হাজী সেলিমের পাশে নেই কেউ

এইমাত্র রাজধানী রাজনীতি

ফোন ধরছেন না সিনিয়র নেতারা

 

বিশেষ প্রতিবেদক : পুরান ঢাকার সাংসদ হাজী সেলিমের পাশে কেউ নেই। তার সু-পুত্র এরফান সেলিমের নেতৃত্বে নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে রক্তাক্ত জখম করার পর রাজনৈতিক নেতা-এমপি-মন্ত্রী কেউ তাকে সাড়া দিচ্ছেন না। আলোচিত ঘটনার মীমাংসা করতে অনেক দেন-দরবারও করেছেন। কিন্তু হাজী সেলিমের পাশে কেউ নেই।
সূত্র জানায়, উক্ত ঘটনার প্রথমে হাজী সেলিমের ফোন কয়েকজন সিনিয়র রাজনৈতিক নেতা ধরলেও এখন আর তারা হাজী সেলিমের ফোন ধরছেন না। সরকার দলীয় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, হাজী সেলিমের ছেলে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করেছে। আর এই ঘটনার দায় তারা নিতে চান না। আওয়ামী লীগের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হাজী সেলিমের ছেলের এই নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কাজেই এই বিষয়টা নিয়ে এখন হাজী সেলিমের প্রতি সহানুভূতি জানানোর কোন সুযোগ নেই।
গত রোববার রাতে হাজী সেলিমের সংসদ সদস্য স্টিকার যুক্ত গাড়িটি কলাবাগান হয়ে যাচ্ছিল। এসময় নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তার মোটর সাইকেলের সঙ্গে তার গাড়িটির ধাক্কা লাগে। মোটর সাইকেলে নৌবাহিনী কর্মকর্তা ছাড়াও তার স্ত্রী ছিলেন। সে সময় হাজী সেলিমের ছেলে এবং তার দেহরক্ষীরা গাড়ি থেকে নেমে কোন রকম কথা-বার্তা ছাড়াই নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধর শুরু করে। নৌবাহিনীর কর্মকর্তা তার নিজের পরিচয় দেওয়ার পরেও তারা বিরত হয়নি। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে তাদের গাড়ি এবং মোটর সাইকেল ধানমন্ডি থানায় যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহল ও বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সেইসাথে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। পরে পুলিশ ওই নৌ কর্মকর্তার উপর হামলা এবং হত্যা চেষ্টার মামলা দায়ের করে। সেইসাথে গাড়ি চালককে আটক করা হয়। এই ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পরই হাজী সেলিম বিভিন্ন মহলে দেন-দরবার এবং দৌড়া-দৌড়ি করছেন। কিন্তু কেউই তাকে সহযোগিতা করছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকার দলের অপর এক নেতা জানান, আওয়ামী লীগ কোন ব্যক্তির অপকর্মের দায় নিবে না। সে যেই হোক না কেন, অপকর্মকারীর পাশে আওয়ামী লীগ নেই। এখন হাজী সেলিম তার ছেলেকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করলেও কেউ তার পাশে দাঁড়াচ্ছেন না। শুধু তাই নয়, তাকে কেউ সহযোগিতাও করছেন না। বরং তারা এই বিষয়টি নিয়ে দেন-দরবার না করার জন্য হাজী সেলিমকে পরামর্শ দিয়েছেন।
হাজী সেলিমের পুত্র ইরফান সেলিমের বাসায় অভিযান চালিয়ে সরকার নিষিদ্ধ ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কিং সিস্টেম, বিদেশি মদ, অস্ত্র, চাইনিজ কুড়াল প্রভৃতি উদ্ধার করেছে র‌্যাব। সোমবার বিকেলে অভিযানের এক পর্যায়ে হাজী সেলিমের চাঁন সরদার দাদার বাড়ির ভিতরে এসব অস্ত্র-মাদক ও নিষিদ্ধ নেটওয়ার্কিং সিস্টেম দেখা যায়। পরে ইরফান ও তার দেহরক্ষীকে ওই বাড়ি থেকেই গ্রেফতার করে র‌্যাব।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাজী সেলিমের ছেলে পুরান ঢাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে তথ্য সংগ্রহর জন্য সম্পূর্ণ ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কের মধ্যে রেখেছিলেন। এজন্য অবৈধভাবে ভিপিএস ডিভাইস ব্যবহার করতেন। এই ডিভাইস আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ট্র্যাক করতে পারেন না। সরকারি অনুমোদন ছাড়াই তিনি এই ভিপিএস নেটওয়ার্কিং সিস্টেম করেছিলেন। এসব ডিভাইসের মাধ্যমে তিনি ঘরে বসেই পুরো পুরান ঢাকার তথ্য সংগ্রহ করতে পারতেন। দেবীদাস ঘাটের দাদা বাড়ি ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় অভিযান চালিয়ে এসব ওয়্যারলেস সিস্টেম সরঞ্জাম ও ৩৮টি কালো ওয়াকিটকি উদ্ধার করা হয়।
র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়াই তিনি তার বাসায় এই ভিপিএস ডিভাইসের মাধ্যমে ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কিং সিস্টেম করেছিলেন। সাধারণত এগুলো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়া কাউকে সরকার অনুমোদন দেয় না। এছাড়াও এসব ওয়্যারলেস কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ট্র্যাক করতেও পারেন না।
হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান কারাগারে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। ঢাকা করাগার সূত্র জানায়, নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় মামলা হওয়ার পর সোমবার দুপুরে দেবীদাস ঘাট এলাকায় সাংসদ হাজী সেলিমের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তার ছেলে ইরফান সেলিমকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরে মদ্যপান ও ওয়াকিটকি রাখায় তাকে সাজা দেওয়া হয়। পরে রাতেই তাকে র‌্যাব হেফাজত থেকে কারাগারে পাঠানো হয়।
র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল রকিবুল হাসান মঙ্গলবার সকালে গণমাধ্যমকে জানান, ইরফানকে কেরানীগঞ্জের কারাগারে রাত দেড়টার পরে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ঢাকার জেলার মাহবুবুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনি সকালের সময়কে বলেন, ইরফান কারাগারে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকবেন। করোনাভাইরাস মহামারীকালে কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো নতুন বন্দিকে একটি সেলে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়।
পুরান ঢাকার তৃতীয়বারের এমপি হাজী সেলিমের দ্বিতীয় সন্তান ইরফান নিজেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর। আরেক সংসদ সদস্য নোয়াখালীর একরামুল করিম চৌধুরীর জামাতা এরফান সেলিম। বিদেশে লেখাপড়া করে আসা ইরফান বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মদিনা গ্রুপের পরিচালকদের একজন।
হাজী সেলিমের ছেলের নিয়ন্ত্রণে চলতো চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসী আর ইয়াবার ব্যবসা। পুরান ঢাকার দেবীদাস ঘাটে আলিশান বাড়ি। যেন এক রাজপ্রাসাদ। এই বাড়িকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের অপরাধ জগত। এখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ হতো পুরান ঢাকা। আর চলতো চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ছাড়াও ইয়াবা ব্যবসার কেন্দ্রবৃন্দতে পরিনত করা হয়েছে। আর এজন্য গড়ে তোলা হয় শক্তিশালী এক ওয়ারলেস নেটওয়ার্ক। র‌্যাবের অভিযানে বেড়িয়ে এসেছে এসব তথ্য। সোমবার বেলা সাড়ে ১২টায় চকবাজারের ‘দাদা বাড়ি’ নামের সেই ভবনে শুরু হয় র‌্যাবের অভিযান। চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। অভিযানের সময় হাজী সেলিম বাসায় ছিলেন না। অভিযানে মেলে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ, মদের বোতল, বিয়ার, বিপুল পরিমাণ ওয়াকিটকি, ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস ও হ্যান্ডকাফ।
তার নেটওয়ার্কের আওতায় রয়েছে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ ও চকবাজার এবং বংশাল এলাকায়। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকায় আমিনুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন ফেরদৌস মোল্লা ও শহিদুল ইসলাম অন্যতম।
এদিকে এরফান সেলিমকে কাউন্সিলর পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে, স্থানীয় সরকার সচিব হেলালুদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন যে, এরফান মো: সেলিম বা যে কোন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে আদালত কর্তৃক এমন সাজা প্রদানের অভিযোগ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক লিখিত আকারে মন্ত্রনালয় পেলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


বিজ্ঞাপন