দেশের বন্যা পরিস্থিতি,ছোট খরচকে এত বড় করা হয় কেন?

Uncategorized জাতীয়

কুটনৈতিক বিশ্লেষক ঃ দেশের মধ্যাংশ পুড়ছে তীব্র দাবাদহে অন্যদিকে উত্তর পূর্বাঞ্চল ডুবছে পানির নীচে।সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি হয়েছে।হাওর অঞ্চলে বাধ ভেংগে আগেই ফসলের ক্ষতি হয়েছে,পুড়েছে কৃষকের ভাগ্য।এবার সিলেট এবং এর আশেপাশের জেলাগুলো এক যুগের মাঝে সবচাইতে ভয়াবহ বন্যায় পতিত হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের চাইতে মানবসৃষ্ট কারনই যেখানে তার প্রধান ভুমিকা রেখেছে। জিওগ্রাফিক সার্ভে এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস এর কয়েকবছরের ডাটা থেকে দেখা যায় উজানের মেঘালয়ে প্রতি বছরই বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়েছে।এমন নয় যে হঠাতই বৃষ্টিপাত বেড়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে গ্রীষ্ম প্রলম্বিত হওয়া,বর্ষায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হওয়ার মত দুর্যোগ বেড়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড মুলত দেশের ক্রিটিক্যাল একটি স্থাপনা-বাধ(যেটি দুর্যোগ প্রশমনের অবকাঠামোগত ব্যবস্থা) মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণ করবার একটি গুরুদায়িত্ব পালন করে, একই সাথে নদীর সার্ভে করার কিছু কাজ এবং প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে নদী দখলমুক্ত, ড্রেজিং করার গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে এই পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপর। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত অধিকাংশ বাধ মাটি নির্মিত।তবে আধুনিকতার যুগে এসেও কংক্রিটের বাধের মতই মাটির বাধ স্থায়ী যদি এর কাংখিত পাকাকরণ করা যায়।সাম্প্রতিক কালে ভারতের বিভিন্ন বন্যা পরিস্থিতিতে মুলত গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে থাকা স্থায়ী মাটির বাধই বন্যার ক্ষতি এড়াতে পেরেছিল। বাংলাদেশের মাটি গুনগতভাবে উন্নত হওয়া সত্বেও প্রতি বছর বর্ষাতেই বাধ ভেংগে যাচ্ছে।যার মুল কারন হলো এসব বাধের পাকাকরণ না করা।বাধের পাকাকরণ বলতে বৃক্ষ,ঘাস কিংবা বালি-মাটির সঠিক মিশ্রণের মাধ্যমে মাটিকে কংক্রিটের মতই শক্তিশালী করাকে বোঝায়, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের মাটির বাধগুলোর স্থায়ী পাকাকরণ সম্পন্ন হয়নি।কেননা পাকাকরন একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া এবং শুধু পাকাকরণ এ শেষ নয়,প্রতি মাসে বাধগুলোকে এবং তিনমাস অন্তর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট গুলো সয়েল টেস্টি৷ কারিগরী উন্নয়ন চলমান থাকা প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য রাষ্ট্র এবং প্রশাসন তা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং হচ্ছে।তার চাইতেও বড় দুর্ভাগ্য এ বন্যা পরিস্থিতির জন্য দেশের জনগন ও অনেকাংশে দায়ী। রিপোর্ট বলছে, সিলেট নগরীর প্রাকৃতিক ছড়া,দীঘি এবং পুকুরের ৭০% শতাংশ বাস্তবে নেই।সুরমা দেশের সবচাইতে দীর্ঘ নদী হওয়া সত্বেও ২০১১ সালের শেষ থেকে সুরমায় আর নাব্যতা নেই।পুরো শহরের সুয়ারেজ সিস্টেম সুরমায় থাকায় পলিথিন ব্যাগ,বোতল সুরমার তলদেশে জমেছে বছরের পর বছর। একই সাথে নাব্যতা হারানো সুরমার কানিশাইলে ২০১৮ সালে ৬০০মি ড্রেজিং করা হয়,এরপর এ প্রকল্প আর এগোয়নি।সিলেটে আর্মির ক্যান্টনমেন্ট করা হয়েছে সরকারী দীঘিকে ভরাট করে, আবাসিক প্লট করতে গিয়ে মারা পড়েছে খাল এবং ছড়া।
সিলেটে ৫৩ টির মত দীঘি থাকার কথা থাকলেও আছে ১১ টির মত,প্রাকৃতিক ছড়া দখল করে বানানো হয়েছে শপিং মল এবং আবাসিক এলাকা।
স্বল্পমেয়াদে লাভ করতে গিয়ে রাষ্ট্র এবং জনগন উভয়ই তাদের নৈতিকতা হারিয়েছেন।শুধুমাত্র বন্যার প্রথম দিনেই সিলেট শহরের বিপনীবিতানগুলোতে ৫০ কোটি টাকার বেশী ক্ষতি হয়েছে।২০২১ সাল থেকে সুরমা নদী ড্রেজিং করার জন্য ১৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প ফাইলবন্দী হয়ে আছে। দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা সুরমার জলমুখ ২০১১ সাল থেকেই সংকুচিত অবস্থায় রয়েছে।২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ ভারত যৌথ কমিশনের বৈঠকের পর দোদুল্যমান অবস্থায় আছে সুরমার মুখ ড্রেজিং করার প্রকল্প। অন্যদিকে,সিলেটের নদীস্থান উদ্ধারের প্রকল্প এবং অভিযান ঝিমিয়ে পড়েছে বছরখানেক হলো।অনেক উচ্ছেদ হতে যাওয়া স্থাপনা নিয়ে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে। মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে বিগত ৬ দিনে ১০৬৫ মিমি বৃষ্টিপাত হলেও সে পানি ধারন করবার ক্ষমতা ছিল সুরমা নদীর।মাত্র ১৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প সিলেটের ক্ষতি করেছে তার ১০ গুন।সুনামগঞ্জ এবং এর আশেপাশের এলাকার মাছের খামার,ফসলি জমি সবই তলিয়ে গিয়েছে।দেখা দিয়েছে খাবার এবং পানির সংকট। দেশ তার নেট উৎপাদিত ধান এবং প্রানীজ খাদ্যের একটি বড় অংশ হারালো।টাকার হিসেবে যা হয়ত ড্রেজিং করার খরচের ১০০ গুনের হিসেব পার করবে।রাস্তাঘাট মেরামত, ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়ে তোলা,ত্রাণ দেয়া,পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধ সময় এবং অর্থ সাপেক্ষ।অথচ দেশের সম্পদের এমন অপচয় রোধের উপায় ছিল। প্রশাসন চাইলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর ড্রেজিং কাজ জরুরী ভিত্তিতে নিতে পারে,এরপর না হয় উপনদী এবং শাখানদী, হাওর,বিল রক্ষার প্রকল্প হাতে নেয়া সম্ভব হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রায় সকল নদীই দূষণ এবং দখলের ভারে জর্জরিত এবং মৃতপ্রায়।অথচ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কিংবা নদীতে বজ্র ফেলার জন্য ট্যাক্স ধার্য হচ্ছেনা।আইন আছে,কিন্তু তার প্রয়োগ সীমিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ।জনসাধারণ এর লোভ এবং দখলের মানষিকতা তাতে ঘি ঢেলেছে,প্রশাসনের উদাসীনতা হয়েছে শাপে-বর। নদী,খাল,হাওর গুলোকে তাদের পুরাতন রুপ ফেরত দিতে না পারলে ক্ষতির হার বাড়বেই।বাংলাদেশ ২১০০ সাল ব্যাপী ডেল্টা প্লান বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। তিস্তা মহাপ্রকল্পের মত প্রজেক্টের চাইতে নদী খনন,নদী তীর সবুজায়ন,বাধ পাকাকরণ প্রকল্পগুলো অন্তত জরুরী ভিত্তিতে বাস্তবায়ন জরুরী।২ বিলিয়ন ডলার এর কম খরচ করেই দেশের নদীগুলোর ড্রেজিং করা সম্ভব যার মধ্যে ড্রেজিং করে পাওয়া পলিতেই বাধ নির্মাণ এবং তার সবুজায়ন করে পাকাকরণ করা সম্ভব। ভাটির দেশ হওয়ার নদীর গতিপথ রোধ করে নগরায়ণ কখনো সমাধান হতে পারেনা।অন্যদিকে উজানের দেশ থেকে পলিমাটি আসায় কংক্রিটের বাধ দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জলবায়ুতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। নেদারল্যান্ডস এর মডেল ফলো করার পরিকল্পনা থাকতেও বাধ স্থাপন এবং রক্ষণাবেক্ষণ নীতিতে বাংলাদেশ এখনো অতীতেই পড়ে আছে।যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মাটির বাধ বাংলাদেশী বাধের চাইতেও শক্তিশালী ১০০০০ কিমি নদীপথের মধ্যে নাব্য নদীপথ ২০০০ কিমি এর নিচে নেমে যাওয়া দেশের জন্য এক অশনী সংকেত।


বিজ্ঞাপন