আগে লক্ষ্যপূরণ পরে বুস্টার

স্বাস্থ্য

জাতীয়ভাবে বুস্টার ডোজ দেওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনও দেশে হয়নি এবং এ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তও হয়নি। আমরা আপাতত এ নিয়ে চিন্তা করছি না, দিচ্ছি না।

 

অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা
ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান


বিজ্ঞাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি দেশে করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর গত ১৭ মার্চে টিকা নেন নওশাবা আলম। এরপর সময় মতো তিনি দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে টিকার পূর্ণ ডোজ সম্পন্ন করেন। এরপর ছয় মাস পেরিয়ে প্রায়, এখন তিনি ভাবছেন তার শরীরে টিকার কার্যকারিতা রয়েছে কিনা, বুস্টার ডোজ নিতে হবে কিনা।
শুধু নওশাবা নয়, প্রথম দিকে যারা টিকা নিয়েছেন তাদের অনেকেই এমন সংশয়ে আছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এখনও বুস্টার ডোজ দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। বুস্টার ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তাতে টিকাদান কর্মসূচিতে অসমতা আসবে। তারা বলছেন, লক্ষ্যমাত্রার ৮০ শতাংশ পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বুস্টার ডোজের সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
টিকার তৃতীয় ডোজকে বলা হচ্ছে ‘বুস্টার’। বলা হচ্ছে, এই ডোজ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। গত ২১ অক্টোবর সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক টিকা গ্রহণকারী ষাটোর্ধ্বদের বুস্টার ডোজ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটি বলছে, যারা বেশি ঝুঁকিতে আছেন, তাদের আগে দুই ডোজ করে টিকার নিশ্চয়তার পর তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার ডোজ নিয়ে ভাবতে হবে।
একই দিনে করোনাভাইরাসের বুস্টার ডোজের অনুমোদন দেয় যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ)। এদিকে ইসরায়েল গণহারে ফাইজারের টিকার বুস্টার ডোজ দিয়েছে, দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যও।
৬৫ বছরের বেশি বয়সী যেসব নাগরিক ছয় মাস আগে শেষ ডোজ টিকা নিয়েছেন তাদের জন্য ফাইজার টিকার বুস্টার ডোজ অনুমোদন দিয়েছে মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এছাড়াও মারাত্মক অসুস্থতার ঝুঁকিতে থাকা এবং সম্মুখ সারির কাজে নিয়োজিত প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্যও বুস্টার ডোজের অনুমোদন দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ)।
দেশটিতে এফডিএর দেওয়া এই অনুমোদন চূড়ান্ত হওয়ার আগে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) অনুমোদনের শর্ত দেওয়া হয়। বলা হয়, ঝুঁকিপূর্ণ ও সম্মুখ সারির কর্মী বিবেচনার শর্ত নির্ধারণ করবে সিডিসির প্যানেল। এফডিএ’র পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, স্বাস্থ্য সেবা কর্মী, শিক্ষক, ডে কেয়ার কর্মী, মুদি দোকানের কর্মচারী, গৃহহীন কিংবা কারাগারে থাকা ব্যক্তিরা ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় থাকবেন। আর তাতে এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই সিদ্ধান্ত কেবল ফাইজার-বায়োএনটেক টিকা গ্রহণকারীদের জন্য প্রযোজ্য হবে। যেসব মার্কিনি মডার্না এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা নিয়েছেন, বুস্টার ডোজ নিতে তাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।
আর বাংলাদেশে দুই ডোজ করে মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জনকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের। গত ৭ ফেব্রুয়ারি টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর গত ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৭ কোটি ৩৩ লাখ ৯ হাজার ৮৯৯ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে ৪ কোটি ৩১ লাখ ১ হাজার ১৯৯ জনকে, আর দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৩ কোটি ২ লাখ ৮ হাজার ৭০০ জন। দেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, মডার্না ও চীনের তৈরি সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হচ্ছে।
দেশে বুস্টার ডোজের প্রয়োজন রয়েছে কিনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক ও জাতীয় টিকা পরামর্শক কমিটি (ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি গ্রুপ) নাইট্যাগ-এর সদস্য অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘আগে আমাদের টিকার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে, এরপর বুস্টার ডোজ। বুস্টার ডোজ বাংলাদেশে দেওয়ার মতো অবস্থা নেই।’
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের টিকা দেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে কিছু কিছু টিকার ক্ষেত্রে বুস্টার ডোজের প্রয়োজন নেই; যেমন অক্সফোর্ডের-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ক্ষেত্রে, যা দিয়ে দেশে টিকা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এবং সামনে আরও দেওয়া হবে।
‘অ্যাস্ট্রাজেনেকার বেলায় গবেষণায় বলা হচ্ছে, দুই ডোজ দেওয়া হলে এটা লাইফ-লং ইমিউনিটি দেবে। সুতরাং সেখানে বুস্টার ডোজের প্রশ্নই ওঠে না। দ্বিতীয়ত, দেশে মাত্র ১০ শতাংশ বা তার কিছু বেশি শতাংশ মানুষকে টিকা দিয়েছি। সেক্ষেত্রে আমরা যদি টিকার দ্বিতীয় ডোজই শেষ না করতে পারি তাহলে বুস্টারের চিন্তা করার দরকার’- বলেন অধ্যাপক ডা. বে-নজির।
নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার পরে বুস্টার ডোজ নিয়ে চিন্তা করা যাবে উল্লেখ করে নাইট্যাগ-এর এই সদস্য বলেন, ‘ততদিনে হয়তো দেখা যাবে বুস্টার ডোজের প্রয়োজনই নেই। কিন্তু এখন যদি আমরা বুস্টার ডোজ শুরু করি, তাহলে কিছু টাকা (টিকা ক্রয়ে) অযথা মিসইউজ হবে, টাকার অপচয় হবে; যেটার প্রয়োজন নেই। নাইট্যাগেরও একই মনোভাব। এখনও দেশে বুস্টার ডোজ নিয়ে চিন্তা করার মতো পর্যায়ে আসিনি।’
‘নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মানুষকে পূর্ণ টিকার আওতায় আনার আগেই যদি বুস্টার ডোজ শুরু করা হলে যারা এখনও টিকা পাননি কিংবা দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় রয়েছে, তাদের জন্য এটা প্রহসন হবে’ জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘তাই বুস্টার ডোজ নিয়ে চিন্তা করার মতো পর্যায়ে নেই।’
দেশে ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাও জানালেন একই কথা। তিনি বলেন, ‘জাতীয়ভাবে বুস্টার ডোজ দেওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনও দেশে হয়নি এবং এ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তও হয়নি। আমরা আপাতত এ নিয়ে চিন্তা করছি না, দিচ্ছি না।’
যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রিকমেন্ড করেছে, যাদের কোমর্বিডিটি রয়েছে, যাদের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে, তাদের বুস্টার ডোজ দেওয়া যেতে পারে। এ তথ্য উল্লেখ করেই অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘কিন্তু এটাতে আসলে ইকুইটেবল একসেসের বিষয় রয়েছে। আমাদের দেশে এখনও মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন, সেখানে আমাদের বুস্টার ডোজ দেওয়াটা রাইট ডিসিশন হবে না। আরও কিছু দিলে হয়তো আমরা বুস্টার ডোজের দিকে যাবো।
আর ‘বেসিক্যালি টিকার কার্যকারিতা এক বছর পর্যন্ত থাকছে’ উল্লেখ করে ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যদিও সরাসরি বলেনি ছয় মাস পরে নাকি এক বছর পরে বুস্টার ডোজ নিতে হবে; সেই জায়গাটাও তারা পরিষ্কার করেনি। তাই আমরা আপাতত বুস্টার ডোজ নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাইনি।’