বিলাসিতায় উচ্চবিত্ত-সহায়তায় নিম্নবিত্ত
মহসীন আহমেদ স্বপন
নভেল করোনা ভাইরাসের ছোবলে থোমকে গেছে গোটা বিশ্ব। প্রভাব ঠেকাতে বিশ্বের অনেক দেশ লকডাউন করা হয়েছে। বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলেও তৈরি হয়েছে অঘোষিত লকডাউন পরিস্থিতি। ভাইরাসের বিস্তার রোধে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলেও পরে আবার তা বাড়ানো হয়েছে। ফলে বন্ধ রয়েছে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, কল-কারখানা, শপিংমলসহ সকল ধরনের যানবাহন। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকানপাট ও পণ্যবাহী যান চলাচল করতে পারছে।
একদিকে উচ্চবিত্তরা বিলাসিতায় ছুটি কাটাচ্ছেন অপরদিকে নিম্মবিত্ত পরিবারের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তবে চরম অসুবিধায় থাকলেও কাউকে কিছু বলতে পারছেন না মধ্যবিত্তরা। লোক লজ্জার ভয়ে তারা চাপা কান্না কাঁদছেন।
দিন যত যাচ্ছে করোনা পরিস্থিতি ততই ভয়াবহ আকার ধারন করছে। বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে করোনার চিত্র কিছুটা নিয়ন্ত্রনে থাকলেও এটা যেকোন সময় মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে নিত্যপন্য ও ঔষধের দোকান ছাড়া সকল দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহন বন্ধ এবং মানুষ ঘরে বন্দি থাকার কারণে চরম বিপাকে পড়েছে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। একদিকে করোনা আক্রান্তের ভয় অপরদিকে কর্মহীন থাকার কারণে না খেয়ে মরার ভয় দু’য়ে মিলে উভয় সংকটে আছে মানুষ। যদিও সরকারি বেসরকারি পর্যায় থেকে অসহায় ও দরিদ্র মানুষদের মধ্যে খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে তবে প্রয়োজনের তুলনায় সেগুলো অপ্রতুল। বর্তমান পরিস্থিতিতে সমাজের বিত্তবানদের মধ্যে খাদ্য নিয়ে চিন্তা না থাকলেও দরিদ্র জনগোষ্ঠি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি আছে মহাচিন্তায়। বিত্তবানরা দুই তিন মাসের জন্য ঘরে খাদ্যের মজুদ রাখলেও যারা দিন আনে দিন খায় তাদের অবস্থা করুণ। তবে আশার কথা হচ্ছে এসব অসহায় দরিদ্র মানুষ অন্যের কাছে হাত পেতে সাহায্য চাইতে পারেন এবং কিছু না কিছু সাহায্য পেয়েও থাকেন যার ফলে তারা দুমুঠো খেয়ে পড়ে কোন রকমে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যান। তবে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি এ করোনা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছেন। কর্মহীন অবস্থায় ঘরে বসে সংসার নির্বাহ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। সব সময়ই মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বুকে কষ্ট নিয়ে মুখে হাসি দিয়ে চলতে হয়। নিজের ঘরের অভাব অনটনের কথা আত্ম মর্যাদার কারণে কাউকে বলা যায় না। অভাবে পড়ে নিজেই জ্বলে পুড়ে মরতে হয় কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা যায় না। কেউ কেউ পরিস্থিতির শিকার হয়ে সাহায্যের জন্য দরিদ্রের কাতারে দাঁড়ালেও অনেকেই হয়তো আঙ্গুল তুলে বলেন ওনিতো ভালই আছেন সাহায্যের জন্য এসেছেন কেন? করোনা পরিস্থিতির এ সময়ে আমরা কি কখনো এসব মধ্যবিত্তদের কষ্টের কথা ভেবে দেখেছি? যারা কারো কাছে হাত পাততে না পেরে না খেয়েই দিন পার করছেন। সংসার কিভাবে চলে এ কথা জিজ্ঞেস করলে মধ্যবিত্তরা হাসি মুখে বলেন ভালই চলছে। তাদের জন্য রাষ্ট্র, সমাজ ,প্রশাসন কিংবা ব্যক্তি পর্যায় থেকে কোন সাহায্য বরাদ্ধ নেই। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে এমন সংকটকালেও তারা আত্ম মর্যাদা বিসর্জন দেন না। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? সমাজের অন্যতম চালিকা শক্তি হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের বাঁিচয়ে রাখতে রাষ্টীয়ভাবে কী কোন ব্যবস্থা করা হবে না। নাকি মধ্যবিত্তের বোবা কান্না রাষ্ট্রের কানেই পৌঁছায় না?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, খুলনা নগরীতে একটি গাড়ির শো-রুমে চাকরি করেন তিনি। বেতন বেশ ভালোই। এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবে শো-রুম বন্ধ। বেতনও বন্ধ। এই অবস্থায় চিন্তায় তার মাথায় হাত। কী করবেন, কী করা উচিত, ভেবে উঠতে পারছেন না। সংসার চালাতে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। চক্ষু লজ্জায় কষ্টগুলো প্রকাশও করতে পারছেন না।
খুলনা মহানগরীর দৌলতপুরে একটি দোকানের ম্যানেজার হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি। আর্থিকভাবে পরিবার নিয়ে ভালোই ছিলেন তিনি। মা-বাবা, দুই ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন ভাড়া বাসায়। মাসিক যে বেতন পেতেন তাতেই সংসারটা ভালোভাবে চলে যেত। কিন্তু তার কোনো সঞ্চয় নেই। গত কয়েক বছর ব্যবসা করলেও এমন সংকটে কখনোই পড়েননি তিনি। ১০ দিন ধরে দোকান বন্ধ। হাতে কিছু টাকা ছিল তা দিয়ে কিছু বাজার করেছেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে কঠিন অনিশ্চয়তায় পড়ে অন্ধকার দেখছেন চোখেমুখে। বাসা ভাড়া, সংসার খরচ এসব কিভাবে জুটবে সেই চিন্তায় ঘুম আসে না তার। স্ত্রী ও সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে বিলাপ করা ছাড়া আর পথ দেখছেন না তিনি।
খুলনা নিউমার্কেটের একজন কসমেটিকস ব্যবসায়ী বলেন, উচ্চবিত্তদের তো আর্থিক সমস্য না হওয়ায় স্বাচ্ছন্দে জীবনজাপন করছেন। নিম্নবিত্তের লোকজন তো সরকারি ত্রাণ পাচ্ছে, বেসরকারি সহায়তা পাচ্ছে। কিন্তু মধ্যবিত্তের কী হবে? তার ঘরে খাবার শেষ হয়ে আসছে। তারা এখন অল্প অল্প করে খাচ্ছেন।
মধ্যবিত্তদের দুর্দশার কথা কেউ কেউ ফেসবুকেও তুলে ধরছেন। একজন লিখেছেন, সবাই আমরা ব্যস্ত নিম্ন আয়ের মানুষদের নিয়ে। মধ্যবিত্তদের খবর কেউ নেয় না। এসময় মধ্যবিত্তদের খবর না রাখলে না খেয়ে মারা যেতে পারে হাজারও মধ্যবিত্ত। খবর নিয়েন বাসায় বাজার সদায় আছে নাকি। মুখ চেপে না খেয়ে দিন পার করছে মধ্যবিত্তরা।