খাদ্য নিরাপত্তায় দ্বিপাক্ষিক নির্ভরশীলতা দূর করে বহুপাক্ষিক সমাধান ছাড়া বিকল্প নেই

Uncategorized জাতীয়

কুটনৈতিক বিশ্লেষক ঃ ২০০৭ সালের কথা ভুলিনি। ভয়ংকর সিডরের আঘাতে দেশ যখন বিপর্যস্ত তখন বড় যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল সেটা হল খাদ্য সমস্যা। সিডরের আঘাতে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। একি বছর উত্তর বঙ্গে বন্যায় ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যায়। দেশের শস্য ভান্ডারের যখন এই করুন পরিস্থিতি তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার খাদ্যের সংস্থানের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছিল। ভারত সে সময় ঘোষনা করে যে তারা ৫ লক্ষ টন চাল বিক্রি করবে বাংলাদেশে। কিন্তু তারা চাল পাঠাতে গড়িমসি শুরু করে। এমন না যে আমরা ফ্রি চাল চেয়েছি। সমস্যা আরো ঘনীভূত হয় যখন সরকার বন্যার পানি নেমে যাবার সাথে সাথে কর্দমাক্ত মাটিতে দ্রুত ধান লাগানোর জন্য বীজ ও চারা গাছ সরবরাহ শুরু করে। যখন মাঠগুলি ধানের কচি চারায় ভরে গিয়েছিল ঠিক তখনি ভারত থেকে আবারো ঢল নামে পানির। আবারো ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফসল।
সেবার চালের দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। একি সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাবসায়ীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানের জন্য ব্যাবসায়ীরাও ওই ক্রান্তিকালের সময়ে দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভাল ভূমিকা রেখেছিল। আর পুরো ঘটনাগুলি তত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি জনসমর্থন ঘুরিয়ে দেয়। বছরটি আমাদের জন্য নরকের মত ছিল। স্মৃতির পাতা থেকে কথা গুলি বলার কারন এটাই যে, আপনার ঘরে এসি না লাগালে আপনি মরে যাবেন না। এসি, টিভি, হাই এন্ড স্মার্টফোন এরকম অনেক কিছুর দাম বৃদ্ধি সাধারন মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে না। আমরা যারা আদার ব্যাপারী তাদের জাহাজের খবর না নিলে কিছুই এসে যায় না। তবে গন্ডগোল বাধে যখন আমাদের দিন শেষে পেটে টান পড়ে।
দেশের বিশাল অংশের প্রধান ব্যায়ের খাত এখনো খাদ্যপণ্য। স্পেসিফিক করে বললে নিত্য দ্রব্য। বাংলাদেশের অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং প্রতি বছর কৃষিজমির পরিমান কমতে থাকায় আমাদের খাদ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ক্ষমতায় যেই আসুক, আলাউদ্দিনের চেরাগ না পেলে এই পরিস্থিতির উন্নতি দেশে শুধু খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্ভব হবে না।
২০১৭ সাল হল ২০০৭ সালের পর সবথেকে খারাপ একটি বছর। অনেক দূর্যোগ ভোগ করতে হয়েছে। পরবর্তি প্রতিটা বছর বার বার আমাদের ইঙ্গিত করছে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে। পেয়াজের দাম ২০০ ছাড়ালো। দেশের মানুষ পরের বছর প্রচুর পেয়াজ আবাদ করল। এতে বাজার পড়ে যাবার কারনে অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হল। বর্তমানে বিশ্ব পরিস্থিতি এতটায় নাজুক যে গম, তেল, চাল ভুট্টার দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। সুযোগ ব্যয় বা অপরচুনিটি কস্ট সম্পর্কে আমাদের সবাই মোটামুটি ধারনা রাখি। বাংলাদেশের মাথাপিছু কৃষি জমির পরিমান কমছে। আমরা চাইলেই গম চাষ করতে পারিনা। চাইলেই তুলা ভাল হয় বলে তুলা চাষ বা সয়াবিন চাষ করতে পারিনা। যদি তুলা চাষ করতে যায় তাহলে সবজি বা ধান উৎপাদন কমে যাবে। যেহেতু আমাদের প্রধান খাদ্য চাল তাই ধানি জমিতে সিজনে অন্যান্য ফসল চাষ করা আমাদের মানায় না। বিলাসিতা বা অপচয় ও বলা যেতে পারে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ে। এরুপ ক্ষেত্রে আমাদের করনীয় কি? আগের লেখায় বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেছি। বলেছি ১৯৭৪ এর দূর্ভীক্ষের সময় ভারত ও আমাদেরকে জরুরি খাদ্য সাহায্য দিতে পারেনি। খাদ্য পণ্যে ভারত আমাদের নির্ভরশীলতার স্থান। অন্তত আমদানির শতকরা হিসাবে সে কথা বলাই যেতে পারে। কিন্তু ভারত আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার ঝুকির একটি দিক উন্মুক্ত করেছে। অন্য দেশ কখন খাদ্য রপ্তানি করবে আর কখন বন্ধ করবে সেটা নিয়ন্ত্রন আমাদের হাতে নেই। তবে বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা বলে জরুরি প্রয়োজনে ভরসা করার মত খাদ্য আমদানির পার্টনার দেশ আমাদের নেই। তাহলে করনীয় কি? বিগত ৪-৫ বছর ধরে বিভিন্ন লেখায় আমি যে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিতে বলেছি সেটি হল সিঙ্গেল কান্ট্রি এক্সপোজার কমানো। কোন নির্দিষ্ট দেশের উপর সেন্সটিভ পণ্যে মোট চাহিদার ৩০% এর বেশি নির্ভর করা উচিত না। বরং খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মাঝে বাংলাদেশ প্রস্তাব করেছিল সার্কের অধীনে ফুড ব্যাংক প্রতিষ্ঠার। কিন্তু সার্ক একটি অকার্যকর সংস্থা। এর অধীনে কোন ইনিশিয়েটিভ নিলে তার বাস্তবায়ন নিয়ে আমি আশাবাদী হই না।
বাংলাদেশের উচিত হবে নিচের কাজ গুলি করা:
স্পর্শকাতর নিত্য পণ্যে কোন একক দেশ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে আমদানির সিলিং নির্ধারন করে দিতে হবে। তবে মূল্য যখন কম থাকে তখন বাফার স্টক বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমদানি করা যেতে পারে যেটা দিয়ে ঘাটতির সময় মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। একক দেশের পরিবর্তে ধান, গম, তেল, পেয়াজের মত পণ্যে ৪-৫ টা দেশের সমন্বয়ে বা আঞ্চলিক খাদ্য নিরাপত্তা জোট গড়ে তোলা যেতে পারে। জোটের মুল লক্ষ থাকবে খাদ্য পণ্যের অপচয় রোধ করা এবং সদস্য দেশগুলির ভেতর উদ্বৃত্ত খাদ্য বিনিময়। অনেক সময় এমন হয় যে আমাদের দেশে টমেটো ১ টাকা কেজি। কৃষক জমি থেকে তুলছে না। একি সময়ে যদি অন্য দেশে সেটার চাহিদা থাকে তবে বিনিময় করা যেতে পারে। আবার প্রতেকটা দেশ খাদ্য সঙ্কটে পড়লে জোট ভিত্তিক ফুড ব্যাংক থেকে জরুরি খাদ্য সহায়তা পেতে পারবে।অফ কান্টি ফার্মিং করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে বার্মার সাথে সুসম্পর্কের বিকল্প নেই। আফ্রিকার দেশগুলির সাথে জাতিসংঘ মিশনের কারনে বাংলাদেশের পরিচিতি আছে। বাংলাদেশ চাইলে এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। আমাদের উন্নত কৃষি প্রযুক্তি আমরা সেখানে সরবরাহ করতে পারি। এতে আফ্রিকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ভূমিকা থাকবে সেই সাথে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর ক্ষেত্রে দেসগুলির উদ্বৃত্ত খাদ্য আমদানি করা যেতে পারে। তবে বিষয়গুলি নিয়ে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা জরুরি। ঝিমিয়ে পড়লে হবে না।
উন্নত যোগাযোগ ব্যাবস্থায় বিনিয়োগ করতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীন অবাকাঠামোতে। এতে সরবরাহ ব্যাবস্থা শক্ত হবে।
প্রযুক্তির ব্যাবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রাইসিং ওয়ে ডকুমেন্টেড হতে হবে। এমন করা যায় যে কৃষি ভর্তুকির মাধ্যমে যে ১০-১২ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়, তার ৫% বা ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করা যেতে পারে সরকারি কোন এপের মাধ্যমে কৃষক পণ্য বিক্রি করলে। সে তথ্য এপে লিপিবদ্ধ হবে।


বিজ্ঞাপন