পদ্মা সেতুর আজ উদ্বোধন ও একটি ইতিহাস

Uncategorized অন্যান্য

মন্তব্য প্রতিবেদন ঃ সময়ের সাথে সাথে অভিজ্ঞতা বাড়ে। মানসিকতা, ভাবনায় আসে পরিবর্তন। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের সময় এখন দিন থেকে ঘন্টায় নেমে এসেছে। আজ আমার ব্যাক্তিগত কিছু উপলব্ধির কথা বলি। যমুনা সেতুর নির্মাণ যখন চলছে তখন স্মারক মুদ্রা হিসাবে পাঁচ টাকার কয়েন বাজারে ছাড়া হয়। এই কয়েন হাতে পাবার পর অবাক হয়ে চেয়ে থাকতাম। একটা হাতে আসলে সেটা আর কখনোই খরচ করা হত না। যত্নের ধনের মত আগলে রাখা যাকে বলে। ১৯৯৮ এ যেদিন উদ্বোধন হল, সেদিন মনে আছে প্রতিটা মানুষের ভেতর চাপা উত্তেজনা দেখেছি। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সাথে অন্য দেশের অনেক পার্থক্য। নদীগুলির জন্য এদেশের মাটি বিশ্বের সবথেকে উর্বর। প্রতিটা মাটি এখানে এক খন্ড স্বর্ন। তবে এই নদীকে ঘিরে এদেশের মানুষের দু:খ দুর্দশা শত বছর ধরে গানে, ছড়ায় সাহিত্যে বিকশিত হয়েছে। দেশটাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা বড় নদী হল যমুনা ও পদ্মা। গোয়ালন্দে যমুনা পদ্মার মিলনের পর দুই নদীর পূর্ন ধ্বংস ক্ষমতায় বিলীন হয়েছে হাজার হাজার গ্রাম। নদী গুলিতে সলিলসমাধি হয়েছে অজস্র তাজা প্রাণের।উত্তরবঙের মঙ্গার কবলে কজন মারা গেলে সেই খবর প্রতি বছর খবরের কাগজে আসত। উত্তরবঙ্গের মঙ্গার প্রভাব দূর করবার জন্য যমুনার উপর একটি সেতু করবার দাবি উঠেছিল সেই ১৯৪৯ সালে! প্রায় অর্ধ শতাব্দি পর যমুনা যখন বাস্তবে রূপ নিল তখন সেতুর জন্য আবেগ উচ্ছাসে সেদিন সবাই টিভির সামনে, রেডিও হাতে। মনে আছে যমুনা সেতু সে সময় বিশ্বের ১১তম বৃহৎ সেতু ছিল। ক্যালেন্ডারে তখন ঘরে ঘরে যমুনা সেতুর ছবি। কিন্তু বাংলার নরম পলি মাটি সম্পর্কে বিদেশিদের ধারনা কম। সেতুর এক কোনায় যখন রেল চলার সুযোগ রাখা হল তখনো কেউ আন্দাজ করেনি কতবড় ভূল হয়ে গেছে। নদীর নরম মাটিতে এক পাশের রেলের যে অতিরিক্ত চাপ পড়ে তাতে দক্ষিণ কোরিয়ার নির্মিত সেতুটির ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সবার সামনে চলে আসে। তখনো কেউ বিশ্বাস করেনি যমুনা পদ্মার মিলিত সবথেকে ভয়ঙ্কর অংশে সেতু হতে পারে। পদ্মা সেতু নিয়ে রাজনীতি অনেক হয়েছে। রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে যতটুকু মনে পড়ে ততটুকুই বলি। যখন সেতু কোথায় হবে সেটা নিয়ে তুমুল বিতর্ক, তখন আমি পক্ষে ছিলাম দৌলতদিয়া পাটুরিয়া হয়ে সেতু করার। এরকম ধারনার পেছনে কারন ও ছিল। এই রুটে যে পরিমান গাড়ি যাতায়াত করে সেটার ৪ ভাগের এক ভাগ তখন মাওয়া দিয়ে করত না। মাওয়া ছিল মূলত ছোট যানগুলির জন্য। পরিবহন বাসের প্রায় সবগুলিই এই রুট ব্যাবহার করত। এরকম ধারনার পেছনে যে কারনগুলি দায়ী মনে হয় সেটি হল সঠিক তথ্যের অভাব, সরকারের উপর আস্থার ঘাটতি, আর এদেশে পরিকল্পনাহীন অবকাঠামো নির্মাণ আর পক্ষপাতীত্ব। এই চারটি বিষয়েই ব্যাখ্যা করা জরুরি। প্রথম পয়েন্ট তথ্যের অভাব। আমার ধারনা ছিলনা মানিকগঞ্জ হয়ে পাটুরিয়া হয়ে ঢাকার যে দুরত্ব তার অর্ধেকের কম দুরত্ব মাওয়া থেকে ঢাকার। এই তথ্য ও আমার জানা ছিলনা বিদ্যমান দৌলতদিয়া পাটুরিয়া রুটের পরিবর্তে মাওয়া জাজিরা রুটে দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটা জেলার সাথে দুরত্ব কতটা কমে যায়।সরকারের উপর আস্থার ঘাটতি কথাটার ব্যাখা করলে একটু দীর্ঘ হবে। এর কারন হল আমাদের দেশে অবকাঠামো গড়ার সময় সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ সামনে রেখে করা হয়না। কিন্তু এখন আমরা দেখতেছি যে, সম্পূর্ন নতুন ভাবে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত সড়ক ও রেল পথ নির্মাণের মাধ্যমে দুরত্ব সড়ক পথে ১০০ কিলোমিটারের বেশি কমিয়ে আনা হচ্ছে। রেল পথে এই দুরত্ব কমছে ২৫০ কিলোমিটারের মত। যমুনার কথা যদি ধরি। যমুনা সেতু ছিল শুধুই চার লেন সড়ক ও এক ট্রাকের রেল। প্রকল্পটি শুধু সেতু প্রকল্পই। এর আগে পিছে সড়ক যে সব দুইলেন, সেগুলা বিগত ২৫ বছর ধরে দুই লেনেই ছিল। অর্থাৎ লং টার্ম ভিশন নিয়ে করা হয়নি। সেতুর প্রয়োজন তাই সেতু করেছে। বর্তমানে পদ্মায় শুধু সেতু প্রকল্প নয়, একি সাথে দুরত্ব কমিয়ে দক্ষিণের মূল সড়ক, নদী ও সমুন্দ্র বন্দরকে এক সুতোয় বাধা হচ্ছে। এশিয়ান হাইওয়ের চিন্তাও রয়েছে। সেতুর সাথে সম্পুর্ন নতুন ভাবে এই রুটে রেল করা হয়েছে। যেসব জেলা স্বাধীনতা আগে পরে কখনো রেল সেবা পায়নি তাদেরকে যুক্ত করতে সম্পূর্ন নতুন রেল রুট স্থাপিত হচ্ছে। এখন যেমন সাসেক করিডোর, এশিয়ান হাইওয়ে, বন্দর ঘিরে সংযোগ, এক্সপ্রেসওয়ে গড়া নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনার অংশ হিসাবে একেকটা অবকাঠামো হচ্ছে, আগে এরকম ছিলনা। এখন যেমন ঢাকাকে পাশ কাটিয়ে রিং রোড, বাইপাস করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে এবং প্রতিটা জাতীয় মহাসড়ক একটি আরেকটির সাথে যুক্ত হবার জন্য অবকাঠামো গড়া হচ্ছে এগুলার ধারনা তখন ছিলনা। স্বাভাবিক ভাবে ধরেই নেয়া হয়েছিল যে শুধু প্রয়োজের খাতিরে সেতুই করা হবে। দুপাশের রোড আগের মতই দুই লেনের থাকবে। এক্সপ্রেসওয়ে কি জিনিস সেটাই তো ধারনা ছিলনা। সবশেষ হল পক্ষপাতীত্ব। যেহেতু নিজে কখনো মাওয়া যায়নি, এবং যশোর থেকে ঢাকা যাবার জন্য শুধু দৌলতদিয়া পাটুরিয়াই দেখেছি এজন্য একটা পক্ষপাতমূলক প্রভাব ছিল আমার সিদ্ধান্তে। যাহোক, মূল কথায় আসি রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ কে কি ডায়ালগ দিলেন এটা নিয়ে কখনই মাথা ব্যাথা ছিলনা। তবে শিক্ষিত সমাজের মত ও পত্রিকার কলামগুলির প্রভাব সবথেকে বেশি ছিল। অবস্থা এমন যে আমার নিজের সিদ্ধান্ত বা ভাববার জন্য যে রসদ সেটা হল পত্রিকায় যেসব খবর ছাপা হয়। তত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও দেখেছি সেতু নিয়ে অনেক বিস্তর লেখা। কেউ বলে প্রমত্তা পদ্মায় স্টিল স্ট্রাকচারে সেতু করা সহজ। কেউ হলে বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ দেশ, এখানে বৃষ্টিপাত বেশি। স্টিল স্ট্রাকচারে করলে সেতু টেকসই হবেনা। যখন বিশ্ব ব্যাংক নিয়ে দাদাগিরি শুরু হল তখন সবার মত আমিও হতাশ হয়েছিলাম। সেতু তাহলে সত্যিই হচ্ছে না? এত টাকা কই পাব আমরা? এর আগে ছোট ছোট প্রকল্প করতেও বিশ্ব ব্যাংক ও অন্যান্য দাতাদের কাছে আমাদের হাত পাততে হয়েছে। বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রীকে যেতে হত প্যারিসে। দাতা সংস্থাদের কাছ থেকে কত কি পাওয়া যাবে সেই হিসাবে বাজেট সাজানো হবে। এরকম পরিস্থিতিতে যখন ড. আকবর আলী খান, সাবেক গভর্নর শ্রদ্ধেয় সালেহ উদ্দিন আহমেদের মত মানুষগুলি সেতু বাস্তবায়ন নিয়ে নিরাশার বার্তা দেন তখন আমরা কোন ছার।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *