
গোলাম মওলা রনি : কবি গোলাম মোস্তফার বনভোজন কবিতার কথা আপনাদের কয়জনের মনে আছে জানি না- তবে শিশুকালে পড়া সেই সমধুর কবিতাখানি কেনো যে আমার বারবার মনে পড়ে তার কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাই না। কবিতার শুরুটা ছিল এভাবে- নুরু, পুশি, আয়েশা, শফি সবাই এসেছে,/ আম বাগিচার তলায় যেন তারা হেসেছে। রাঁধুনিদের শখের রাঁধার পড়ে গেছে ধুম,/ বোশেখ মাসের এই দুপুরে নাইতো কারো ঘুম। বাপ মা তাদের ঘুমিয়ে আছে এই সুবিধা পেয়ে, বনভোজনে মিলেছে আজ দুষ্ট ক’টি মেয়ে।

উল্লিখিত কবিতাটিতে মোট কুড়িটি লাইন রয়েছে। শিশুতোষ কবিতাটির প্রতিটি শব্দের মধ্যে শিশুদের পিতা-মাতার জন্য যেমন শিক্ষার মালমসলা রয়েছে, তদ্রুপ সমকালীন রাজনীতি-অর্থনীতি ও সমাজনীতির বাস্তবচিত্র রয়েছে। কবি গোলাম মোস্তফার আরেকটি বিখ্যাত কবিতার নাম কিশোর যার একটি লাইনে কবি বলেছেন- ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। কবির বক্তব্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যগুলোর মধ্যে- আজকের নিবন্ধের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- শৈশবের শিক্ষা, পারিবারিক ঐতিহ্য এবং মাতৃগর্ভে থাকাকালীন মানুষের শরীর-মন-মস্তিষ্ক যেভাবে গড়ে ওঠে, তাই পরবর্তীকালে মানুষকে পরিচালনা করে থাকে।

আপনি যদি হাল আমলের রাজনীতির কুশীলবদের হম্বিতম্বি লক্ষ করেন এবং কবি গোলাম মোস্তফার বনভোজন কবিতার প্রথম চারটি লাইনের ভাবসম্প্রসারণ করেন তবে দেখতে পাবেন যে, পুরো রাজনৈতিক অঙ্গন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। কবিতার ভাষায় বাবা-মা ঘুমিয়ে আছে এবং সেই সুযোগে বৈশাখ মাসের রুদ্র দুপুরে দুষ্ট কয়েকটি মেয়ে আমবাগানের তলায় এসে মিথ্যা বনভোজনের আয়োজন করেছে। তারা আসলে কিছুই করছে না- কেবল কিছু করার জন্য অভিনয় করছে এবং সেটা কিভাবে, তাও কবি চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন কবিতার পরবর্তী পঙ্ক্তিমালায়।
কবি বলেন- ‘বসে গেছে সবাই আজি বিপুল আয়োজনে,/ ব্যস্ত সবাই আজকে তারা ভোজের নিমন্ত্রণে। কেউবা বসে হলদি বাটে, কেউবা রাঁধে ভাত,/ কেউবা বলে দুত্তুরি ছাই পুড়েই গেল হাত। বিনা আগুন দিয়েই তাদের হচ্ছে যদিও রাঁধা,/ তবু সবার দুই চোখেতে ধোঁয়া লেগেই কাঁদা।’
শিশুতোষ বনভোজনের মতো আজকের রাজপথ যারা কাঁপাচ্ছেন তারা সত্যিকার রাজনীতি কতটুকু করছেন তা নিয়ে কমবেশি সবারই আপত্তি রয়েছে। তবে রাজনীতিবিদদের অভিনয় এবং বালখিল্য সব বয়সী মানুষকে ব্যাপক বিনোদন দিচ্ছে। অভিভাবকহীন রাজনীতির কবলে পড়ে মানুষের জীবন যেখানে ত্রাহি ত্রাহি করছে, সেখানে রাজনীতির বালক-বালিকাদের বনভোজন দেখে মনে হচ্ছে, চৈত্র-বৈশাখ মাসের কাঠফাটা ভরা রৌদ্রের খর উত্তাপে অমাবস্যার আকাশের সব তারকারাজি পলাশীর আম্রকাননে নেমে এসেছে এবং সেই তারকারাজির আতশবাজি এবং বালক-বালিকাদের খিলখিল হাসি এবং রং তামাশার মধ্যেই যুদ্ধের ময়দানে বাংলা মায়ের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটছে।
পলাশীর আম্রকানন, মীর জাফর, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, ঘসেটি বেগম প্রভৃতি শব্দমালা যেমন বাংলার রাজনৈতিক দর্পণে স্থায়ী চিত্র হয়ে যুগে যুগে বঙ্গসন্তানদের বিশ্বাসঘাতকতাজাতীয় বেঈমানী এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিক্রির এক নির্মম ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয় তদ্রুপ সেই নামগুলোর প্রেতাত্মারা যখন আমাদের চোখের সামনে নবরূপে আবির্ভূত হয়ে বনভোজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে- আমরা তখন নুরু-পুশি-আয়শা শফির পিতা-মাতার মতো মধ্যাহ্ন ভোজনের পর যে ভাতঘুম মানুষকে চেপে ধরে সেই ঘুমের ঘোরে অচেতন হয়ে পড়ে থাকি।
আজকের শিরোনামে রাজনীতির তেজপাতা ও ক্ষমতার গরম মসলা নিয়ে আলোচনা করব- তবে তার আগে-বনভোজন কবিতার বাকি কথাগুলো বর্ণনা করা আবশ্যক। কবি বলেন- ‘কোর্মা পোলাও কেউবা রাঁধে, কেউবা চাখে নুন,/ অকারণে বারবার হেসেইবা কেউ খুন। রান্না তাদের শেষ হলো যেই, গিন্নী হলো নুরু,/ এক লাইনে সবাই বসেই করলে খাওয়া শুরু।
গ্রামের শিশুতোষ বনভোজনের অভিজ্ঞতা যাদের রয়েছে তারা সবাই উল্লিখিত বর্ণনা শুনে নিশ্চয়ই অতীতে ফিরে গিয়েছে। শিশুরা কিভাবে গাছতলায় বসে শত শত বছর ধরে একই কায়দায় যে, বনভোজনের আনন্দ উপভোগ করে এবং সম্পূর্ণ কল্পনার ফানুস দ্বারা পোলাও-কোর্মা রান্না করে সারিবদ্ধ হয়ে বসে খানাপিনা করে এবং শিশুদের মধ্যে নুরুরূপী রাঁধুনি আবার নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অভিনয়ের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে উপস্থিত বালক-বালিকাদের কিভাবে খাওয়ায় সেই দৃশ্য কবি গোলাম মোস্তফা যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার সঙ্গে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের বাংলাদেশ এবং দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের কোনো মিল আপনি যদি খুঁজে পান তবে তার জন্য নিশ্চয়ই কবিকে গালমন্দ করবেন না।
কবিতার শেষ কয়েকটি চরণ বর্ণনা করে মূল প্রসঙ্গে চলে যাবো। নুরুর গিন্নিগিরিতে যখন অবোধ বালক-বালিকারা কোর্মা পোলাও খেতে ব্যস্ত তখন সেই ভোজনরসিক বালক বালিকাদের অবস্থা কেমন ছিল তা বর্ণনা করতে গিয়ে কবি বলেন- ‘ধুলোবালির কোর্মা পোলাও আর সে কাদার পিঠে।/ মিছি মিছি খেয়ে সবাই, বলে বেজায় মিঠে।’ এমন সময় হঠাৎ আমি যেই পড়েছি এসে।/ পালিয়ে গেল দুষ্টরা সব খিলখিলিয়ে হেসে। বনভোজন কবিতা এখানেই শেষ করেছেন কবি গোলাম মোস্তফা। কবির উপস্থিতি টের পেয়ে দুষ্টরা যেভাবে পালিয়ে গিয়েছিল ঠিক একইভাবে রাজনীতি গণতন্ত্র মানবতার মুরুব্বিরা যদি তাদের দিবা নিদ্রা পরিহার করে রাজপথে হাজির হন তবে দুষ্ট বালক বালিকারা খিলখিলিয়ে হেসে নয় বরং হাউমাউ করে কেঁদে পালানোর আগে যা ত্যাগ করে যাবে তার গন্ধে মুরুব্বিরা হেসে পড়াগড়ি দিতে বাধ্য হবেন।
আমরা আজকের আলোচনার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাক। আমরা যেহেতু প্রথম থেকেই শিশুতোষ কবিতার ভাবসম্প্রসারণ করতে গিয়ে গুরুগম্ভীর কথাবার্তার পরিবর্তে সহজবোধ্য হালকা কথাবার্তা বলেছি- সেহেতু রাজনীতির তেজপাতা নিয়েও দুর্বোধ্য কিছু বললে পাঠকদের পক্ষে তা হজম করা সহজ হবে না। আমাদের দেশে ইদানীং প্রায়ই তেজপাতা নিয়ে যে প্রবাদ বাক্যটি উচ্চারিত হয় তা হলো ‘বুঝলে বুঝপাতা! না বুঝলে তেজপাতা।’ প্রবাদ বাক্যটির জন্ম হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে- সম্ভবত ২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচনের পরে। ২০১৪ সালের আগেও বাংলাদেশে তেজপাতার কিছুটা হলেও গুরুত্ব ছিল- কিন্তু দুই দু’টি ভোটারবিহীন প্রশ্নবিদ্ধ এবং সারা দুনিয়ায় সর্বজনীনভাবে নিন্দিত নির্বাচনের পর তেজপাতাও গুরুত্ব হারিয়েছে। কাজেই তরকারির ঝাঁজ বাড়ানোর জন্য বিশেষত বাঙালির ঐতিহ্যবাহী ডালে তেজপাতা ব্যবহার বেড়েছে না কমেছে তা আমি বলতে পারব না। তবে তেজপাতারূপী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গুরুত্ব যে শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে তা আমরা অনায়াসে বুঝতে পারি।
তেজপাতা ছেড়ে আমরা এবার গরম মসলা নিয়ে আলোচনা করব। আমাদের দেশে গরম মসলা বলতে এলাচি, দারুচিনি এবং লবঙ্গকে বোঝানো হয়। সাধারণত গোশতজাতীয় খাবারের তেজ বাড়ানোর জন্য গরম মসলা ব্যবহৃত হয়। পাক ভারতের গরম মসলার কদর রয়েছে সারা দুনিয়াতে এবং ভারতীয় রন্ধন প্রক্রিয়া পশ্চিমের অনেক দেশ পছন্দ না করলেও গরম মসলার ভাবসাব রংচং অনেকেই পছন্দ করেন। আমাদের দেশের খাদ্যতালিকায় গোশতকে যেমন সর্বোচ্চ গ্রেডে মূল্যায়ন করা হয়, তদ্রুপ এ দেশে মানুষের যেকোনো যোগ্যতার চেয়ে তার রাজনৈতিক ক্ষমতাকেই সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। গোশতে গরম মসলা না দিলে যেমন আমরা মজা করে খেতে পারি না- তদ্রুপ আমাদের দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে গরম মসলা যুক্ত না হলে আমরা কাউকেই ক্ষমতাধর হিসেবে মনে করি না। এখন প্রশ্ন হলো, গোশতের গরম মসলার মতো ক্ষমতার গরম মসলার কি কোনো নামধাম আছে?
আমাকে যদি আপনি প্রশ্ন করেন তবে আমি বলব, ক্ষমতার জন্য দুই ধরনের গরম মসলা রয়েছে। সভ্য সমাজ সভ্য দেশ এবং সভ্য মানুষের জন্য ক্ষমতার গরম মসলা হলো শিক্ষাদীক্ষা, বিনয়, ভদ্রতা, ধর্মবোধ, কৃতজ্ঞতা, ন্যায়বিচার, সুশাসন, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, পরিশ্রম, নিরাপত্তা, আল্লাহভীতি, জনগণের প্রতি ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধ। আর আপনি যদি অসভ্য লোকের অসভ্য সমাজের এবং অসভ্য জাতিগোষ্ঠীর ক্ষমতার গরম মসলার নাম জানতে চান তবে প্রথমেই দেখতে পাবেন যে, ক্ষমতাধররা সবাই মিথ্যুক। জুলুম করা তাদের বিনোদন। অন্যায় অবিচার তাদের অলঙ্কার। খুন রাহাজানি লুটপাট তাদের পোশাক। হারাম জিনিস ছাড়া তারা উদরপূর্তি করতে পারে না। চোর ডাকাত-বাটপাড় নির্লজ্জ বেহায়া ছাড়া তারা এক মুহূর্ত একাকী বসবাস করতে পারে না। ক্ষমতার মসনদে কলঙ্ক লেপন না করে তারা নিদ্রায় যেতে পারে না। নিদ্রাভঙ্গ হবার পর মন্দ চিন্তা ছাড়া তারা দিনের কর্মকাণ্ড শুরু করতে পারে না। অপকর্ম করার জন্যই তাদের জন্ম হয় এবং অপকর্মের কারণে অপঘাতে মৃত্যুর স্বাদ নেয়ার জন্যই তারা বেঁচে থাকে। (লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য)