মন্তব্য কলাম ঃ নদী দিয়ে প্রবাহিত পানির পরিমান হিসাবে আমাজন নদী হল বিশ্বের বৃহত্তম। দৈর্ঘের হিসাবে নদীটি প্রায় ৬,৯০০ কিলোমিটার লম্বা। দীর্ঘপথে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভাগ করে দুপাশে বিশ্বের বৃহৎ আমাজন বনকে আগলে রেখেছে এই বন।কিন্তু অবাক করার মত বিষয় হল এই নদীতে কোন সেতু আজ পর্যন্ত কেউ নির্মান করেনি। কিন্তু কেন? কি কারনে এত বছরেও আমাজনে সেতু নির্মিত হয়নি? আজ এই প্রশ্নের উত্তর জানব।
পেরু, কলম্বিয়া ও ব্রাজিলে আমাজন বেসিনে প্রায় তিন কোটি মানুষের বাস। বিশ্বের দীর্ঘতম নদী নীল নদ। শুধুমাত্র মিশরেই নীলনদের উপর ৯ টা সেতু আছে। ইউরোপের দানিয়ুব নদীতে আছে প্রায় ১৩৩ টি সেতু। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসবে আমাজনের মত দীর্ঘ নদীতে তাহলে সেতু নেই কেন? সহজ উত্তর হল আমাজন ঘিরে জনসংখ্যা ঘনত্ব কম। এই নদী পার হতে ফেরি বা অন্যান্য জলযান ব্যাবহার হয়ে আসছে। একারনে এখানে সেতু করবার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু যদি সেতু তৈরি করতে হয় তবে কি ধরনের টেকনিক্যাল, লজিস্টিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে আসুন জেনে নেই।
প্রথমত আমাজন নদীতে সেতু করতে গেলে সেতুর জন্য আদর্শ লোকেশন পাওয়া খুব কঠিন। প্রকৃতিক কিছু প্রতিবন্ধকতাকে আগে জয় করতে হবে আমাজনে সেতু নির্মান করবার আগে। এই নদীর সাথে জলাভূমি ও নরম মাটির সমস্যা মোকাবেলায় সেতুর ভায়াডাক্ট অনেক বড় করে করতে হবে। ভায়াডাক্ট এর দৈর্ঘ হিসাবে করলে বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ কিলোমিটার । আরেকটু ভেঙ্গে বললে সেতুর মূল স্পানের থেকে বেশ দুরত্বে ভূমি থেকে সেতুতে উঠা শুরু হয়। এটাই ভায়াডাক্ট। অর্থাৎ যেখান থেকে সেতুতে উঠবার এলিভেশন শুরু হয়েছে।
আরবকটি বড় সমস্যা হল সফট সয়েলের জন্য আমাজনে সেতু করতে গেলে ফাউন্ডেশন অনেক গভীরে করতে হবে যার জন্য বড় ধরনের খরচের হিসাব রয়েছে। আমাজন ওয়াটার ইনিশিয়েভের হিসাবে এই নদীর প্রবাহ দ্রুত পরিবর্তন হয়। একেক স্থানের গভীরতা একেকরকম। রিভার বেডের উপর জমা পলি বা সেডিমেন্ট দ্রুত পরিবর্তনশীল যেটা এই নদীতে সেতু নির্মাণ অনেক চ্যালেঞ্জিং। নদীর পাড় ও সবসময় ভাঙ্গনের কবলে রয়েছে এবং গতিপথ ও নিয়মিত পরিবির্তনশীল। একারনে নদীশাসন ও বড় চ্যালেঞ্জ ও আর্থিকভাবে খরুচে। এই ধরনের বৈশিষ্ট্য শুধুযে আমাজনে রয়েছে এমন নয়। বিশ্বের অনেক নদীর ধরন এমন। কিন্তু সমস্যা হল তিব্রতা নিয়ে। উদাহরন হিসাবে পদ্মার কথা বলা যায়। ভারতের গঙ্গা নদীতে পাড় ভাঙ্গে। গতিপথ ও চেঞ্জ হয়। কিন্তু গঙ্গা যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এখানেও ভাঙ্গনের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে। কিন্তু গোয়ালন্দে যখন দুটি বৃহৎ নদী পদ্মা ও যমুনা মিলিত হয়ে পদ্মা নাম নিয়েছে তখন এই দুই নদীর মিলিত পানি প্রবাহ পদ্মাকে দিয়েছে ভয়ঙ্কর ভাঙ্গন শক্তি। কুষ্টিয়া অংশের পদ্মা এবং গোয়ালন্দের পরবর্তী অংশের পদ্মা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে এটির ভাঙ্গন রূপ, গতি প্রকৃতি হয়েছে আরো আগ্রাসী। একি নদী গঙ্গা, পদ্মা। কিন্তু ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার তিব্রতা একেক স্থানে একেকরকম। আমাজনের ক্ষেত্রে এই তিব্রতা অনেক বেশি যে কারনে এখানে সেতু নির্মাণ বেশ চ্যালেঞ্জিং।
জুন থেকে নভেম্বরে আমাজনের গড় প্রশস্ততা থাকে ৩.২ থেকে ৯.৭ কিলোমিটার। আর ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলে এই নদীর প্রসস্থতা বেড়ে ৪৮ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়। শুকনো সিজনের থেকে পানির গভীরতার হেরফের হয় প্রায় ৫০ ফুট!এখন পর্যন্ত আমাজনে কোন সেতু নির্মান না হলেও ২০১১ সালে নেগ্রো রিভারে একটি সেতু নির্মাণ শেষ হয়। এই নদী আমাজনের একটি শাখা নদী। কয়েকদফা ডেডলাইন পিছিয়ে এ বছরে সব কিছু ঠিক থাকলে পেরুর নানাই নদীর উপর নানাই ব্রিজ নির্মাণ ২০২২ এ শেষ হবে। এটিও আমাজনের শাখা নদী।
২০১৯ সালে ব্রাজিল রিও ব্রাঙ্কো প্রকল্পের অধীনে আমাজনের উপর একটি সেতু নির্মানের ঘোষনা দেয়। কিন্তু এরপর আর অগগতি নেই। অনেকের মতে বেনিফিট কস্ট হিসাব করলে এই সেতু লাভের তুলনায় অনেক বেশু খরুচে হবে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের অনেক আগে থেকেই ভারত ও বাংলাদেশে সেতুর খরচ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ভারতের হিসাব মতে এই সেতু নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই। এর থেকে ভারতের বগিবিল ও ভূপেন হাজারিকা সেতু (ধোলা-সাদিয়া সেতু) অনেক এগিয়ে। কারন ভারত নিজেদের ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে এটা করেছে। আমাদের দেশেও অনেকে অনেক ভাবে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে কথার ধরন এমন যে এক তলা বাড়ি নির্মাণ করতে ১০ লক্ষ টাকা লাগে। ১০ তলা করতে তাহলে ১ কোটিতে হয়ে যাওয়ার কথা। আবার ঘুরিয়ে বললে মোবাইল ফোন যেটা দিয়ে ছবি তোলা যায় সেটা আইফোন বানায় লাখ টাকায়। অথচ চীন বানায় ১০ হাজার টাকায়। জিনিস কিন্তু একি।
আসলে এভাবে তুলনা করলে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা না করা ভাল। বিশ্বের সব থেকে বেশি পলি বা সেডিমেন্ট বহন করা নদীর ভেতর আমাজন আছে শীর্ষে। পলি পরিবহনের ক্ষেত্রে ৪ নাম্বার অবস্থান ব্রহ্মপুত্র এর যেটা প্রতি সেকেন্ডে ৭ লক্ষ ঘণফুট পলি পরিবহন করে। বিশ্বের এই লিস্টে ৫ম অবস্থানে আছে গঙ্গা। এটি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৬.৬০ লক্ষ ঘনফুট পলি পরিবহন করে। আর ব্রহ্মপুত্র এবং গঙ্গার মিলিত রুপ হল পদ্মা। তাই পদ্মা দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৩.৬০ লক্ষ ঘনফুট পলি পরিবাহীত হয়। মিনিটে প্রায় ৮.১৬ কোটি ঘনফুট এবং ঘন্টায় ৪৮৯.৬০ কোটি ঘনফুট এবং দিনে প্রায় ১১৭৫০ কোটি ঘনফুট পলি পরিবহন করে।পদ্মার আসল সমস্যা হল এখানের মাটির নরম ভিত্তি। বাংলাদেশ বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ হবার ফলে এখানের মাটি তুলনামূলক নবীন এবং নরম। যার ফলে প্রতিনিয়ত চলছে ভাঙা গড়ার নিষ্ঠুর খেলা।
যেই স্থানে পদ্মা সেতু সেখানে পানি প্রবাহ হিসাব করলে আমাজনের পরেই পদ্মা। এখানে প্রতি সেকেন্ডে পানি প্রবাহ প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার ঘনমিটার। ২০ সেকেন্ডের প্রবাহিত পানির পরিমান আড়াই কোটির ঢাকা শহরের এক দিনের পানির ব্যাবহারের সমান।এত এত যে হিসাব, এগুলা বলার কারন হল, নিচের দুটি সেতু। একটি ভূপেন হাজারিকা ও অন্যটি বোগিবিল সেতু। চিত্রটি পরিস্কার ভাবে খেয়াল করুন। বিশেষ করে পেয়ার গুলা। এই পেয়ার মাওয়া পয়েন্টে করা হলে পদ্মা নদী সেতু সহ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে না সেই গ্যারান্টি নেই।
