নিজস্ব প্রতিবেদক ঃ মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইরের চাঞ্চল্যকর গর্ভবতী জুলেখা (১৯) হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী সিরাজুল (৩৯)’কে ১৯ বছর পর অবশেষে নারায়ণগঞ্জের চর সৈয়দপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৪, এ খবর সংশ্লিষ্ট সুত্রের।
জানা গেছে, র্যাব-৪ বিগত দিনগুলোতে চাঞ্চল্যকর ও ক্লুলেস হত্যাকান্ডের আসামী গ্রেফতারের অভিযান পরিচালনা করে উল্লেখযোগ্য আসামী গ্রেফতার করে যার মধ্যে সাভারের অধ্যক্ষ মিন্টু চন্দ্র বর্মন হত্যার রহস্য উদঘাটনপূর্বক আসামীদের গ্রেফতার, চাঞ্চল্যকর শাহীন উদ্দিন হত্যা মামলার আসামীদের গ্রেফতার, সাভারের ক্লুলেস ফাতিমা হত্যা রহস্য উদঘাটনসহ অসংখ্য ক্লুলেস হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করা এবং আসামীদের গ্রেফতার করা হয়।
এছাড়া ২০-৩০ বছর পলাতক যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রাপ্ত ছদ্মবেশী বেশ কয়েকজন দুধর্ষ খুনী, ডাকাত এবং ধর্ষককে গ্রেফতার করা হয়। গত কয়েকদিন পূর্বে ৩৯ বছর ধরে পলাতক হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী কাওছার (৬৩)’কে ঢাকার বারিধারা থেকে গ্রেফতার করা হয়। যার প্রেক্ষিতে সার্বিক মূল্যায়নে ২০২১ সালে র্যাব-৪ ক্লুলেস অপরাধ রহস্য উদঘাটনে প্রথম স্থান লাভ করে।
এরই ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব-৪ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল মানিকগঞ্জের চাঞ্চল্যকর গর্ভবতী জুলেখা (১৯) হত্যা মামলার দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে পলাতক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী’কে গ্রেফতার করার জন্য গত বুধবার ২২ জুন, রাতে নারায়ণগঞ্জ জেলার সদর থানাধীন চর সৈয়দপুর এলাকায় সাড়াশি অভিযান পরিচালনা করে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামী সিরাজুল (৪০)’কে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়।
গ্রেফতারকৃত আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদ ও ঘটনার বিবরণে জানা যায় যে, গত ২০০২ সালের জুলাই মাস নাগাদ গ্রেফতারকৃত আসামী মানিকগঞ্জ সদর থানার বাহের চর এলাকার সিরাজুল ইসলাম এর সাথে সিংগাইর থানাধীন উত্তর জামশা গ্রামের জনৈক মোঃ আব্দুল জলিল এর মেয়ে ভিকটিম জুলেখা বেগমের পারিবারিকভাবে বিবাহ হয়। বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে বেশকিছু নগদ অর্থ, গহণা এবং আসবাবপত্র বরপক্ষকে প্রদান করা হয়।
তদুপরি বিয়ের পর হতে আসামী সিরাজুল ভিকটিমকে আরো যৌতুকের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতো এবং ভিকটিমকে যৌতুক না দিতে পারলে তালাক দিবে মর্মে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করতো। ইতিমধ্যে ভিকটিম ৮ মাসের অন্তঃসত্তা হয়ে পড়ে। ভিকটিমের পরিবার থেকে আসামীর কাঙ্খিত পর্যাপ্ত যৌতুক না পাওয়ার ফলে আসামির সাথে ভিকটিমের পারিবারিক কলহ আরো বেড়ে যায়।
এক পর্যায়ে আসামি সিরাজুল তার প্রতিবেশী মোশারফ নামে এক যুবকের সাথে ভিকটিমের পরকীয়ার সম্পর্ক আছে মর্মে সম্পূর্ণ মিথ্যা ভ‚য়া অমূলক অভিযোগ তোলে এবং ভিকটিমকে আরো বেশি নির্যাতন করতে থাকে। আসামির নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ভিকটিমের বাবা ও ভাইসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে আসামীর গ্রামে সালিশ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
সেখানে ভিকটিমের কোনো দোষ না পেয়ে এবং পরকীয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমানিত হওয়ায় সালিশে উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আসামি সিরাজুল কে গালিগালাজ করে এবং ভিকটিমকে নির্যাতন না করার জন্য সতর্ক করে দেয়। এই ঘটনার পর আসামি সিরাজুল আরও ক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং মনে মনে ভিকটিমকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ৫ ডিসেম্বর ২০০৩ সালে আসামী সিরাজুল ভিকটিমকে নিয়ে শ^শুর বাড়ি সিংগাইরের উত্তর জামশা গ্রামে যায়। ৬ ডিসেম্বর ২০০৩ সালে আসামী সিরাজুল ভিকটিম জুলেখাকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলে মানিকগঞ্জ শহরে নিয়ে যায় এবং বিভিন্ন অজুহাতে ইচ্ছাকৃতভাবে কালক্ষেপণ করে গভীর রাতে শ^শুর বাড়ির উদ্দেশ্যে মানিকগঞ্জ শহর হতে রওনা হয়। মানিকগঞ্জ শহর থেকে আসামী সিরাজুল ভিকটিমকে নিয়ে শশুর বাড়ি না গিয়ে কৌশলে তার শ্বশুর বাড়ির নিকটবর্তী কালীগঙ্গা নদীর পাড়ে নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আসামি তার ব্যাগে থাকা গামছা বের করে ভিকটিম জুলেখার গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে নির্মমভাবে হত্যা করে নদীর পাড়ে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এই মর্মান্তিক ঘটনায় ভিকটিম জুলেখার নিহত হওয়ার পাশাপশি তার ০৮ মাসের গর্ভস্থ সন্তানও হত্যার শিকার হয়। পরবর্তীতে ৭ ডিসেম্বর ২০০৩ সালে থানা পুলিশ কর্তৃক ভিকটিমের মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়।
একই দিনে উক্ত চাঞ্চল্যকর ঘটনায় ভিকটিমের বাবা মোঃ আব্দুল জলিল বাদী হয়ে সিংগাইর থানায় আসামি সিরাজুলসহ তার বড় ভাই রফিকুল, মা রাবেয়া বেগম, খালু শামসুল, চাচা ফাইজুদ্দিন ও তাইজুদ্দিন এবং মামা আবুল হোসেন সহ সর্বমোট ০৭ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন যার মামলা নং-১৬(১২)০৩, তারিখঃ ০৭/১২/২০০৩, ধারা-২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এর ধারা ১১(ক)/৩০। সিংগাইর থানা পুলিশ উক্ত মামলার এজাহারনামীয় আসামি শামসুলকে গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে প্রেরণ করলে উক্ত আসামি ৩ মাস হাজত খাটার পর জামিনে মুক্তি পায়। উক্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মামলার তদন্ত শেষে এজাহারনামীয় আসামী ভিকটিমের স্বামী সিরাজুল, ভাসুর রফিকুল, শাশুড়ী রাবেয়া এবং খালু শ^শুর শামসুলসহ সর্বমোট ০৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট প্রদান করে এবং এজাহারনামীয় বাকি ৩ জন আসামী ফাইজ উদ্দিন, তাইজুদ্দিন ও আবুল হোসেন এর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চার্জশীট থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন। পরবর্তীতে চার্জশিটের ভিত্তিতে বিজ্ঞ আদালত উক্ত মামলার বিচারকার্য পরিচালনা করেন এবং পর্যাপ্ত স্বাক্ষ্য প্রমাণ ও উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ভিকটিম জুলেখাকে হত্যাকান্ডে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অপরাধে ২০০৫ সালের শেষের দিকে মানিকগঞ্জ জেলার বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ মোঃ মোতাহার হোসেন চার্জশীটে অভিযুক্ত