কাজের প্রলোভনে ভারতে পাচার ৯ মাসে দেশে ফিরেছেন শতাধিক নারী

অপরাধ

নিজস্ব প্রতিবেদক : কাজের লোভ দেখিয়ে অবাধে চলছে ভারতে নারী, কিশোরী ও তরুণী পাচার। এসব নারীরা প্রায়ই শিকার হন নির্মম নির্যাতনের। পাচারের আগে এসব নারীদের নানা আশ্বাস দেওয়া হলেও বেশিরভাগই জানেন না কি কাজ দেওয়া হবে তাকে। কোথায় গেলে মিলবে চাকরি? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উত্তর পাওয়া যায়, ‘অত সব জেনে কি হবে? ভরসা রাখো, ঠিক কাজ জুটে যাবে’।
জানা যায়, বাংলাদেশের নারীরা বিভিন্ন দেশেই কম-বেশি পাচার হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি পাচার হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থাকা পাচারকারী সিন্ডিকেট চাকরিসহ নানা লোভ দেখিয়ে ২০-৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে নারীদের বিক্রি করে দেয় ভারতীয় সিন্ডিকেটের কাছে। সেখানে আবার নানা হাত ঘুরে অনেকেরই ঠিকানা হচ্ছে যৌনপল্লী। সেখানে শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হন তারা।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ও রাইটস যশোর নামের দুটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য থেকে জানা যায়, ভারতে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর সেখানকার সরকারি ও বেসরকারি সেফহোমে এখনো অনেক বাংলাদেশি নারী রয়েছেন। তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৮টি রুট দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার নারী, শিশু ও কিশোরী ভারতে পাচার হচ্ছে।
জানা গেছে, গত নয় মাসে ভারতের বিভিন্ন শহরে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে ২ থেকে ৫ বছর জেল খেটে দেশে ফিরেছেন বেনাপোল চেকপোস্ট হয়ে প্রায় শতাধিক নারী, কিশোরী ও তরুণী। এর মধ্যে গত ২৫ জানুয়ারি বেনাপোল দিয়ে ফেরত আসে ২৮ কিশোরী, ১৯ মার্চ আসেন আট নারী, ২ সেপ্টেম্বর সাত তরুণী, ২০ সেপ্টেম্বর ১৬ কিশোরী ও নারী, ৩০ সেপ্টেম্বর ১২ তরুণী ও সর্বশেষ ৭ অক্টোবর ফেরত আসে ১১ জন কিশোরী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শার্শা ও বেনাপোলের পুটখালী, দৌলতপুর, সাদিপুর, রঘুনাথপুর, কায়বা, রুদ্রপুর, গোগা, অগ্রভুলোট সীমান্ত দিয়ে পাচার হয় এসব নারী, কিশোর ও তরুণীরা। ভরতের উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটার আঙরাইল, বনগাঁর কালিয়ানি পিরোজপুর, বাগদার বয়রা, রানাঘাট সীমান্ত দিয়ে চোরাপথে ভারতে প্রবেশ করানো হয় তাদের। তারপর দালালরাই তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করে। সেখান থেকে তারা যায় মুম্বাই, পুনে, দিল্লিসহ ভারতের বড় শহরগুলোতে।
সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শার্শা, বেনাপোল, ভারতের বনগাঁ থেকে মুম্বাই পর্যন্ত সক্রিয় আছে একটি চক্র। প্রথমে বাংলাদেশি দালালরা গরিব পরিবারের মেয়েদের টার্গেট করে। ভালো বেতনের কথা বলে এসব পরিবারকে বুঝিয়ে বা কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে সহজ সরল মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয় সীমান্তে। এরপর সুযোগ বুঝে পার করা হয় ভারত সীমান্তে। সীমান্তের গ্রামগুলোতে নির্দিষ্ট ঘরে তোলা হয় এসব মেয়েদের। এরপর রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন পথ দিয়ে পাচার করা হয় তাদের। এরপর পাচার চক্রের স্থানীয় এজেন্টেরা মূল এজেন্টদের কাছে তাদের বিক্রি করে দেয়। তারা আবার বিক্রি করে ভারতীয় এজেন্টদের কাছে। সীমান্ত পার করে ভারতীয় এজেন্টের হাতে পৌঁছাতে পারলেই এদেশের এজেন্টদের দায়িত্ব শেষ হয়।
ভারত থেকে ফেরত আসা পিরোজপুর জেলার এক তরুণী বলেন, ‘ভারতে তিন বছর জেল খেটে দেশে ফিরেছি গত ২০ সেপ্টেম্বর। দালালদের খপ্পরে পড়ে ভালো চাকরির আশায় ভারতের মুম্বাই শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে গেলে আমাকে একটি ঘরে আটকিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। কোথাও এক সপ্তাহর বেশি রাখা হয় না। এরপর আমাকে মুম্বাই থেকে পুনে নামক একটি শহরে নেওয়ার পথে আমি কৌশলে পালিয়ে যাই। এরপর সে দেশের পুলিশ আমাকে আটক করে কারাগারে পাঠায়।’
ভারত ফেরত বাগেরহাটের এক তরুণী বলেন, ‘আমাকে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। এক পর্যায়ে পালানোর বা প্রতিবাদ করার শক্তিটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলি।
সালমা খাতুন (ছদ্মনাম) বলেন, ‘সাতক্ষীরার জনৈক পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে ২০১৯ সালে মার্চ মাসে স্বামী-স্ত্রী মিলে মুম্বাই যাই। কাপড়ের দোকানে মোটা বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। কোলকাতার এক দালাল ট্রেনে করে তাদেরকে মুম্বাই নেওয়ার তিনদিন পর বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ভারতে আসার অপরাধ দেখিয়ে স্বামীকে পুলিশে ধরিয়ে দেয় দালালরা। পরের দিন রাতে সংঘবদ্ধ দালাল চক্র তাকে পুনের বুধওয়ার পেথ নামক একটি নিষিদ্ধ পল্লীতে মোটা অংকের টাকায় আমাকে বিক্রি করে দেয়। সেখানে অবস্থানকালে মারধর করলে রাতের আধারে পালিয়ে নিকটস্থ থানায় আশ্রয় নেই। পরে পুলিশ আদালতে পাঠালে আমাকে আড়াই বছরের সাজা দেওয়া হয়। সাজা ভোগ শেষে দেশে ফেরার কাগজ তৈরি করতে সময় লাগে প্রায় ৮০ দিন। তারপর স্বামীকে নিয়ে দেশে ফিরি।’
স্থানীয় সংবাদকর্মী এম এ মুন্নাফ বলেন, সীমান্ত দিয়ে কিছু অসাধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় নারী ও শিশু পাচার চক্রের সদস্যরা যোগসাজশে এসব পাচারকার্য হয়ে থাকে।
এনজিও সংস্থা জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের যশোরের সিনিয়র প্রোগ্রামার অফিসার এ বি এম মুহিত হোসেন জানান, বাংলাদেশ থেকে নারী পাচারের ইতিহাস অনেক দিনের হলেও এটি বন্ধের জন্য খুব বেশি যে সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তা নয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে একমাত্র উদ্যোগ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। কিন্তু এটি যে শুধুমাত্র আইন দিয়েই বন্ধ হবে তা নয়।
তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে আমাদের দুর্বলতাগুলো আগে চিহ্নিত করতে হবে। কীভাবে এই পাচারগুলো ঘটছে এবং সেই হিসেবেই প্রতিরোধের উপায়গুলোও হাজির করতে হবে। পাচারকারীরা কিন্তু প্রতিনিয়তই নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে পাচার অব্যাহত রাখছে। পাচার প্রতিরোধে আইনের পাশাপাশি সেই কৌশলগুলোর বিপরীতে কৌশল ঠিক করেই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে প্রতিরোধের উপায়গুলো।’
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক বেগম সালমা আলী জানান, বিগত ১০ বছরে ভারতে পাচার হওয়া দুই হাজার নারীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ফিরে আসা নারীদের খুব কমই তাদের অভিজ্ঞতা অন্যদের জানায়। অনেকের হয়তো বলার মতো মানসিক অবস্থাও থাকে না। এর পিছনে কাজ করে সমাজ, পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনের কাছে হেয় হবার ভয়। কারণ অনেক নারী ফিরে এসে সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে আবারো হেনস্থার শিকার হন। অনেকেই ভোগেন অনিরাপত্তায়। পারিবারিকভাবে সমর্থন না পাওয়ায় অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আবার হতাশ হয়ে পড়েন।
নারী ও শিশু পাচার ও তাদের ফিরিয়ে আনার কাজ করে চলেছেন যশোরের মানবাধিকার সংস্থা রাইটস যশোর। ওই সংস্থার নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক জানান, ভারতের বিভিন্ন হোমে বাংলাদেশি অনেক নারী ও তরুণী দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছে। দুদেশের উচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি জানানো হয়েছে। আটকে থাকা নারী ও তরুণীর নাম ঠিকানা পরীক্ষা করা হচ্ছে। খুব দ্রুত বিষয়টি সমাধান করে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।
বেনাপোল পোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুন খান জানান, পাচার হওয়া নারীরা যখন ফেরত আসেন তখনই জানা যায় এরা পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে ভারতে গিয়েছিল। কিন্তু মামলা করার কথা বললে কেউ এগিয়ে আসে না। মানব পাচার রোধে বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় লোকজন নিয়ে সভা করা হয়েছে। তারপরও তা রোধ করা যাচ্ছে না। কাউকে না জানিয়ে রাতের আধারে এসব নারীরা ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে দালালের হাত ধরে।


বিজ্ঞাপন