এখনো রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ
নিজস্ব প্রতিবেদক : আহত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সারওয়ারকে কারা, কেন অপহরণ করে নির্যাতন চালিয়েছে সেই রহস্য তিন দিনেও উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনার তদন্তে মঙ্গলবার পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসীন জানান, “আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কেউ মামলা করতে আসেনি। তদন্তের জন্য মামলার এজাহার দরকার।”
“উদ্ধার হওয়ার পর থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছি। এখন পর্যন্ত চলাফেরা করতে পারি না। তাই মামলা করা হয়নি। বুধবার মামলা করতে পারি,” মঙ্গলবার বেনারকে বলেন আহত সাংবাদিক সারওয়ার।
ওই সাংবাদিককে অপহরণের পর থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল। রোববার রাতে একটি খালের পাশে ঝোপের আড়ালে মুমূর্ষু অবস্থায় সাধারণ মানুষ প্রথমে অপহৃত সারওয়ারকে খুঁজে পায়। এরপর পুলিশই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে।
তারপরও তদন্তের জন্য এজাহারের কেন প্রয়োজন—এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি মহসীন বলেন, “অপহরণের পর জিডি করা হয়েছিল। এখন তাঁকে পাওয়া গেছে। তাই তাঁর কী হয়েছিল সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এখন এজাহার প্রয়োজন। সেটি পেলে আমরা তদন্ত শুরু করব।”
তবে চট্টগ্রামের সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের অভিযোগ, ঘটনার পেছনে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ জড়িত থাকায় এর তদন্তে পুলিশের গড়িমসি করছে।
“অপহরণকারীরা শক্তিশালী ও প্রভাবশালী। তাই তদন্তের জন্যেও উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে অভয় ছাড়া পুলিশ এই ঘটনার তদন্তে সাহস পাবে না,” বলেন চট্টগ্রামের প্রবীণ সাংবাদিক নেতা শহীদুল আলম।
“অপরাধীদের শনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি করা না গেলে সাংবাদিকতা সাহস হারাবে। দেশে সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ব্যহত হবে,” বলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক এই সহ-সভাপতি।
এদিকে প্রতিবেদন করার কারণেই সারওয়ারকে ‘অপহরণ ও নির্যাতন’ করা হয়েছে মন্তব্য করে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, “তাঁকে নির্যাতন করার সময় দুর্বৃত্তরা বলেছে যে, এর মাধ্যমে তারা সব সাংবাদিককে শিক্ষা দিতে চায়।”
এই ঘটনার তদন্ত এবং বিচারের দাবিতে সোমবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে সিইউজে।
এ সময় সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর অপরাধীদের ধরার ব্যাপারে সাংবাদিক প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্ত করেছেন।
সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, “অপহরণের পর থেকে পুলিশ বেশ কিছু আলামত সংগ্রহ করেছে। যেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।”
গত ২৮ অক্টোবর রাত এগারোটার দিকে একটি ভাড়াটে মোটর সাইকেলে বাড়ি ফেরার সময় অজ্ঞাত পরিচয় দুর্বৃত্তরা সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার রিপোর্টার গোলাম সারোয়ারকে (৩৬) ধরে নিয়ে যায়।
চার দিন পর রোববার রাত আটটার দিকে চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ডের বড় কুমিরা এলাকায় রাস্তার পাশে একটি সেতুর নিচে তাঁকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখতে পায় স্থানীয় লোকজন। খবর পেয়ে পুলিশ সরোয়ারকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে।
‘আমি আর নিউজ করব না’ : উদ্ধারকালীন সময়ে ধারণকৃত একটি ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে দেখা যায়, অর্ধ অচেতন অবস্থায় সারওয়ার নির্যাতনকারীদের পা ধরে বারবার বলছেন, “আমাকে মারবেন না, প্লিজ। আমি আর নিউজ করব না।”
বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত এই ভিডিওচিত্রটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ১ নভেম্বর বার্তা সংস্থা এএফপির ঢাকা ব্যুরো প্রধান ভিডিওটি নিজের ফেসবুকে শেয়ার দেন।
মঙ্গলবার সারওয়ার বলেন, “বাসায় ফেরার জন্য একটি মোটর সাইকেল ভাড়া নিয়েছিলাম। রাস্তার এক জায়গায় চালক মোটরসাইকেলটির গতি কমায়। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার পেছনে আরেকজন উঠে বসে। আমার মাথায় একটি টোপর চাপিয়ে মুখ পর্যন্ত ঢেকে ফেলে। আমি কথা বলতে পারিনি, বেশ কিছু সময় জ্ঞানও ছিল না।”
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি আরও বলেন, “আমাকে একটি ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। কাপড় জাতীয় কিছু একটা দিয়ে শরীর মুড়িয়ে কাঠের তক্তা ও বেল্ট দিয়ে পিটিয়েছে। ‘আর নিউজ করবি কি না বল’—এ কথা বলে মারধর করেছে। মারার সময় তারা বাইরে কারও সঙ্গে ‘স্যার’ সম্বোধন করে মোবাইল ফোনে কথা বলেছে।”
প্রাণে মেরে ফেলা নয়, নির্যাতন করে সব সাংবাদিককে ‘ম্যাসেজ’ দেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে করেন সারওয়ার। কার বিরুদ্ধে এবং কোন নিউজের জন্য তিনি এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন, তা এখনই বলতে চাননি ওই সাংবাদিক।
উদ্ধার হলেও রহস্য থেকে যায় : ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকায় নিখোঁজ হয়েছিলেন উৎপল দাস নামের একজন তরুণ সাংবাদিক। উদ্ধারের দাবিতে সাংবাদিকদের ক্রমাগত কর্মসূচি চলার এক পর্যায়ে ১৯ ডিসেম্বর ফিরে পাওয়া যায় উৎপলকে।
কিন্তু এই আড়াই মাস তিনি কোথায় ছিলেন, কীভাবে নিখোঁজ হলেন, তার কিছুই জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এ বছরের ৯ মার্চ একটি মামলায় আসামি হওয়ার পর নিখোঁজ হন সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। তার প্রায় দুই মাস পরে গত ২ মে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
তিনি এখনো কারাগারে আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন আইনে অন্তত চারটি মামলা হয়েছে।
এসব ঘটনাকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়েসমিন বলেছেন, “এর ফলে সাংবাদিকদের মনে অজানা আতঙ্ক তৈরি হয়, সাংবাদিকতা সাহস হারায়।”
গণতন্ত্রের স্বার্থে এসব ঘটনার রহস্য উন্মোচনে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেবেন বলে আশা করেন এই সাংবাদিক নেত্রী।
গত ১১ অক্টোবর নারায়নগঞ্জ বন্দরে স্থানীয় দৈনিক বিজয় পত্রিকার সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। স্বজনদের অভিযোগ, মাদক ব্যবসা নিয়ে খবর প্রকাশ করায় সন্ত্রাসীরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তাঁকে হত্যা করেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে এই বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর) ২০৯ জন সাংবাদিক হুমকি, মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷
এ ছাড়া খবর প্রকাশের জন্য ৮১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ অন্য আইনে মামলা হয়েছে৷ হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে ২৩ জনকে৷