্থ রুগীদের দিতেন তাতেও ভিন্নতা এনেছে এই গবেষণা। অনেক ক্ষেত্রে করোনা থেকে সুস্থ হয়ে উঠা মানুষের এন্টিবডি প্লাজমা কাজে আসছেনা অসুস্থদের সুস্থ করতে এর সঠিক উত্তর পাওয়া গেছে এই গবেষণা থেকে।
এন্টিবডি প্লাজমা কেবল ১৫ দিনে সুস্থ হওয়া রোগীরা পরবর্তীতে অন্য আক্রান্ত রোগীদের দিতে পারবেন।
‘নেচার কমিউনিকেশন’ নামের একটি বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত অপর এক গবেষণার তথ্য থেকে জানা যায় যে, গতবছর মার্চ ও এপ্রিল মাসের পর থেকে যারা করোনা আক্রান্ত হয়ে ভালো হয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই আবার আক্রান্ত হয়েছেন এবং পর্যবেক্ষণে রাখা ১৪০ জনের মধ্যে প্রায় ২৯ জন রোগী মারা গেছেন। এর মধ্যে একজন বাংলাদেশিও রয়েছে। করোনা আক্রান্ত রোগীদের রক্তে সর্বোচ্চ ৮ মাস পর্যন্ত এই করোনা জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে বলে নিশ্চিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ও হাসপাতাল সূত্র হতে জানা গেছে নতুন করে আক্রান্ত হওয়া রোগীদের ৫৭ শতাংশের শরীরে পূর্বেই ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ ছিল। এ ধরনের রোগীদের বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
করোনা ভাইরাসের জীবাণু আট মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে মানুষের রক্তে। এমন সংবাদে ভাইরাসটির ক্ষেত্রে নতুন করে কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের।
বাড়ল মৃতু-আক্রান্ত : বিশ্বব্যাপী তা-ব চালানো মহামারি করোনাভাইরাসে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন আরও ২৫ জন। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ১৪৯ জন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছেন আরও ৩৬৩ জনের দেহে। দেশে এখন পর্যন্ত মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৮০ হাজার ১৫৯ জনে।
করোনাভাইরাস নিয়ে রোববার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৬০১ জন। এ নিয়ে মোট সুস্থ হয়েছেন ৭ লাখ ২২ হাজার ৩৬ জন। এদিন মোট করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৫ হাজার ৪৩০ জনের।
এর আগে শনিবার (১৫ মে) দেশে করোনায় ২২ জন মারা যান, আর নতুন করে শনাক্ত হয় ২৬১ জন।
এদিকে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্যানুযায়ী, রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বে মারা গেছেন আরও প্রায় ১২ হাজার মানুষ। এখন পর্যন্ত বিশ্বে মোট করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৩৩ লাখ ৮৩ হাজার ২৩০ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছেন ১৬ কোটি ৩১ লাখ ৬৫ হাজার ৫৭৩ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৪ কোটি ১৪ লাখ ৬২ হাজার ১৪৬ জন।
করোনায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়েছে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রে। তালিকায় শীর্ষে থাকা দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত হয়েছেন ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৯৫ হাজার ৯১৬ জন। মৃত্যু হয়েছে ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৩ জনের।
আক্রান্তে দ্বিতীয় ও মৃত্যুতে তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভারতে এখন পর্যন্ত মোট সংক্রমিত হয়েছেন ২ কোটি ৪৬ লাখ ৮৩ হাজার ৬৫ জন এবং এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার ৩১৯ জনের।
আক্রান্তে তৃতীয় এবং মৃত্যুতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ব্রাজিলে এখন পর্যন্ত করোনায় এক কোটি ৫৫ লাখ ৯০ হাজার ৬১৩ জন সংক্রমিত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৮৫২ জনের।
আক্রান্তের দিক থেকে চতুর্থ স্থানে রয়েছে ফ্রান্স। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫৮ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩৯ জন। ভাইরাসটিতে মারা গেছেন এক লাখ ৭ হাজার ৫৩৫ জন।
এ তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে তুরস্ক। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন ৫১ লাখ ৬ হাজার ৮৬২ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৪৪ হাজার ৫৩৭ জন।
এদিকে আক্রান্তের তালিকায় রাশিয়া ষষ্ঠ, যুক্তরাজ্য সপ্তম, ইতালি অষ্টম, স্পেন নবম এবং জার্মানি দশম স্থানে রয়েছে। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩তম।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২১৮টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯।
সেকেন্ড ওয়েভের মাঝমাঝি : বাংলাদেশ এখন করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ বা সেকেন্ড ওয়েভের মাঝখানে আছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের (সিডিসি) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম।
রোববার দুপুরে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য বুলেটিনে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেছেন, ‘বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কম থাকলেও এ নিয়ে আত্মতুষ্টি বা সন্তুষ্টির কোনো কারণ নেই। এ ধরনের সংখ্যা যদি দিনের পর দিন পেতে থাকি তবেই একটু স্বস্তির নি.শ্বাস ফেলতে পারি। তার আগে পর্যন্ত মনে রাখতে হবে যে সংক্রমণের যে দ্বিতীয় ঢেউ বা সেকেন্ড ওয়েভ চলছে আমরা তার মাঝখানে আছি। সেখান থেকে এখনো পরিত্রাণ পাইনি। কাজেই সবাইকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্ক থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘করোনা উপসর্গ থাকা জনগণকে করোনা শনাক্তে নমুনা পরীক্ষা বেশি বেশি করায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যত বেশি পরীক্ষা হবে তত বেশি রোগী শনাক্ত হবে। শনাক্ত রোগীদের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে করোনার ভ্যারিয়েন্ট চিহ্নিত করা হবে।’
তিনি জানান, জিনোম সিকোয়েন্সিং একটু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই স্বাস্থ্য অধিদফতর বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত উপযুক্ত ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জিনোম সিকোয়েন্সিং করে গণমাধ্যমকে অবহিত করে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র বলেন, ‘ভারত থেকে যেসব নাগরিকরা (চিকিৎসার জন্য যাওয়া রোগী ও তাদের সঙ্গে যাওয়া স্বজনরা) ফিরে আসছেন তারা বাংলাদেশ সীমান্তে আসার পর তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হচ্ছে। কোনো কোনো স্থানে রোগী ও তাদের স্বজনরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। নানাভাবে নিজ বাসগৃহে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এটি একেবারেই যৌক্তিক নয়। কারণ এভাবে কোয়ারেন্টাইন থেকে চলে গেলে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট করোনায় আক্রান্ত কোনো রোগী থেকে থাকলে পুরো দেশবাসীকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।’
তিনি ভারত থেকে ফিরে আসা এসব বাংলাদেশি নাগরিকদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নিজের এবং অন্যদের জীবনকে বিপন্ন না করতে কোয়ারেন্টাইনে সেন্টারে অবস্থানের অনুরোধ জানান।
তিনি জানান, হাসপাতালে বর্তমানে ভর্তি রোগীর চাইতে খালি শয্যার সংখ্যা বেশি। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার, হাইফ্লো নেজাল ক্যানুলা, অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।
অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম আরও বলেন, ‘বর্তমানে তিনটি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে নাগরিকরা ফিরে আসছেন। ফিরে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের চিকিৎসা প্রয়োজন তাদের স্থানীয় জেলা, বিশেষায়িত কিংবা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা প্রদানের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া তাদের জন্য রাজধানীর মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে সম্প্রতি খোলা ১০০ বেডও রয়েছে। প্রয়োজন হলে তাদেরকে সেখানে রেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা হবে।’