বিশেষ প্রতিবেদন : বিমানবন্দরে বিদেশগামী ৩১ নারীকে আটক করে ইমিগ্রেশন বিভাগ, জাল কাগজপত্রে পাচার করা হচ্ছিল তাদের ২০০৬ সালের ১৭ নভেম্বর সকালে খবর।
ফোন আর বাজে না। এপার থেকে বারবার চেষ্টার পর শোনা যায়—‘দুঃখিত, এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ মিষ্টি, অথচ একঘেয়ে স্বরটিকে যারপরনাই নিষ্ঠুর মনে হতে থাকে সুমির। কিন্তু তাঁর প্রতীক্ষা আর শেষ হয় না। যে নম্বরে তিনি ফোন করছিলেন, সেটি সুমির এক প্রিয়জনের, তা-ও অনুরোধের। বিমানবন্দরে আটকা পড়ার পর শুধু একবার তিনি ওই নম্বরে কথা বলতে পেরেছিলেন। এরপর থেকে নম্বরটি বন্ধ। কিন্তু সেসব মানতে নারাজ মেয়েটি। আমার কাছে তাঁর কাতর প্রার্থনা, ‘স্যার, আরেকবার দেখেন।’
২০০৬ সালের ১৭ নভেম্বর সকালে খবর এল, তখনকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশগামী ৩১ নারীকে আটক করে তাঁদের যাত্রা স্থগিত করা হয়েছে। জাল কাগজপত্রে তাঁদের পাচার করা হচ্ছিল। বাংলাদেশ থেকে তখনো বৈধভাবে নারী কর্মী পাঠানো শুরু হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই ওটা ছিল গরম খবর। সে কারণে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলাম বিমানবন্দরে। গিয়ে দেখি, ৩১ জন নারীকে ইমিগ্রেশন পুলিশ বিমানবন্দরের একটি জায়গায় জড়ো করে রেখেছে। পুলিশ মনে করছিল, এটা বড় ঘটনা, আর তার কভারেজও বেশি দরকার। সাংবাদিকেরা যেন এসে সহজে কথা বলতে পারেন, সে কারণে তাঁদের এভাবে জড়ো করে রাখা হয়েছিল।
বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকে প্রথমেই পেলাম সুমি আক্তারকে। তাঁর বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। সুমির কথায় কোনো রাখঢাক নেই। বললেন, তাঁরা ৩১ জন লেবাননে যাচ্ছিলেন। আমি একে একে সবার সঙ্গে কথা বলছি আর নোট করছি। যাঁর সঙ্গে কথা বলতে যাই, তিনিই অনুরোধ করেন তাঁর প্রিয়জনকে ফোন করার জন্য। কয়েকজনের জন্য চেষ্টাও করলাম, কিন্তু বেশির ভাগের ফোন বন্ধ। কেউ কেউ ফোনই ধরলেন না। কয়েকজনকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, হয়তো মোবাইলের চার্জ ফুরিয়ে গেছে। কাউকে বললাম, অপেক্ষা করেন, হয়তো ফোন বাজবে। কিন্তু কারও ফোন আর বাজেনি।
বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের এক কর্মকর্তা বললেন, তাঁরা আসলে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের হাতে প্রতারিত হয়েছেন। তাঁরা বিদেশে যেতে না পারলেও চক্রের লোকেরা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বাসাবাড়িতে কাজের কথা বলে সহজ-সরল এসব নারীকে পাচার করা হচ্ছিল। পাসপোর্ট-ভিসা ঠিক থাকলেও মন্ত্রণালয়ের বৈধ ছাড়পত্র ছিল না। তবে ছাড়পত্রের মতো একটি জাল কাগজ তাঁদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
দিনটি ছিল শুক্রবার, গালফ এয়ারের মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইটের সময় সকাল ৬টা ১০ মিনিটে। সেই ফ্লাইটে যাওয়ার জন্য ৩১ নারী বিমানবন্দরে যান। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা তাঁদের কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেন, সবার কাগজ প্রায় একই ধরনের। এমনকি সিল-স্বাক্ষরেও মিল। পরে তাঁরা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, সবই ভুয়া।
আমরা বিমানবন্দরে পৌঁছার আগেই তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। সবাই জানান, তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন দালালের মাধ্যমে ভিসা সংগ্রহ করেন। তবে দালাল ছাড়া আর কারও নাম কেউ বলতে পারেননি। ট্রাভেল এজেন্ট বা রিক্রুটিং এজেন্সির নামও তাঁরা শোনেননি।
আমি জানু খানম নামের এক নারীর সঙ্গে কথা বলি। তিনি বললেন, ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানায় তাঁর বাড়ি। দুই সন্তানের মা জানু ঈদের আগে ফিরোজ নামের এক দালালের হাতে ৭০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছিলেন। মাসে প্রতি হাজারে ৪০০ টাকা সুদে সেই টাকা সংগ্রহ করেন। দালাল তাঁকে লোভ দেখিয়েছিলেন, লেবাননে গেলেই ভালো বাড়িতে ভালো কাজ পাওয়া যাবে এবং মাসে অনেক টাকা আয় হবে।
নারায়ণগঞ্জের সেলিনা আমাকে বলেছিলেন, দালাল মোজাফফরের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে তিনি ওই কাজ জোগাড় করেছিলেন। ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ করলেন কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হালের দুটি গরু বেচে তিনি সেই টাকা জোগাড় করেন। ওই দলে ছিলেন কুমিল্লার হোমনার রাহেলা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাসিনা। সবাই প্রায় একই কথা বলেছিলেন।
সেখানে ঘণ্টা দুয়েক ছিলাম। এরপর জানতে পারি, ৩১ নারীকে দিনভর বিমানবন্দরে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। পরে সবার কাছ থেকে দালালের নাম সংগ্রহ করে ৩৬ জনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়। সেই মামলায় জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর চারজন এবং বিমানের এক কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিলেন পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক শাহাদত হোসেন।
দুদিন পরে শাহাদত হোসেন আমাকে বলেছিলেন, চাকরি করতে যাঁরা বিদেশ যান, তাঁদের ছাড়পত্রসহ অন্য কাগজপত্র পরীক্ষার জন্য বিমানবন্দরে জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর একটি ডেস্ক আছে। গ্রেপ্তার করা চারজন সেই ডেস্কের কর্মচারী। তাঁরা ভুয়া ছাড়পত্র দেখার পরও নারীদের যাওয়ার অনুমতি দেন। তাঁর সন্দেহ, আগে থেকেই দালাল চক্রের সঙ্গে তাঁরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল, যে কারণে কোনো বাধা ছাড়াই তাঁরা ইমিগ্রেশন পর্যন্ত চলে যান।
কয়েক দিন পরে ফলোআপ করতে গিয়ে শুনলাম, ৩১ নারীকে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। অফিসের তাড়া ছিল সেই ঘটনার ফলোআপ করার জন্য। গেলাম মহিলা আইনজীবী সমিতির কাছে। এক কর্মকর্তা আমাকে নিয়ে গেলেন নারীদের যেখানে রাখা হয়েছে, সেই আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানে গিয়ে তাঁদের কাছে জানতে চাইলাম, ‘বাড়ি যাবেন না?’ আমার ধারণা ছিল, সবাই বাড়ি যেতে চাইবেন। কিন্তু সবাই আমার সঙ্গে অদ্ভুত আচরণ করলেন। বললেন, কেউই বাড়ি যেতে চান না। আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, ‘কেন যাবেন না?’ একজন বললেন, ‘বাড়ি গেলে সুদের টাকা চাইতে লোক আসবে। তখন কী হবে! তার চেয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকি, সেটাই ভালো।’
সবার কথা শুনে আর থাকতে ইচ্ছা হলো না। সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। মনে হলো, সত্যিই তো, সব হারানো নারীরা ফিরে গিয়েই-বা কী করবেন!
এরপর হয়তো আরও হাজারো, লাখো নারী জীবিকার প্রয়োজনে বিদেশ গেছেন। হয়তো বেশির ভাগই গেছেন অবৈধ পন্থায় ‘আদম’ হয়ে। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার পর পরিবারের জন্য তাঁরা ডলার পাঠাচ্ছেন, সেটাই যুক্ত হচ্ছে জাতীয় উন্নয়নে। কাঁড়ি কাঁড়ি ডলারে ফুলে-ফেঁপে উঠছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার।
ইদানীং ঝর্না নামের এক সৌদি৷ প্রবাসী নারীর ইউটিউব ভ্লগে দেখি, ঝর্না ১৭ বছর ধরে সৌদি আরবে আছেন গৃহকর্মী হয়ে। প্রতিদিন ভ্লগে তিনি বিভিন্ন কষ্টের কথা বলেন আর কাঁদেন। মনে হয় ঝর্নার প্রতি ফোঁটা অশ্রুর নামই রেমিট্যান্স।