ঈদের পরে উচ্চ সংক্রমণের শঙ্কা

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন স্বাস্থ্য

বিশেষ প্রতিবেদক : দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। এ অবস্থায় ঈদে যেভাবে মানুষ বাড়ি ফিরছে, তাতে দেশে করোনাভাইরাসের আরেকটি (তৃতীয়) ঢেউয়ের শঙ্কা তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টায় জরুরি ভার্চুয়াল প্রেস ব্রিফিংয়ে বক্তব্যে প্রদানকালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক এসব কথা বলেন।
ভার্চুয়াল প্রেস ব্রিফিংয়ে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।
তিনি সতর্ক করে বলেন, ঈদে আমরা যেভাবে গাদাগাদি করে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। এতে আমরা নিজেদের সর্বনাশ নিজেরা ডেকে আনছি। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে করোনা সংক্রমণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।
মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, আমরা এ বিষয়ে সঙ্কিত যে সংক্রমণ আবার বাড়ে কিনা। তবে বর্তমানে সারা দেশের কোভিড হাসপাতালগুলোতে সাড়ে ১২হাজার সিট খালি আছে। এছাড়া দেশে শনাক্ত ও মৃত্যুর হারও কমেছে। দেশে করোনাভাইরাসের সেকেন্ড ওয়েভ মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
তিনি বলেন, করোনা পৃথিবী থেকে কবে যাবে, তা কেউ বলতে পারে না। ফলে যতদিন করোনা থাকবে ততদিন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই।
অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ঈদের জামাত সীমিত আকারে করতে পারলে সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। এ জন্য ঈদের জামাত খোলা স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে করার চেষ্টা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ঈদের নামাজ পড়ার পর কোলাকুলি করা যাবে না এবং হাত মেলানো যাবে না। এতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। নামাজ পড়ার সময়ে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। আর পরবর্তী সময়ে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
ঈদের পর আবারও দেশে করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। দেশব্যাপী চলমান কঠোর লকডাউনের মধ্যেই মার্কেটে-শপিং মলে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে মানুষের ভিড় এবং ঈদে ঘরমুখো জোয়ার মিলে এই ভয়কে বড় করে তুলছে। এর মধ্যে দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রবেশ সেই শঙ্কাকে আরও তীব্র করে তুলছে। ইতোমধ্যে সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক হারে করোনা টেস্ট এবং সেই এলাকার যানবাহন যাতে অন্য এলাকায় যেতে না পারে সেই বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
শরীরে রোগ-জীবাণু প্রবেশের পর থেকে রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগ পর্যন্ত মধ্যবর্তী যে সময়কাল সেটাকে বলা হয় ইনকিউবেশন পিরিয়ড। করোনার বেলায় এটা দুই দিন থেকে ১৪ দিন। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলে এই সময়ের মধ্যে লক্ষণ উপসর্গ প্রকাশ পাওয়া শুরু করে। গত ২৫ এপ্রিল থেকে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেই খুলে দেওয়া হয়েছে শপিং মল। প্রথম কয়েকদিন ক্রেতাদের চাপ কম হলেও পাঁচ দিন পর থেকে চাপ বাড়তে শুরু করে। বিভিন্ন শপিং মল, মার্কেটে দেখা যায় মানুষের উপচেপড়া ভিড়। সেখানে নেই সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি পালনের লক্ষণ। সেটির একটি প্রভাব ১৪ দিন পর পড়তে পারে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
পাশাপাশি সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঈদে বাড়ি ফেরার হিড়িক। গত ২মে থেকে দেশের ফেরিঘাটগুলোতে দেখা যায় ঘরমুখো মানুষের চাপ। জনস্রোত ঠেকাতে ফেরি বন্ধ ঘোষণা করে শুধু মালবাহী পণ্য নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে তাতেও বাধে বিপত্তি। জনস্রোত ঠেকাতে বিজিবি মোতায়েন করা হলেও তাতে কোনও কাজ হয়নি। ফলে আবার ফেরি চালু করে দিতে অনেকটা বাধ্য হয়েছে প্রশাসন। সাধারণ মানুষ যে কোনও উপায়ে ঢাকা ছাড়ছেন। কেউ ট্রাকে, কেউ পিকআপে কিংবা অনেকে পায়ে হেঁটেই রওনা হচ্ছেন গন্তব্যের দিকে।
দেশে করোনার সর্বাধিক সংক্রমণ ছিল গত মার্চ-এপ্রিল মাসে। ফেব্রুয়ারিতে করোনা সংক্রমণের হার দুই শতাংশে নেমে আসলেও মার্চে তা দাঁড়ায় ২৫শতাংশের কাছাকাছি। এযাবৎ কালের সর্বাধিক সংক্রমণের হার ছিল গত আগস্টে ৩১ দশমিক ৯১শতাংশ। দেশের ইতিহাসে একদিনে সর্বাধিক শনাক্ত হয় ৭ এপ্রিল। সেটি ছিল সাত হাজার ৬২৬ জন। সর্বাধিক মৃত্যু ছিল ১১২ জন, গত ১৯ এপ্রিল। মার্চে মোট শনাক্ত ছিল ৬৫ হাজার এবং এপ্রিলে প্রায় দেড় লাখ। আর মার্চ থেকে এপ্রিলে মৃত্যু ছিল চারগুণ বেশি।
সেসময় হাসপাতালে চাপ পড়েছিল উল্লেখযোগ্য হারে। ঢাকার প্রায় সব সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে বেড ও আইসিইউ ছিল পূর্ণ। সেটি আবার স্বাভাবিক হওয়া শুরু করে এপ্রিলের শেষে। সংক্রমণের হার বর্তমানে ১০ শতাংশের নিচে।
সম্প্রতি দেশে শনাক্ত হয়েছে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বি-১৬১৭। ছয় জনের দেহে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। ভারতে এই ভ্যারিয়েন্ট প্রথমে মহারাষ্ট্রে শনাক্ত হয় গত ৫ অক্টোবর। সম্প্রতি এটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। প্রায় প্রতিদিনই রেকর্ড ভাঙছে মৃত্যু ও শনাক্তের। সেদিক চিন্তা করে দেশের সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক হারে করোনা পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক।
সোমবার দেশের চারটি সীমান্ত এলাকার বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠককালে মন্ত্রী বলেন, ‘পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে নতুন ভ্যারিয়েন্টের কারণে প্রতিদিন হাজারও মানুষ মারা যাচ্ছে। ভারতীয় নতুন ভ্যারিয়েন্টটি এখন নেপালে ছড়িয়ে গিয়ে সেখানে ভয়াবহতা সৃষ্টি করেছে। এই ভ্যারিয়েন্ট এখন আমাদের দেশেও চলে এসেছে। এই রকম ক্রিটিকাল সময়ে এই ভাইরাস দেহে নিয়ে ঈদে ঘরমুখো মানুষ যদি গ্রামে চলে যায়, তাহলে গ্রামে থাকা পরিবার পরিজনসহ গ্রামবাসী গণহারে আক্রান্ত হতে পারে।
উচ্চ সংক্রমণের আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেছেন দেশের জনস্বাস্থ্যবিদরাও। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘তৃতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় সংক্রমণ একটু বাড়বে। তৃতীয় ঢেউ হবে কি না সেটা এখন বলা যাবে না। এখন সাস্থ্যবিধি না মানার কারণে যে ক্ষতি তা হবে আমাদের। সেটা আমরা ১৫ দিন পর দেখতে পারবো। ১৫ দিন পর বাড়বে সংক্রমণ। তৃতীয় ঢেউ বলতে গেলে অনেক কিছু হিসেব নিকেশ করে বলতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি আমরা ইচ্ছা করলে ঠেকাতে পারতাম। আমরা যদি সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারতাম তাহলে হতো। মানুষ প্রতিবারই ঈদে বাড়ি যায়। সেটি কি বন্ধ করা যাবে? শুধু মুখে বাড়ি যেতে নিষেধ করলেই কি মানুষ শুনবে? এরকম হয় না। বাস বন্ধ করে দিলে মানুষ বাড়ি যাবে না এমন চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলে দেখা যাচ্ছে অন্য ব্যবস্থায় মানুষ বাড়ি যাচ্ছে। উদ্দেশ্য যদি করোনা ঠেকানো হয় তাহলে বাস বন্ধ করার কি দরকার ছিল। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চালানো গেল না? সব করা যায় কিন্তু বাসের স্বাস্থ্যবিধি চালু করা যায় না?’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, ‘ঈদের পরে হয়তো অনেক বেশি সংক্রমণ দেখা যাবে না। কিন্তু এটার ঝুঁকি তৈরি করবে সামনের দিনগুলোতে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার। তারপর যদি লকডাউন উঠিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আমরা একটা ঊর্ধ্বগতি দেখবো। এর সঙ্গে যদি আবার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট যুক্ত হয় তাহলে মনে হয় আমাদের জন্য সমস্যা হয়ে যাবে।’


বিজ্ঞাপন