দ্য ডাইহার্ড স্কার্মিশার বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ এর ৫১ তম শাহাদাৎ বার্ষিকী

Uncategorized জাতীয়


নিউজ ডেস্ক ঃ শেষবারের মতো পেছন ফিরে ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদের দিকে তাকালেন সিপাহি মোস্তফা। ’৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে ‘তঘমা-ই-জং’ আর ‘সিতারা-ই-হার্ব’ পাওয়া লোকটা জেদি বালকের মতো গাছের শিকড় আঁকড়ে গোঁ ধরে বসে আছেন। তার ডান বাহু আর ডান হাঁটুর ক্ষতস্থান থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছে, কিছুক্ষণ আগেই বিস্ফোরিত একটা পাকিস্তানি মর্টার শেলের স্প্লিন্টারের আঘাতেই এই দুরবস্থা। সিপাহি মোস্তফার কাঁধে ঝুলতে থাকা সিপাহি নান্নু মিয়া ফের ককিয়ে উঠলেন, গাছের শিকড় আঁকড়ে বসে থাকা মুমূর্ষু ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ শেষবারের মতো কমান্ডারসুলভ কপট উষ্মা নিয়ে ওদের চলে যেতে তাগাদা দিলেন। অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে আহত নান্নুকে কাঁধে নিয়ে সিপাহি মোস্তফা ত্রস্ত পায়ে সুতিপুরের মেইন ক্যাম্পের দিকে এগোতে লাগলেন।মোস্তফারা চলে যেতেই নূর মোহাম্মদ তার আহত হাত আর হাঁটু নিয়ে হিঁচড়ে নিজেকে একটু উঁচু করলেন, তারপর শত্রুর দিকে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে ফের নিচু হলেন। গুলিতে কাউকে হতাহত করতে পারলেন কি না, তা নিয়ে এখন আর কোনো ভাবনা নেই তার। একমাত্র লক্ষ্য এখন যতক্ষণ পারা যায় পাকিস্তানিদের কনফিউজড করে আটকে রাখা, যেন মোস্তফা আর নান্নু তার ফায়ারের কাভারে পিছু হটে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে যেতে পারেন। সুতিপুর গ্রামটা যশোর সেনানিবাসের কাছেই, কিন্তু ভারত সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় স্ট্র্যাটিজিকালি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই বরাবরই মুক্তিবাহিনী গ্রামটাকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে দখলে রেখেছে, আর শুরু থেকেই পাকিস্তানিরা সুতিপুর দখলের জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিল। এর আগে বেশ কয়েকবার পাকিস্তানিরা সুতিপুর দখল করতে এসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে ফিরেও গেছে। ছুটিপুরে মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্সে শত্রু যেন সরাসরি আক্রমণ করে বসতে না পারে, সে জন্যই সুতিপুরের সামনে গোয়াল হাটিতে মুক্তি সেনাদের একটা টহলদল (স্ট্যান্ডিং পেট্রোল) অবস্থান নিয়ে শত্রুর গতিবিধির ওপর নজর রাখত। এধরনের টহলদলের উদ্দেশ্য শত্রুর গতিবিধি নজরে রাখা, আক্রান্ত হলে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করা। ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদের টহলদল সেদিন গোয়ালহাটির ছুটিপুরে অবস্থান নিয়েছিল। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা সন্তর্পনে নূর মোহাম্মদের টহলদলকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলল। পাকিস্তানিদের ফায়ারের প্রচণ্ডতায় আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠল, দলের এলএমজি ম্যান সিপাহি নান্নু মিয়া গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন, কিন্তু অভিজ্ঞ নূর মোহাম্মদ নার্ভ হারালেন না। ৪টা রাইফেল আর ১টা এলএমজি নিয়ে নূর মোহাম্মদ এক অসম যুদ্ধে নামলেন। শুরুতেই একজনকে বার্তাবাহক হিসেবে পেছনে পাঠিয়ে দিলেন। সুতিপুরে অবস্থিত মূল ক্যাম্পে শত্রুর উপস্থিতি, গতিবিধি আর এখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাঠানোটা এখন সবচেয়ে জরুরি। এতে উপযুক্ত প্রস্তুতি আর করণীয় ঠিক করার জন্য তারা পর্যাপ্ত সময় পাবেন। তা ছাড়া তার কমান্ডার ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা যদি তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসতেই চান, তাহলে এই বার্তাবাহক তাকে পথ চিনিয়ে এখানে নিয়ে আসতে পারবেন। তাই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে নিজেদের বাঁচার রাস্তা বের করতে, আর যতটা সম্ভব পাকিস্তানিদের আটকে রাখার চেষ্টা করতে হবে যেন সুতিপুর মেইন ডিফেন্স প্রস্তুত হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়। নূর মোহাম্মদের হাতে বিকল্প এখন দুটি— এক. যতটা সম্ভব পাকিস্তানিদের আটকে রেখে সুতিপুর থেকে আসা উদ্ধারকারী দলের জন্য অপেক্ষা করা; দুই. একে অন্যকে কাভার করে ফায়ার করতে করতে পিছিয়ে এসে নিরাপদ দূরত্বে সরে আসা।
প্রথম বিকল্পটা নূর মোহাম্মদ বাতিল করে দিলেন। কারণ উদ্ধারকারী দল এসে পৌঁছানোর আগপর্যন্ত তিনজন মিলে এই সীমিত ফায়ার পাওয়ার নিয়ে পাকিস্তানিদের আটকে রাখাটা প্রায় অসম্ভব। ওরা ইতিমধ্যে ২ ইঞ্চি মর্টার ছুড়তে করতে শুরু করেছে। অগত্যা নূর মোহাম্মদ ২য় বিকল্পটাই বেছে নিলেন।
মুক্তিসেনাদের প্রচণ্ড ফায়ারের তোপে পাকিস্তানিরা প্রাথমিক ভাবে পিছু হটল, তারপর নিরাপদ দূরত্বে থেকে নূর মোহাম্মদের অবস্থান লক্ষ্য করে একের পর এক মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করল। কিন্তু তারপরও আহত নান্নুকে কাঁধে করেই একই কৌশলে নূর মোহাম্মদরা ফায়ার ব্যাক করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ খুব কাছেই মর্টারের একটা গোলা বিস্ফোরিত হলো। মর্টার গোলা বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে নূর মোহাম্মদদের কানে তালা লেগে গেল যেন। বিস্ফোরিত গোলার শক-ফ্রন্ট এর পিছু পিছু চাক ভাঙা বোলতার মতো ছুটে এল স্প্লিন্টারের বৃষ্টি। সংবিৎ ফিরে পেয়ে নূর মোহাম্মদ অনুভব করলেন তার ডান পাশটা যেন অবশ হয়ে গেছে। হাত আর হাঁটুতে গভীরভাবে গেঁথে গেছে মর্টারের স্প্লিন্টার, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। নান্নু আগেই আহত হয়েছেন, নিজেও গুরুতর আহত, শুধু সিপাহি মোস্তফাই দুই পায়ে খাড়া এখনো। নূর মোহাম্মদ বাস্তবতা মেনে নিলেন। একা মোস্তফার পক্ষে দুজনকে বয়ে নেওয়া অসম্ভব। হয় তিনজন মিলেই এখানে মরতে হবে অথবা যেকোনো একজনকে নিয়ে মোস্তফা সরে পড়ার চেষ্টা করতে পারেন, অন্যজনের মৃত্যু নিশ্চিত। বাস্তবতাটা সিপাহি মোস্তফাও বুঝলেন, কিন্তু তিনি একা দুজনকেই নিয়ে সরে যেতে চাইলেন। কিন্তু নূর মোহাম্মদ সায় দিলেন না। নাছোড়বান্দা মোস্তফা তার হাত ধরে টানাটানি শুরু করতেই নূর মোহাম্মদ বাম হাতে গাছের শিকড় আঁকড়ে ধরে বসে রইলেন। নূর মোহাম্মদ তার অকৃত্রিম সহযোদ্ধা মোস্তফার হাতে নিজের এলএমজিটা তুলে দিলেন, যেন তার মৃত্যুর পর অযথাই একটা এলএমজি শত্রুর হাতে গিয়ে না পরে। সিপাহি নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে নিয়ে সিপাহি মোস্তফা এবার নূর মোহাম্মদের নির্দেশমত অস্ত্রপাতি সব কুড়িয়ে নিলেন। অবশেষে নূর মোহাম্মদের দিকে তাকাতেই নূর মোহাম্মদ ফের তাকে তাগাদা দিলেন। চোখের পানি লুকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে মোস্তফা পেছনের পথ ধরলেন। যাওয়ার আগে একটা লোডেড রাইফেল নূর মোহাম্মদের পাশে রেখে গেলেন।
মোস্তফা আর নান্নুর প্রস্থানকে নিরাপদ করতে আরেক পশলা গুলি ছোড়ার মতো শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলেন নূর মোহাম্মদ, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে দ্রুতই কাহিল হয়ে পড়ছেন তিনি। গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে নূর মোহাম্মদ শরতে আকাশ দেখলেন।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *