স্বাস্থ্য অধিদফতরে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা

অপরাধ এইমাত্র জাতীয় স্বাস্থ্য

দুর্নীতি আড়াল করতেই স্বাস্থ্যখাতে রদবদল

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : সব সময়ই সরগরম থাকতো মহাখালীতে অবস্থিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন ভবন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ‘স্বাস্থ্য ভবন’। ঝাঁ চকচকে ভবনের সর্বত্রই নতুনত্বের ছাপ। নিচ তলায় বা দিকে করোনা প্রাদুর্ভাবের পর বিশাল রুম জুড়ে শুরু হয় সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। অধিদফতরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নতুন ভবনের সেই সরগরম ভাব নেই, আতঙ্ক আর ভয় সবার ভেতরে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, দুদক, ডিবির যাতায়াত এবং অধিদফতরের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে এক অস্থির এবং আতঙ্কিত সময় কাটাচ্ছি। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না, না জানি আবার কার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, তদন্ত শুরু হয়-সে আতঙ্ক চলছে। কে কাকে কী বলবে, কথা বলতেই তো সবাই ভয় পাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, করোনা পরীক্ষায় অনুমোদনহীন বেসরকারি হাসপাতাল রিজেন্ট ও জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) এর প্রতারণার খবর প্রকাশের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পায়। রিজেন্ট এবং জেকেজির শীর্ষ ব্যক্তিরা বর্তমানে কারাগারে, চলছে মামলা।
তবে অনুমোদনহীন রিজেন্ট হাসপাতাল কিভাবে করোনা পরীক্ষার সরকারি তালিকাতে এলো তা নিয়ে মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতর একে অপরকে দোষারোপ করে।
ইতোমধ্যে গত ১৯ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন ভবনে যায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান টিম। তারা রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে অধিদফতরের চুক্তির রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করতে স্বাস্থ্য অধিদফতরে গেছেন বলে জানান দুদকের অনুসন্ধান দলের প্রধান আবু বক্কর সিদ্দিক। অধিদফতর থেকে বের হয়ে যাবার সময় গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘রিজেন্টের সঙ্গে অধিদফতরের চুক্তির রেকর্ডপত্র আরও তিন দিন আগে চাওয়া হয়েছিল। আজ সেগুলো নিতে এসেছিলাম। কিন্তু পুরো ফাইল তৈরি না হওয়ায় আগামীকাল তারা পৌঁছে দেবেন বলে জানিয়েছেন।’
এরপর গত ২১ জুলাই শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ পদত্যাগ করেন। বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পান অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম।
কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এদিন পুরোটা দিনই অধিদফতর জুড়ে আলোচনায় ছিলেন রিজেন্ট কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. আমিনুল হাসান। এই কর্মকর্তা অধিদফতরের কাউকে সেভাবে আমলে নিতেন না বলেও জানান কর্মকর্তারা।
এদিকে অধিদফতরের একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, অধিদফতরের ১০ কর্মকর্তার বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। তারা কারা, কীভাবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে, এরপরের আইনি প্রক্রিয়া কীভাবে চলবে সেসব নিয়েও আতঙ্ক কাজ করছে তাদের মধ্যে।
ভবনের দ্বিতীয় তলাতে হাতের ডানে একে একে মহাপরিচালক, অতিরিক্ত দুই মহাপরিচালকের নির্ধারিত অফিস কক্ষ। সংবাদকর্মীরা অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানার কক্ষের সামনে জড়ো হলেও তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না বলে জানান। পরে তিনি জানান, দুপুর আড়াইটায় করোনা বিষয়ক নিয়মিত অনলাইন বুলেটিন শেষে কথা বলবেন গণমাধ্যকর্মীদের সঙ্গে। বুলেটিন শেষ হবার পর তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন।
বেশকিছু রদবদল হলো, কাজের জায়গাতে কোনও ঘাটতি রয়েছে কিনা অথবা কোনও সমস্যাতে পরতে হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য অধিদফতর অনেক বড় প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিদিনের যে কাজ সেটা একদিন থেমে যাওয়ার বিষয় নয়। প্রতিদিনের কাজ যেমন চলে সেভাবেই চলছে, কোথাও কোনও বাধা বা বিপত্তি নেই।
তিনি বলেন, আর কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে অধিদফতরের নিয়মিত যে কাজ যেমন করোনার নমুনা সংগ্রহ, নমুনা পরীক্ষা, ল্যাবরেটরি চালানো সবই চলছে এবং হাসপাতাল পরিচালকরা সেভাবে হাসপাতালে কাজ করছেন। কাজেই দৈনন্দিন কোনও কাজে অসুবিধা হচ্ছে না, সব কাজই রুটিন মাফিক চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কর্মকর্তা বলেন, কোভিড-১৯ নিয়ে নয়টি কমিটি ও একটি সমন্বয় কমিটির সভাপতি ছিলেন পদত্যাগী মহাপরিচালক। তার অনুপস্থিতিতে গত দুইদিন (২১ ও ২২ জুলাই) এ কমিটিগুলোর নির্ধারিত নিয়মিত সভা হয়নি, যেহেতু তিনি সভাপতিত্ব করতেন। তবে ২৩ জুলাই সভা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান প্রধান পদত্যাগ করেছেন, মানসিক প্রস্তুতিতেও সময় লাগে একটু। সেটাও দূর হয়ে যাবে, আর করোনার এই সময়ে তো থেমে থাকলে চলবে না, কাজ করতে হবে, কাজ চলবে।
দুর্নীতি আড়াল করতেই স্বাস্থ্যখাতে রদবদল : একের পর এক রদবদলে স্বাস্থ্যখাতে এখন পরিবর্তনের হাওয়া। প্রশ্ন উঠেছে এই বদলি আর পদত্যাগেই কি সমাধান? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রদবদলের পাশাপাশি এই খাতকে যারা খাদের কিনারে নিয়েছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি। আর এসব সিন্ডিকেট ও তাদের প্রশ্রয়দাতাদের সমূলে বিনাশ করলেই শতভাগ সুফল মিলবে।
অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য খাতে বইছে পরিবর্তনের হাওয়া। জুনে মন্ত্রণালয়ে হয়েছে বেশ কিছু রদবদল। পাহাড়সমান অভিযোগ নিয়ে সরে যেতে একরকম বাধ্য হয়েছেন ডিজি আবুল কালাম আজাদ। এরই মধ্য এসেছেন নতুন মহাপরিচালক।
নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হাসপাতাল শাখায়ও এসেছে পরিবর্তন। এরই মধ্যে আভাস এসেছে এই তালিকা আরো দীর্ঘ হওয়ার। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে পরিবর্তনেই কি বদলে যাবে সব?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই রদবদলগুলো সবসময় শুধুমাত্র বিরাজমান অনিয়মগুলো ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। এবং দুর্নীতিতে যারা পরিচিতি পেয়েছেন তাদেরকে আড়াল করতেই ব্যবহৃত হয়েছে। অনেক সময় এ পরিবর্তনগুলো অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার জন্য করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাকালে এসে স্বাস্থ্যখাতের যে বেহাল দশা সামনে এসেছে তা দীর্ঘদিনের। তাই সুফল পেতে যেতে হবে গোড়ায়। শুধু ব্যক্তি নয় পরিবর্তন দরকার পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ক্ষমতার একটা বিন্যাস এটার পরিবর্তন আনতে হবে। দুর্নীতিবাজ আমলাদের পরিবর্তন করে সেখানে সৎ আর যোগ্য ব্যক্তিকে আনতে হবে। যিনি উপর থেকে ফোন আসলেও নিজের দায়িত্বে অনড় থাকতে পারেন। এছাড়া জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি বলে মত তাদের।


বিজ্ঞাপন