নিজস্ব প্রতিবেদক : সৌদি আরবের পর বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে ৮ আগস্ট পুনরায় উন্মুক্ত হয়। গত ৩১ মে পর্যন্ত ২২ মাস সময়ে সীমিত সংখ্যক ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে পৌনে ৫ লক্ষ কর্মী মালয়েশিয়া গমন করে। ইতোমধ্যে মালয়েশিয়া কর্মরত প্রবাসী কর্মীগণ রেমিটেন্স প্রেরণের দিক দিয়ে চতুর্থ স্থানে রয়েছেন।
২০২২-২৪ সময়ে সীমিত সংখ্যক ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী প্রেরিত হলেও প্রকৃতপক্ষে তালিকা বহির্ভূত ৭৩৫টি রিক্রুটিং এজেন্সিসহ আরো মধ্যস্বত্বভোগী এজেন্ট মিলে ১ হাজার ১০০টি এজেন্সির অধিক মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে সম্পৃক্ত হয়েছে। বায়রার অধিকাংশ সদস্য মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে কোন না কোন পর্যায়ে সম্পৃক্ত বা লাভবান হওয়ার পরও সিন্ডিকেট গঠন, অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়, ভিসা প্রাপ্ত সকল কর্মী মালয়েশিয়া না যেতে পারাসহ বিভিন্ন ভাবে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি প্রক্রিয়াটিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার অপচেষ্টায় রয়েছে বলে জানা যায়।
বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকার বন্ধ শ্রমবাজার উন্মুক্তকরণের লক্ষে ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে এবং সমঝোতা স্মারকের আওতায় ২০২২ সালের ২ জুন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং মালয়েশিয়ায় মানব সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ মিটিং-এ এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, মালয়েশিয়া সরকার সীমিত সংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী গ্রহণ করবে এবং মালয়েশিয়া সরকার অনলাইন ভিত্তিক স্বচ্ছ পদ্ধতিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক সরবরাহকৃত এজেন্সিসমূহের মধ্য হতে নির্দিষ্ট সংখ্যক এজেন্সি নির্বাচন করবে।
এরই প্রেক্ষিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ১ হাজার ৫২০টি বৈধ লাইসেন্সের মধ্য হতে মালয়েশিয়া সরকার প্রাথমিকভাবে ২৫টি লাইসেন্স এবং পরবর্তীতে সরকারি খাতসহ মোট ১০১টি লাইসেন্স তালিকাভূক্ত করে।
কার্যবিবরণীতে সহযোগী এজেন্সি বা নিয়োগকর্তা কর্তৃক স্থানীয় (ঢাকায়) এজেন্ট নিয়োগের কোন সুযোগ নেই। সুতরাং, সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সি বা নিয়োগকর্তা কর্তৃক নিয়োজিত এজেন্টের কোন কাজই বিধি সম্মত নয়। তা সত্বেও এ সকল তালিকাবর্হিভূত এজেন্সি মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে অবৈধভাবে যুক্ত হয়ে পুরো প্রক্রিয়াটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন।
জানা যায়, সমঝোতা স্মারক মোতাবেক তালিকাভূক্ত এজেন্সির অনুকূলে স্বয়ংক্রিয় বরাদ্দ পদ্ধতিতে কোটা বরাদ্দ হয়েছে। তবে তালিকাবর্হিভূত এজেন্সিসমূহ নিয়ম বর্হিভূতভাবে নিয়োগকর্তার সাথে যোগাযোগ করে তাদের লোভ দেখিয়ে ভিসা ক্রয় করে এবং পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি বলে নিয়োগকর্তার ঢাকাস্থ স্থানীয় এজেন্ট নিয়োজিত হয়ে কোটাপ্রাপ্ত এজেন্সিকে বাধ্য করেছে তার পছন্দ করা কর্মীদের কলিং ভিসা, ই-ভিসা এবং সর্বোপরি বিএমইটি ছাড়পত্র জোগাড় করে উক্ত কোম্পানিতে কর্মীদের প্রেরণের ব্যবস্থা করার জন্য। অর্থাৎ কর্মী সরবরাহের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তালিকাবহির্ভূত এই শ্রেণীর রিক্রুটিং এজেন্সিসমূহ।
বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের বিধি-বিধান মেনে তালিকাভুক্ত ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের ব্যবস্থা করে। দুই দেশের সরকারের কাছে কর্মী প্রেরণ প্রক্রিয়ায় তারা আইনগত দায়বদ্ধতার ভিতর থেকে এই অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সামগ্রিক কাজ সম্পন্ন করেছে।
দু’দেশের প্রচলিত বিধি-বিধানের আওতায় এই সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সির কোন ভূমিকা না থাকায় তারা ঢাকায় মানববন্ধন ও মিটিং মিছিল করেছে এবং তাদের এই অবৈধ কাজকে সমর্থন করার জন্য মন্ত্রণালয় এবং সরকারের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে। মন্ত্রণালয় শেষ পর্যন্ত এ সকল এজেন্সির অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হওয়া বিষয় মেনে নেয়।
মধ্যস্বত্বভোগী সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সি ভিসা ক্রয় এবং অবৈধ লেনদেনের কারণে এক একটি ভিসার মূল্য ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠিয়েছে। এই অর্থ সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সিগণ অবৈধ পন্থায় নিয়োগকর্তাকে পরিশোধ করেছে। লাইসেন্সধারী ৭৩৫টি সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সির একটি তালিকা আমাদের হাতে এসেছে এবং উহার সঠিকতা যাচাই করা হয়েছে। অন্যদিকে তালিকাভুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিদের ভিসা ক্রয়-বিক্রয়ের কোন প্রয়োজন ছিল না।
মালয়েশিয়া সরকারের স্বয়ংক্রিয় বরাদ্দ সিস্টেম প্রাপ্ত কোটার কর্মীদেরকে বাছাই করে মালয়েশিয়া প্রেরণ করা তার দায়িত্ব কর্তব্য ছিল। যেহেতু নিয়োগকর্তা ভিসা বিক্রি করে সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সিকে স্থানীয় এজেন্ট নিয়োগ করে কর্মী সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব দিয়েছে এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ও কর্মীগণের বৃহত্তর স্বার্থে তাদের কাজকে মেনে নিয়েছিল, সেজন্য তালিকাভুক্ত ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সি সকল দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েও সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সির সরবরাহকৃত কর্মীকে মালয়েশিয়ায় প্রেরণ করতে হয়।
মালয়েশিয়া সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মূলত: বিমান টিকেট এবং অন্যান্য যুক্তিসঙ্গত কারণে যখন কিছু কর্মী মালয়েশিয়ায় গমনে অসমর্থ হলো তখন ভিসা ক্রয়-বিক্রয়কারী এ সকল মধ্যস্বত্বভোগী রিক্রুটিং এজেন্সি সকল দায়-দায়িত্ব তালিকাভুক্ত কোটাপ্রাপ্ত এজেন্সির উপর চাপিয়ে দিল।
এ সকল সহযোগী এজেন্সিরা একদিকে যেমন বলেছে যে কোটাপ্রাপ্ত মূল রিক্রুটিং এজেন্সি ১ থেকে দেড় লাখ টাকা গ্রহণ করেছে আবার কর্মীপ্রতি অভিবাসন ব্যয় হয়েছে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। তাহলে এই সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা অবৈধ পন্থায় ভিসা ক্রয়-বিক্রয়ে লিপ্ত সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সি গ্রহণ করেছে এবং যার একটি বড় অংশ অবৈধ পন্থায় নিয়োগকারীকে পরিশোধ করেছে। এরাই দুই সরকারের নিরাপদ ও স্বল্প ব্যয়ে অভিবাসন প্রক্রিয়ায় মারাত্মক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
এ প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশকি কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, কোটা প্রাপ্ত মূল এজেন্সিসমূহ সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সির কাছ থেকে যে অর্থ গ্রহণ করেছে তা সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সিকে ফেরত দিবে এবং সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মীদের কাছ থেকে গৃহীত সমূদয় অর্থ ফেরত দিবে।
সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সির অনেকেই অনুমোদিত ১০১টি এজিন্সর অংশীদার হেসেবে, ভিসা ক্রয়-বিক্রয়ে যুক্ত থেকে অনৈতিকভাবে অর্থ লেনদেন করে বিপুলভাবে লাভবান হওয়ার পরও আসন্ন বায়রা নির্বাচনের নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দিতার কারণে মালয়েশিয়া সরকার নির্ধারিত সীমিত সংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী প্রেরণের প্রক্রিয়াটির তীব্র সমালোচনা ও মিডিয়ায় ভুল তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছেন।
উল্লেখ্য, হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (আরএল -৪৫২) এর ম্যানেজিং পার্টনার মো. ফখরুল ইসলাম, সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সি হিসেবে নিয়োজিত হয়ে মালয়েশিয়া হতে চড়া দামে ভিসা ক্রয়-বিক্রয় করেছেন। অবৈধ প্রক্রিয়ায় ভিসা ক্রয় মূল্য অবৈধভাবে নিয়োগকর্তাকে পরিশোধ করেছে। ট্রিবেনি ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-২২) এবং সেলিব্রিটি ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-৫০৩)
এজেন্সির শেয়ার হোল্ডার হিসেবে মূল তালিকাভুক্ত ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সির সাথে ব্যবসা করেছেন এবং একই সাথে তার নিজস্ব ওয়েলকাম ডায়াগনস্টিক ও মেডিকেল সেন্টারের মাধ্যমে হাজার হাজার কর্মীর মেডিকেল করে বৈধ-অবৈধ পন্থায় কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেছেন, যার একটি বড় অংশ ভিসা ক্রয় বাবদ মালয়েশিয়ায় নিয়োগকর্তাদের অবৈধ পন্থায় পরিশোধ করেছেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী মো. নুর আলী ইউনিক ইস্টার্ন (প্রা.) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনিও ২০১৭-১৮ মেয়াদের অভিবাসন প্রক্রিয়ায় ১০ জনের সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে ছিলেন এবং ২০২২-২৪ এর মেয়াদে ১০১টি অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সি অন্তর্ভুক্ত হয়ে ব্যবসা করেছেন। তবে এ সকল ব্যক্তির বা এজেন্সির বিরুদ্ধে কোন প্রকার অভিযোগ না করে এক শ্রেণীর রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকগণ সিন্ডিকেটের নামে বিভিন্ন মিডিয়ায় অপপ্রচার চালাচ্ছেন।
এ খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, জনশক্তি রপ্তানি খাতের স্বার্থে সকল মিথ্যা প্রচার-প্রচারণা বন্ধ করে দু’দেশের সরকারের মধ্যে ইতোমধ্যে শুরু হওয়া আলোচনায় সহযোগীতা করে আটকে থাকা কর্মীদের মালয়েশিয়ায় প্রেরণে এবং নতুন কর্মীদের সে দেশে কাজের সংস্থানে সরকারের সাথে সহযোগী ভূমিকা পালন করা আবশ্যক ।