সাইবার অপরাধ ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক : সহজ লভ্যতার কারণে একদিকে যেমন বেড়ে চলছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা, তেমনই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে সাইবার অপরাধও। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক-কেন্দ্রিক অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে বেশি। ফেসবুক আইডি হ্যাকের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। এছাড়া, ই-মেইল আইডি হ্যাক, ফেক আইডি তৈরি করে ব্ল্যাকমেইল করা, সেক্সটোরেশন, মোবাইল ব্যাংকিং জালিয়াতি ও অন্যান্য হ্যারাসমেন্টের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তথ্য-প্রযুক্তিতে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে গিয়ে অনেকেই শখের বশে হ্যাকিং শিখছে। সেটি ভালো কাজে না লাগিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং করে অর্থ আদায়ের মতো অপরাধমূলক কর্মকা-েও জড়িয়ে পড়ছে অনেকে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে তাদের কাছে সরাসরি এক হাজার ৭৬৫টি অভিযোগ জমা পড়েছিল। এছাড়া, হ্যালো সিটি অ্যাপস, ফেসবুক, মেইল ও হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে অভিযোগ এসেছে ৬ জাজার ৩০০টি। ২০১৯ সালে সরাসরি অভিযোগের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯৩২ টিতে। আর হ্যালো সিটি অ্যাপস, ফেসবুক, মেইল ও হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে অভিযোগ এসেছিল ৯ হাজার ২২৭টি। সাইবার ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আগে সাইবার ক্রাইম বিষয়ক বেশি অভিযোগ আসতো নারীদের কাছ থেকে। কিন্তু এখন সমান্তরালভাবে পুরুষরাও সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছেন। ২০১৯ সালে মোট অভিযোগের ৫৩ শতাংশ এসেছে পুরুষদের কাছ থেকে, আর বাকি ৪৭ শতাংশ এসেছে নারীদের কাছ থেকে।
সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের উপ-কমিশনার আ ফ ম আল কিবরিয়া বলেন, অপরাধের প্যাটার্ন পরিবর্তন হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়বে, অপরাধের সংখ্যাও তত বাড়বে। তবে আমরা প্রতিনিয়ত সাইবার ক্রিমিনালদের নজরদারি করছি। অভিযোগ পেলেই আমরা তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। যদিও সাইবার ক্রাইমের শিকার হওয়া অনেকেই অসেচতনতার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল বা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে জানান তিনি।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিন কোটিরও বেশি। বেশিরভাগ লোকজনই ফেসবুকে নিজের আইডি খুললেও তা যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন না। ফেসবুক মেসেঞ্জারে নিজেদের খোলামেলা ছবি বন্ধু বা প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে আদান-প্রদান করে থাকেন। হ্যাকাররা সহজেই ওইসব আইডি হ্যাক করে খোলামেলা ছবিগুলো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে থাকে। এছাড়া, বিভিন্ন সময়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েসসাইট হ্যাক করেও অর্থ আদায় করে হ্যাকাররা।
সাইবার ক্রাইমের একজন কর্মকর্তা জানান, হ্যাকাররা ফেসবুক আইডি টার্গেট করে হ্যাক করে। যেসব ফেসবুক আইডিতে ব্ল্যাকমেইল করার কোনও উপাদান থাকে না, সেসব আইডি ফেরত দেওয়ার নামে অর্থ আদায় করে। নারীদের ক্ষেত্রে হ্যাক হওয়া আইডি দিয়ে নানারকম আপত্তিকর ছবি পোস্ট করার হুমকি দেওয়া হয়। সামাজিক সম্মানের জন্য অনেকেই হ্যাকারদের অর্থ দিয়ে আইডি ফেরত নেন। ফেইক আইডি তৈরির ঘটনাগুলো সাধারণত ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে ঘটে থাকে বেশি। তবে মোবাইল ব্যাংকিং জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে অহরহ। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়ের পরিচয় দিয়ে এক শ্রেণির প্রতারক গ্রাহকের কাছ থেকে পাসওয়ার্ড নিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এছাড়া, বিপুল পরিমাণ অর্থ বা উপঢৌকনের লোভ দেখিয়ে এবং ‘জিনের বাদশা’ পরিচয় দিয়েও অর্থ হাতিয়ে নেয় একটি চক্র।
সাইবার ক্রাইম কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন সাইটের মধ্যে ফেসবুক সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। একারণে ফেসবুককেন্দ্রিক অপরাধের সংখ্যা বেশি। ২১০৯ সালে ঢাকার সাইবার ক্রাইম বিভাগে মোট ১২০১টি অভিযোগ এসেছে ফেসবুক আইডি হ্যাক হওয়া নিয়ে, যা মোট অভিযোগের ৪১ শতাংশ। তবে আইডি হ্যাকের ক্ষেত্রে নারীর চেয়ে পুরুষের অভিযোগ বেশি। এ বছর ৫০৫ জন নারী ও ৬৯৬ জন পুরুষ ফেসবুক আইডি হ্যাকিংয়ের অভিযোগ করেছেন। সাইবার ক্রাইম সূত্র জানিয়েছে, ফেইক আইডি, সেক্সটোরেশনের ক্ষেত্রে নারীরা শিকার হন বেশি। তবে মোবাইল ব্যাংকিং, ই-মেইল আইডি হ্যাকের ঘটনা পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশি ঘটে।
সাইবার সূত্র বলছে, সাইবার ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত অপরাধীর মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই বেশি। গত দুই বছরে শতাধিক সাইবার ক্রিমিনালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের অনেকেই তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন করার পর শখের বসে হ্যাকিং শিখেছে। কৌতূহলের কারণে সেটি প্রথমে পরিচিতদের মধ্যে প্রয়োগ করতো তারা। ধীরে ধীরে ব্ল্যাকমেইলিং করে অর্থ আদায়ের মতো অপরাধ শুরু করে।
সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সহকারী পুলিশ কমিশনার ধ্রুব জ্যোতির্ময় গোপ বলেছেন, হ্যাকিংয়ের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘ফিশিং অ্যাপ’ ব্যবহার করে হ্যাকাররা। একারণে অপরিচিতদের পাঠানো যে কোনও লিংকে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে বিরত থাকা এবং কোনোভাবেই পাসওয়ার্ড ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটগুলোও যথাযথ সাইবার নিরাপত্তার মাধ্যমে সুরক্ষিত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন সাইবার পুলিশ কর্মকর্তারা।
এদিকে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার যে হারে সবকিছু ডিজিটালাইজেশন এবং ইন্টারনেট সহজলভ্য করছে, সেই হারে সাইবার অপরাধ ঠেকাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সাইবার অপরাধ ঠেকাতে যে ধরনের ফরেনসিক ল্যাবরেটরি প্রয়োজন, সেরকম ফরেনসিক ল্যাবরেটরি এখনও স্থাপন করা যায়নি। মামলার তদন্তে ও বিচারিক পর্যায়ে ডিজিটাল স্বাক্ষ্য উপস্থাপনেও দুর্বলতা রয়েছে। ফলে সাইবার ক্রিমিনালদের আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেননোলজির সহকারী অধ্যাপক তানভীর হাসান জোহা বলছেন, আমাদের এখানে ডিজিটাল ফরেনসিকের বিষয়ে কোনও ন্যাশনাল পলিসি নেই। ডিজিটাল সার্টিফিকেশন দেওয়ার অথরিটি নেই। আমাদের ল্যাব পর্যাপ্ত না। পুলিশ তদন্তে অদক্ষ। আদালতে গিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাইবার ক্রাইমের প্রমাণ দিতে পারে না। একারণে সাইবার ক্রিমিনালরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ফেসবুক এডিটিং প্যানেল দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এরকম সুবিধা নেই। ফলে ফেসুবকে কেউ যদি খারাপ কোনও কথা বলেও সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরা যায় না। সাইবার জগতে বলা হয়— কেউ একজন যদি ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে থাকে, তাহলে তাকে সনাক্ত করা অনেক বেশি সহজ। কিন্তু বাংলাদেশে তা করা যায় না। আমাদের এখানে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব আরও আধুনিক করতে হবে। প্রয়োজনে জেলায় জেলায় ফরেনসিক ল্যাব করতে হবে। তা না হলে সাইবার অপরাধ ভবিষ্যতে খুবই জটিল আকার ধারণ করবে।
তানভীর হাসান জোহা বলেন, সাইবার ক্রাইম ঠেকাতে সাইবার পুলিশকে আরও বেশি দক্ষ করে তুলতে হবে। সাইবার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ক্রিমিনালদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে যারা তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারকারী তাদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে। যেমন কেউ যদি নিজ দায়িত্বে ফেসবুক সেটিংসে নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স বা পাসপোর্ট সাবমিট করে রাখেন, তাহলে হ্যাকাররা তার ফেসবুক আইডি কোনোভাবেই হ্যাক করতে পারবে না।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *