আজ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের শাহাদতবার্ষিকী

Uncategorized জাতীয়

নিজস্ব প্রতিবেদক ঃ আজ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের শাহাদতবার্ষিকী, তিনি আমাদের সর্বকনিষ্ঠ বীরশ্রেষ্ঠ। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে হঠাৎ গর্জে উঠলো মেশিনগান, একের পর এক শেল পড়তে শুরু করলো চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালী সৈনিকদের রিক্রুট সেন্টার ইবিআরসি’তে। সদ্যই ১৮ পেরোনো রিক্রুট সিপাহী হামিদুর রহমান ঘুম থেকে উঠে কেবল ধ্বংস, হত্যা আর আর্ত-চিৎকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলেন না। কিন্তু তিনি ভয় পাননি।
তাৎক্ষণিক ভাবে বাঙ্গালী অফিসার আর সিপাহীদের বাকি ইউনিটগুলোর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অস্ত্র হাতে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুললেন সিপাহী হামিদুর। এত ধ্বংস আর মৃত্যুর মাঝেও যে এভাবে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারে, ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের পাকিস্তানী সেনাদের সেটা কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু পৃথিবীর অন্যতম দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক মরণাস্ত্রের সামনে কয়েকটি এলএমজি আর থ্রি নট থ্রি দিয়ে কতক্ষণ যুদ্ধ করা যায়? ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অকুতোভয় যোদ্ধারা একে একে শহীদ হতে শুরু করলো। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে হামিদুর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে উত্তীর্ণ হয়ে গেলেন। প্রথম পোস্টিং হলো চট্টগ্রামে। বাবা ছেলেকে নিয়ে গর্ব করতেন, “আমার হামিদুরের মত সৎ পোলা আর নাই, যেকোনো কাজে তার উপরে ভরসা করা যায়।” একটাই সমস্যা, হামিদুর একবার রেগে গেলে কেউ তাকে থামাতে পারত না। ২৫শে মার্চের সেই কালরাতে চট্টগ্রামের ইবিআরসিতে ২৫০০ বাঙ্গালী সৈনিক সহযোদ্ধার লাশ দেখে হামিদুরের সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। ১৮ বছরের হামিদুরের চোয়ালবদ্ধ শপথে মিশে থাকলো শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে না দেবার দৃপ্ত প্রতিজ্ঞা। একাত্তরের অক্টোবরের শুরুর দিকে ইস্টবেঙ্গলের সি কোম্পানির ওপর দায়িত্ব পড়লো ধলই সীমান্তের ফাঁড়ি দখল করা। সিলেটের সীমান্ত এলাকা শ্রীমঙ্গল হতে দশ মাইল দক্ষিণে ধলই সীমান্ত ঘাঁটি।ধলই চা বাগানের পূর্ব পাশে এই ঘাঁটিটি সিলেটে পাকিস্তানীদের অন্যতম শক্ত ঘাঁটি। পাকিস্তানের দুর্ধর্ষ ৩০তম ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্ট পাহারা দিচ্ছে ঘাঁটিটি।
ভোর চারটায় মুক্তিবাহিনী লক্ষ্যস্থলের কাছে পৌঁছে অবস্থান নেয়। চারদিকে সুনসান নীরবতা। সেখানে কেবল জেগে আছে মুক্তিবাহিনীর একটি ইউনিট।এই ইউনিটটি পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে হটিয়ে ধলই সীমান্ত ঘাঁটি দখলে নেবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোর রাতেই আক্রমণ করা হবে ঘাঁটিটি। লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম এ অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এই দলে ছিলেন মাঝারি গড়নের সুঠাম দেহের অধিকারী হামিদুর রহমান। এই তরুণের মনের জোর অসম্ভব শক্ত। আক্রমণের জন্য তৈরি ইউনিটটি। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিচ্ছে এই যুদ্ধে। সামনে দুই প্লাটুন এবং পিছেন এক প্লাটুন সৈন্য। প্রথম দুই প্লাটুন ডান ও বাম দিক থেকে ঘাঁটি আক্রমণ করবে। আর পেছনের প্লাটুনটি পেছন থেকে ঘাঁটিটি আক্রমণ করবে। সামনে দুই প্লাটুন ও পেছনে এক প্লাটুন সৈন্য অবস্থান নিয়েছে। তারা প্রস্তুত শত্রুর ওপর চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য! ২৮শে অক্টোবর ১৯৭১। ভোর রাত। ১২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা দলটা লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের নেতৃত্বে নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছে শ্রীমঙ্গলের ধলই বর্ডারের পাকি ঘাঁটির দিকে। যেভাবেই হোক আজ এই ঘাঁটি দখল করতে হবে। হঠাৎ করেই সামনে পায়ের তলায় একটা মাইন বিস্ফোরণ, শহীদ হলেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হলেন। রক্তে লাল হয়ে গেল মাটি। কিন্তু এত মৃত্যুর পরও পেছনে হটার কোনো সুযোগ নেই। ঘাঁটি দখল করতেই হবে। এক পর্যায়ে হতাহতের সংখ্যা আরও বেড়ে গেল। মুক্তিযোদ্ধারা আরও অগ্রসর হলেন। মুক্তিবাহিনী সীমান্ত ফাঁড়ির খুব কাছে পৌঁছে গেলেও ফাঁড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত হতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিবর্ষণের জন্য আর অগ্রসর হতে পারছিলো না। পাকিস্তানি গানাররা ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট ছুঁড়ছে। সামনে এগোতে হলে অবশ্যই সেই এলএমজিটা থামিয়ে দিতে হবে। লে. কাইয়ুম সিদ্ধান্ত নিলেন, যেভাবেই হোক ওই এলএমজিটা থামাতেই হবে। কিন্তু এই অবিরাম গুলি-বৃষ্টির মধ্যে সামনে যাওয়ার অর্থ নিশ্চিত মৃত্যু, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে যাবে কে? দলের কমান্ডার লেফট্যানেন্ট কাইয়ুমের পাশে এসে দাঁড়ালেন হামিদুর। ‘স্যার, আমি যাই? দুইটা গ্রেনেড দিয়া এই পোস্ট উড়ায়া দিমু। বেশিক্ষণ লাগব না।’ কাইয়ুম তার দিকে ভালোভাবে তাকালেন। চেহারা থেকে এখনো কৈশোরের ছাপ যায়নি, একেবারে বাচ্চা বয়স। কী সুন্দর হাসিমুখে বলছে, স্যার আমি যাই… হামিদুরের তাগাদা, ”যাই না স্যার…” অনুমতি দিলেন কাইয়ুম, অশ্রুসিক্ত নয়নে ভাবতে থাকলেন, এই জীবনে হয়তো এই হাসিখুশি সাহসী ছেলেটার সঙ্গে আর দেখা হবে না। পাহাড়ি খালের ভেতর দিয়ে ক্রল করতে করতে প্রায় ১৮০ ফুট দূরত্ব পার হয়ে গেলেন হামিদুর, মাথার ওপর দিয়ে, শরীরের আশপাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে গুলি ছুটছে, একটা মুহূর্তের বিরাম নেই। আরেকটু…তারপরেই ঘটলো এক বিচিত্র ঘটনা। মেশিনগান পোস্টের গানাররা মরার আগে জীবনের শেষ মুহুর্তে দেখলো একটা বিচিত্র দৃশ্য। একটা মানুষ মুহুর্মুহু গুলির মাঝখানে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, বাঘের মত গর্জনে ‘জয় বাংলা’ চিৎকার দিয়ে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারলো পাকিস্তানি মেশিনগান পোস্টে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মেশিনগানটা অকেজো হয়ে গেলো, ছিটকে গেলো সব কিছু। হামিদুর হঠাৎ টের পেলেন, তার শরীর দিয়ে রক্ত পড়ছে। এদিকে মেশিনগান বন্ধ হলেও মেশিনগান পোস্টের ভিতরে বেঁচে যাওয়া দুই পাকিস্তানি সৈন্য তাদের অস্ত্র দিয়ে আবার গুলিবর্ষণ শুরু করেছে। ওদের থামাতে না পারলে তো মুক্তিযোদ্ধারা এগোতে পারবে না। বাপে গর্ব করে বলতো, হামিদুররে যেকোনো কাজে ভরসা করা যায়, যেমনে হোক সে কাজটা শেষ করবেই। বাপকে হামিদুর সারাজীবন সঠিক প্রমাণ করে এসেছে, আজ তার ব্যতিক্রম হয় কী করে? সঙ্গে থাকা ছুরি দুটো দু’হাতে নিয়ে শরীরের সবটুকু শক্তি এক করে হামিদুর ঝাঁপিয়ে পড়লেন মেশিনগান পোস্টের ভেতর। সঙ্গে সঙ্গে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি করল এক সৈন্য, আরেক সেনা বেয়নেটটা ঢুকিয়ে দিলো পেটের ভেতর। আর তারপরেই প্রবল জলোচ্ছ্বাসের মত মৃত্যুরা যেন ছুটে এলো ওদের দিকে, অকৃত্রিম বিস্ময় এসে জমা হলো ওই পাকিস্তানি সেনাদের চোখে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *