বিশেষ প্রতিবেদক : কয়েক বছর ধরে দুর্যোগ আকারে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে বজ্রপাত। এর মধ্যে বিশ্বে বছরে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যাচ্ছে, তার প্রায় অর্ধেকই ঘটছে বাংলাদেশে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বজ্রপাতের ‘ডেড জোন’ এখন বাংলাদেশ।
সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম সংবাদপত্রের তথ্য পর্যালোচনা করে জানিয়েছে, চলতি বছরে গত দুই মাসে বাংলাদেশে বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন ১২৬ এবং আহত হয়েছেন ৫৩ জন।
বর্ষা মৌসুমে প্রায় প্রতিদিনই বজ্রপাতে প্রাণহানি ঘটছে। শনিবার বজ্রপাতে ১৫ জনের মৃত্যু হয়। পাবনার বেড়ায় বজ্রপাতে দুই ছেলে, বাবাসহ চারজন নিহত হন। সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে বজ্রপাতে বাবা-ছেলের করুণ মৃত্যু হয়। ময়মনসিংহে বজ্রপাতে তিনজন নিহত হন। নেত্রকোনার কলমাকান্দায় একজন নিহত হয়েছেন। আগের দিন শুক্রবার বজ্রপাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জে শিশুসহ দুইজন এবং শেরপুরে এক কৃষক নিহত হন। ২৮ জুন সাতক্ষীরায় বজ্রপাতে একই পরিবারের তিনজনসহ পাঁচজন নিহত হন।
জানা যায়, বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা দিতে প্রায় ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালে দেশের আটটি স্থানে লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর স্থাপন করা হয়। বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ এসব রাডার ঢাকা, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা এবং পটুয়াখালীতে স্থাপন করা হয়।
কিন্তু কারিগরি দক্ষতার অভাবে রাডারগুলো কোনো কাজে আসছে না। বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেওয়া এবং রাডার পরিচালনা বা তথ্য সংগ্রহের দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন জনবল আবহাওয়া অধিদপ্তরে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের রাডার কোম্পানি প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন তাদের এজেন্টদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলেও জানা যায়।
ভারতের আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, বাংলাদেশে গড়ে বছরে তিন হাজার বজ্রপাত হয়। জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে গড়ে বছরে আড়াই হাজার বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। অথচ বজ্রপাতের তথ্য রেকর্ড করার প্রযুক্তি নেই বাংলাদেশে।
২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আবহাওয়া সম্পর্কিত দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক হিসেবে চিহ্নিতও করা হয় বজ্রপাতকে। বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগাভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। বজ্রপাতে এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে একজন সুস্থ মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ ভৌগোলিক অবস্থান ও বায়ুদূষণ। একদিকে বঙ্গোপসাগর, অন্যদিকে ভারত মহাসাগর। উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি অঞ্চল। রয়েছে হিমালয়। সাগর থেকে আসে গরম বাতাস, আর হিমালয় থেকে আসে ঠান্ডা বাতাস। একসঙ্গে দুই রকমের বাতাসের সংমিশ্রণে বজ্রমেঘের আবহ তৈরি হয়। এ রকম একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে বজ্রপাত ঘটে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে প্রতিবছর বজ্রপাতের প্রবণতা আরও বাড়ছে। নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনাও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
জাপানের জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেমে দেখা গেছে, বজ্রপাতে বেশি মানুষ মারা যায় বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে। বজ্রপাতে নিহতদের মধ্যে কৃষক ও জেলের সংখ্যাই বেশি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বায়ুদূষণ কমানো ও সচেতনতা সৃষ্টি ছাড়া প্রাণহানি কমানো সম্ভব হবে না। বজ্রপাত থেকে বাঁচতে বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সারাদেশে এক কোটি তালগাছ লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। এখন পর্যন্ত ৩২ লাখ লাগানো হয়েছে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তালগাছের চারা গরু-ছাগলে খেয়ে ফেলছে। এছাড়াও একটি তালগাছের বজ্রনিরোধক ক্ষমতা অর্জন করতে সময় লাগে ২৫ বছর। তাই এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এসব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হাওর এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র করা যেতে পারে। এছাড়া মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বজ্রপাতের সময় বড় গাছের কা- থেকে ১০ ফুট দূরে থাকতে হবে।
দুর্যোগ ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বজ্রপাতে ২০১৮ সালে ২৯৭, ২০১৭ সালে ৩০৬, ২০১৬ সালে ৩৫১, ২০১৫ সালে ২৭৪, ২০১৪ সালে ২১০, ২০১৩ সালে ২৮৫, ২০১২ সালে ৩০১ এবং ২০১১ সালে ১৭৯, ২০১০ সালে ১১০ জন নিহত হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব জিওগ্রাফির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় এক হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বজ্রপাতে।
তবে, বজ্রপাতে মৃত্যুর চেয়ে দশগুণ বেশি মানুষ আহত হন। এই আহতরা যখন মারা যান তখন আর হিসাবে ধরা হয় না। বজ্রপাতে আহতদের চিকিৎসা বা ওষুধও নেই দেশের হাসপাতালগুলোতে।
যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ২৫ মিলিয়ন বজ্রপাত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় ক্যালিফোর্নিয়ায়। এতে মানুষ মারা যায় মাত্র ২০ থেকে ৩০ জন। ভেনেজুয়েলা ও ব্রাজিলেও রেকর্ড পরিমাণ বজ্রপাত হয়। ভারত, শ্রীলংকা ও নেপালে বজ্রপাতের সংখ্যা বেশি হলেও মৃত্যুর সংখ্যা খুবই কম।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কম বজ্রপাত হলেও মানুষ মারা যাচ্ছে বেশি। বজ্রপাতে বিপুলসংখ্যক গবাদিপশুও মারা যায়। এর জন্য এদেশের মানুষের অসচেতনতাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সচেতনতা বাড়াতে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যসূচিতে বজ্রপাতের সময় করণীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলছেন অনেকে। এছাড়া, বজ্রপাত কমিয়ে আনতে বড় বড় গাছ বিশেষ করে তালগাছ লাগাতে হবে। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী প্রতিটি ভবনে বজ্রনিরোধক দ- স্থাপন করতে হবে।
বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড় ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির শঙ্কায় রয়েছে বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই বিশ্বে দুর্যোগ ঝুঁকির তালিকায় পঞ্চম স্থানে বাংলাদেশ।