সুমন হোসেন, অভয়নগর (যশোর) : করোনাকালে বিদ্যালয় বন্ধ। বাইরে চলাফেরাও ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায় সারাক্ষণ ঘরে বসে অলস সময় কাটে; কিন্তু বাসায় বসে অলস সময় কাটানো তার পছন্দ ছিলো না। মাথায় ছিলো নতুন কিছু একটা করার। সেই ভাবনা থেকে কীভাবে ঝিনুক থেকে মুক্তা হয় তা ইউটিউবে দেখে জানতে পেরে শুরু করেন মুক্তা চাষ। প্রথমে এলাকার মানুষ এটাকে মূল্যায়ন না করলেও লেগে থাকায় এক সময়ে সফল হয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসা মানুষদেরকে মুক্তা চাষের প্রশিক্ষণ দেন। বলছিলাম যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার একতারপুর গ্রামের কবির হোসেনের ছেলে নওয়াপাড়া কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র আব্দুর রহমানের কথা।
এরপর পুকুরের স্বাদু পানিতে পরিক্ষামুলক ভাবে দু’টি ঝিনুক দিয়ে মুক্তা চাষ শুরু করেন আব্দুর রহমান। কয়েক দিন পর ঝিনুক দুটি ভেঙে দেখতে পায়, ভেতরে মুক্তা তৈরি হয়েছে। সেই শুরু হওয়া দু’টি ঝিনুক থেকে এখন তার খামারে ৫ হাজারের বেশি ঝিনুক রয়েছে। বর্তমানে ৩টা পুকুরে এই ঝিনুক চাষ করা হচ্ছে এবং নিজের বাড়ির ছাদের উপরেও চাষ শুরু করেছেন ওই তরুণ উদ্যেক্তা। একই পুকুরে মুক্তা চাষের পাশাপাশি মাছ চাষ হচ্ছে এবং বাড়ির ছাদেও মুক্তা চাষের পাশাপাশি রঙিন মাছ চাষও করছেন তিনি। সেই সঙ্গে মুক্তা চাষের ওপর যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করে চলেছেন।
যেভাবে শুরু: আব্দুর রহমান জানান, প্রথমে ইউটিউবে ঝিনুক থেকে মুক্তা চাষের পদ্ধতি দেখে উদ্বুদ্ধ হই। প্রথম দিকে পরীক্ষামূলক দুটি ঝিনুক দিয়ে মুক্তা চাষে সফলতা পায়। এরপর শ্রমিক দিয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার খাল-বিল থেকে স্বাদুপানির প্রায় ৫০০ ঝিনুক সংগ্রহ করি। ৫০০টি ঝিনুকের মধ্যে ১০০০পিছ ইমেজ বা নিউক্লিয়াস প্রতিস্থাপন করে পুকুরে লাইলোনের নেট ব্যাগে করে রাখি। পুকুরে মাছ চাষের পাশাপাশি ঝিনুকগুলোও বেড়ে উঠতে থাকে। মাছের জন্য দেওয়া খাবারই ঝিনুকগুলোর খাবার হওয়ায় অতিরিক্ত খাবার দেওয়া লাগে না। ২০২২ সালে ময়মনসিংহ জেলায় অবস্থিত “বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট” থেকে ‘স্বাদুপানির ঝিনুকে মুক্তা চাষ’ শীর্ষক তিন দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করি। অভিজ্ঞতা অর্জনে নওগাঁ ও কোটচাঁদপুরের কয়েকটি খামার পরিদর্শন করি।
ঝিনুক চাষে সফলতা পাওয়ায় ২০২২ সালের শেষের দিকে আমি বাড়িতে এ আর অ্যাগ্রো ফার্ম নামে ঝিনুক চাষের উপর একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করি। সেখানে বর্তমানে ১৮ থেকে ২২জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছেন।
মুক্তা যেভাবে তৈরি হয়: ভালো ও সুস্থ দেড় থেকে দুই বছর বয়সী ঝিনুক সংগ্রহ করা হয়। ঝিনুকগুলো সাত দিন থেকে এক মাস পানিতে রাখা হয়। এরপর ঝিনুকগুলো উঠিয়ে অস্ত্রোপচার এর মাধ্যমে তার মধ্যে দুটি করে নকশা করা ইমেজ (মুক্তার বীজ) ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। অ্যান্টিবায়োটিক মেশানো পানিতে ঝিনুকগুলো একদিন রাখা হয়। এরপর নাইলনের সুতা দিয়ে তৈরি ব্যাগে ১০টি করে ঝিনুক পুকুরের পানিতে এক থেকে দেড় ফুট গভীরে ভাসমান অবস্থায় রাখা হয়। প্যারাসিটামল গ্রুপের অজিমেট নামের ওষুধ পরিমাণমতো পানির মধ্যে দিতে হয়।
হাউসে উন্মুক্ত অবস্থায় অস্ত্রোপচার করা ঝিনুক ছেড়ে দেওয়া হয়। এর নকশা করা ইমেজ ঘিরে আবরণ পড়তে থাকে। মাঝে মধ্যে ঝিনুক তুলে ইমেজের চারপাশে আবরণ পড়ছে কি না, তা পরীক্ষা করা হয়। এভাবে ৭ থেকে ১১ মাস রাখার পর পানি থেকে ঝিনুক তোলা হয়। পরে ঝিনুক ভেঙে তার ভেতর থেকে মুক্তা সংগ্রহ করা হয়।
মুক্তার বাজার: ‘মূলত তিনটি গ্রেডের মুক্তা পাই। এগুলো হলো এ, বি ও সি গ্রেড। নকশাভেদে পাইকারি এ গ্রেডের প্রতিটি মুক্তা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। বি ও সি গ্রেডের মুক্তা একটু কম দামে বিক্রি হয়। উৎপাদিত মুক্তা সর্বনিম্ন ১০০-১৫০ টাকা আর সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা দরে বিক্রি করছি। যেসব জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান ডিজাইনের কাজ করে, তারা মুক্তা কিনে নেয়। এক বছরে দুই লাখ টাকার মুক্তা বিক্রি করেছি। ওসব মুক্তা তৈরি করতে সব মিলিয়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছিল। পুকুর ভাড়া ১৫ হাজার টাকা ছাড়াও তৈরি করা ইমেজ ৬ টাকা, নাইলনের সুতায় তৈরি নেট ৪০ টাকা এবং সংগ্রহ করা ঝিনুক ৫ টাকা করে বিক্রি করি। এখন যে ঝিনুক আছে, তাতে ছয় লাখ টাকার মুক্তা বিক্রি করা যাবে বলে আশা করছি।’
খামারে ১৯ জনের কর্মসংস্থান: বর্তমানে আমার খামারে কাজ করছেন ১৯ জন কর্মী। এর মধ্যে ঝিনুক সংগ্রহের কাজে পাঁচজন, নিউক্লিয়াস তৈরিতে পাঁচজন, মুক্তায় ডিজাইন করার জন্য দুজন এবং নেট তৈরিতে সাতজন কর্মী কাজ করছেন। দিনে কর্মীদের ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়।
এখন দেশের নামকরা বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে গোল ও ডিজাইন করা মুক্তা সরবরাহ করি। আমি অভয়নগর উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিস থেকে একটি প্রশিক্ষণ নিয়েছি। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছি। এ পর্যন্ত ২০০ এর অধিক মানুষের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। সরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে মুক্তা ও রঙিন মাছের খামার আরও বড় করতে পারবো বলে আশা করি।’
এখন আমার তৈরি বিভিন্ন ডিজাইন (নকশা) করা মুক্তা গুলো বিদেশে মুক্তা ও মুক্তার জুয়েলারী রপ্তানির জন্য কাজ করে যাচ্ছি।এগুলো বিদেশের বাজারে রপ্তানি করতে পারলে দেশের বাইরেও বিদেশে মুক্তার বাজার সম্প্রসারিত হবে। এবং মুক্তা সহ মুক্তার জুয়েলারী রপ্তানী করার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। যা দেশের রিজার্ভ ডলারে যোগ হওয়ার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে পারবে। আমার ফার্মের তৈরী মুক্তা বিদেশে রপ্তানী করতে দেশের অনেক বেকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মোসা: আঞ্জুমনোয়ারা বলেন, আব্দুর রহমান আমাদের এলাকার সকলের গর্ব। নওয়াপাড়া কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র। মুক্তা চাষ করে নিজে সফল হওয়ার পাশ্বাপাশি অপর যুবকদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তাকে অফিসের নিয়ম অনুযায়ী আমরা সহযোগিতা করবো।
উপজেলা বিআরডিবি কর্মকর্তা মো: মেহেদী হাসান বলেন, তরুণ উদ্যেক্তা আব্দুর রহমানকে মুক্তা চাষের জন্য করোনা কালীন ক্ষতিগ্রস্ত প্রনোদনার আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তার উৎপাদিত এই ডিজাইন মুক্তা বিদেশের বাজারে পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম আবু নওশাদ জানান, আমি সফল উদ্যেক্তা আব্দুর রহমানের মুক্তা চাষের খবরটি শুনতে পাই। নিজে আব্দুর রহমানের সাথে কথা বলে তার বাড়ির ছাদে মুক্তা চাষের খামারটি পরিদর্শন করেছি। এ ধরনের আত্মকর্মসংস্থান মুলক ভালো কাজে যে কোনো ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হলে, আমার সাথে কথা বলতে বলেছি। আমি সব সময় পাশে থাকবো, ইনশাআল্লাহ।