ইউক্রেন যুদ্ধ: দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য কখনও কখনও স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধের প্রয়োজন হয়

আন্তর্জাতিক এইমাত্র

স্কোয়াড্রন লিডার অব. সাদরুল আহমেদ খান


বিজ্ঞাপন

২০১৫ সালে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বাংলাদেশ ডেলিগেশনের অংশ হয়ে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্রসবাগে অনুষ্ঠিত  ইউরেশিয়ান ফোরাম সম্মেলনে যোগ দেওয়ার। সেখানে জানলাম  সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ও প্রভাব টিকিয়ে রাখার জন্যেই মুলত নিয়মিতভাবে এই সম্মেলনটি করে থাকে রাশিয়া। “সিআইএস” কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট ষ্টেট যা আইপিইউ ( ইন্টারন্যাশনাল পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন)  এবং সিপিইউ (কমনওয়েলথ পারলামেন্টারি ইউনিয়ন)  এর অনুরুপ প্রতিষ্ঠান। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভগ্নাংশের ১৫ টি দেশ যেন যুক্তরাস্ট্র বা পশ্চিমা বলয়ের কোন সংঘে যুক্ত না হয় সেটা ছিল মূল প্রতপাদ্য বিষয়।


বিজ্ঞাপন

Sometimes small scale war is necessary for large scale peace.

ইতিহাসের উপলব্ধি হলো ‘যুদ্ধই পারে আরেকটি যুদ্ধকে প্রতিহত করতে’। প্রতিবাদ ছাড়া অন্যায় থামেনি, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছাড়া  পৃথিবীর কোনো দেশ স্বাধীন হয়নি। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান দখলদারিত্ব থেকে প্রায়  গোটা ইউরোপকে মুক্ত করা মিত্র বাহিনীর অন্যতম অংশীদার ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।

আর যদি পশ্চিমাদের প্রসঙ্গ টানা যায় তাহলে, গ্রানাডার প্রেসিডেন্টকে তুলে আনা, ফকল্যান্ডে হামলা করে দখল নেওয়া, ইরাকে সাদ্দামকে মেরে গণহত্যা, আফগানিস্তানে ২০ বছরের বিদেশি সেনা মোতায়েন, সিরিয়া, লিবিয়া, যুগোশ্লোভাকিয়া, সার্বিয়ায় আক্রমণ  করা এগুলো কি যুদ্ধ নয়?

ইতিহাসের মিল-অমিল ১৯৭১ ও ২০২২:

১৯৭১ সালে বাংলা ভাষাভাষী পুর্ব পাকিস্তানের  অধিবাসীদের উপর দমননীতির প্রতিবাদে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে  সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের রুপ নেয়।  বঙ্গবন্ধুর ২৬শে মার্চ ৭১ এ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে টানা যুদ্ধ শুরু হলো । পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালি শরনারথীরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।   ডিসেম্বরে  ভূটান ও ভারত বাংলাদেশ কে  স্বীকৃতি দেয়, ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে  বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় মিত্র বাহিনী  সরাসরি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে পূর্ব পাকিস্তান  সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে।  পাকিস্তানকে আশা দিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করতে আসেনি। মিত্রবাহিনীর  রাজধানী ঢাকা  যাত্রা বিলম্বীত করতে পাকিস্তানিরা নিজেরাই  বড় বড় সব ব্রিজ ভেঙ্গে দিয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ আমরা  চুড়ান্ত বিজয়  লাভ করি।

২০২২ এবার ইউক্রেনে দেখেন, পুর্ব ইউক্রেনে রুশ ভাষাভাষী দনেৎস্ক ও লুহানস্ক এর অধিবাসীদের উপর দমননীতির প্রতিবাদে ইউক্রেন বিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে সশস্ত্র যুদ্ধের রুপ নেয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২  তারিখে সারারাত ধরে  দনেৎস্ক শহরে বোমা হামলা করে ইউক্রেন সেনা বাহিনী, শহর ছেড়ে রাশিয়া পালায় লক্ষাধিক অধিবাসী। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে রাশিয়া দনেৎস্ক ও লুহানস্ক দুটি দেশকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়,  ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে রাশিয়ান সেনাবাহিনী  ইউক্রেনে প্রবেশ করে  সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। ইউক্রেনকে আশা দিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো  সাহায্য করতে আসেনি। রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে  রাজধানী কিয়েভ  যাত্রা বিলম্বীত করতে ইউক্রেন  নিজেরাই বড় বড় সব ব্রিজ ভেঙ্গে দিচ্ছে। এদিকে ইউক্রেনের পূর্ব এবং দক্ষিণাঞ্চলের নাগরিকরা রাশিয়ার সৈন্যকে স্বাগত জানিয়েছে। রাশিয়ান আর্মি ইউক্রেনের চেরনোবিল পারমানবিক রিঅ্যাক্টরের দখল নিয়েছে, এবং বিস্ময়কর হলো রাশিয়ান আর্মির সঙ্গে ইউক্রেনের আর্মির এক অংশ এগ্রিমেন্ট করে যৌথভাবে চেরনোবিল পাহারা দিচ্ছে।

আসলে আমরা  যারা বলি-‘যুদ্ধ চাইনা’, তারা নিজেরাও অনেক সময় শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধের বিকল্প পাই না, Peacekeeping is not a job of soldiers but only soldiers can do it.

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পেছনে প্রধান কারণ গুলোঃ

১.  রাশিয়ান বংশদ্ভুত দনেৎস্ক ও লুহানস্ক-এ স্বাধীনতাকামীদের উপর ইউক্রেনের জেনোসাইড থামানোর জন্য ২০১৪ সালে বেলারুশের মিন্সক-এ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন, জার্মান চ্যাঞ্চেলর মর্কেল, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট প্রোসেঙ্কো এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলান্দ  আলোচনার পর সাক্ষরিত হয় “Minsk Agreement”। সেই চুক্তির ১৩টি শর্ত ক্রমাগত ভায়োলেট করে আসছিল ইউক্রেন। একটানা ৭ বছর ধরে ওই দুটি প্রদেশের উপর হামলা চালাচ্ছে। হতাহতের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার।

২.  পশ্চিমা এ্যালায়েন্স ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করতে চেয়েছে। যদিও রাশিয়ার কাছে ন্যাটোর প্রতিশ্রুতি ছিল তারা ‘রেডলাইন’ ক্রস করবে না, বা জোটকে পূর্বাঞ্চলে এক্সপ্যান্ড করবে না। রাশিয়া বরাবর ইউক্রেনকে ন্যাটো অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে  সতর্ক করে এসেছে কিন্তু  তারা কর্ণপাত করেনি। বিগত ৫ বছর ধরে ইউক্রেনে,  ‘এন্টি রাশিয়া’ ক্যাম্পেইন চালিয়েছে ইউক্রেন সরকার।

৩. পুতিন যখন ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত না করার জন্য সতর্ক করেছে। তার জবাবে ইউরোপে রাশিয়ার উপর ইকোনমিক সেনশ্যান দেওয়ার হুমকি দিয়েছে ন্যাটো এবং ইইউ। জার্মানির সঙ্গে কোটি ডলারের গ্যাস পাইপ লাইন বন্ধেরও হুমকি রয়েছে।

৪. গোয়েন্দা  রিপোর্টে প্রকাশ এবছর  ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি যুদ্ধাস্ত্র  আসতে শুরু করে ইউক্রেন । ১৮ ফেব্রুয়ারি  তারিখে সারারাত ধরে বোমা হামলা হয় দনেৎস্ক শহরে। এক রাতেই শহর ছেড়ে রাশিয়া পালায় ৪০ হাজার অধিবাসী। এর পর পরই পুতিন তার নিরাপত্তা কাউন্সিলের অনুমোদন নিয়ে দনেৎস্ক ও লহানস্ককে রিপাবলিক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়, এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গিকার করে।

স্পেসিফিক মিলিটারি অ্যাকশনঃ

রাশিয়া  তিনটি লক্ষকে সামনে রেখে ‘স্পেসিফিক মিলিটারি অ্যাকশন’শুরু করেছেঃ

ক। ইউক্রেনের সরকারকে গুঁড়িয়ে দেওয়া।

খ। স্বাধীনতাকামী দনেৎস্ক ও লহানস্ককে দেশদুটিকে সুরক্ষা  করা।

গ। ইউক্রেনের নিউক্লিয়ার পাওয়ার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।

ইউক্রেনের সাথে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের ছলনাঃ

ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট কিছুদিন আগে ২৭ টি ন্যাটোভুক্ত দেশের প্রধানের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল, কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর তারা কেউ ‘তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন’ ছাড়া সাড়া দেয়নি। হতাশ ইউক্রেন  এখন একা।

 

লেখক : সদস্য, অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।