করোনার মধ্যেও বেড়েছে ধর্ষণ

অপরাধ

জুলাইয়ে ৬৭, ছয় মাসে ৬৯৭
নিজস্ব প্রতিবেদক : চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী জাকিয়া প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছিলো। এসময় প্রতিবেশি সুমন চন্দ্র দাস এসে তার মুখ চেপে ধরে পাটক্ষেতের ভেতরে নিয়ে যায়। এরপর রশি-গামছা দিয়ে হাত-পা-মুখ বেঁধে তাকে ধর্ষণ করে। জাকিয়া অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে চলে যায়। পরে গভীর রাতে গিয়ে দেখে জাকিয়ার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। এসময় তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে পাটক্ষেতের ভেতরেই গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেয় সুমন। ঘটনাটি ১১ জুলাই দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার রসুপুল ইউনিয়নের বনড়া গ্রামের।
ছাগল দেখতে বের হয়েছিল পঞ্চম শ্রেণির এক মাদরাসাছাত্রী। ওৎ পেতে থাকা রওশন মেয়েটির পথরোধ করে। পরে আলমগীর হোসেন, উত্তম রায় ও অনাথ রায়সহ রওশন রায় মেয়েটিকে জোরপূর্বক পরিত্যক্ত একটি দোকানের ভেতর নিয়ে যায় এবং চারজন মিলে ধর্ষণ করে। ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৩ জুলাই ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার মাধবপুর গ্রামে।
ঈদের আগে গৃহবধূ আয়মনা বেগম (৩০) একই এলাকায় তার নানির বাড়িতে বেড়াতে যান। গত ২৪ জুলাই সকালে বাড়ি থেকে সামান্য দূরে একটি বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে হাঁটু গেড়ে থাকা অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে মরদেহ সজিনা গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। ঘটনাটি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের বরকতপুর ডাঙ্গাপাড়া এলাকার।
দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে প্রতিবেশি বখাটে সাব্বির। ধর্ষণের ভিডিও ও ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানোর ভয় দেখিয়ে পরবর্তীতে ভুক্তভোগীকে একাধিকবার ধর্ষণ করে সে। ঘটনাটি গত ২৩ জুলাই জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার জোড়খালী ইউনিয়নের বারইপাড়া গ্রামের।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও দেশে নারী ও শিশুর প্রতি ধর্ষণ, হত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী জাকিয়া, পঞ্চম শ্রেণি অথবা দশম শ্রেণির ছাত্রী কিংবা গৃহবধূ আয়মনা বেগমের মতো দেশে গত জুলাই মাসে শুধু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬৭ জন। এরমধ্যে ২৮ শিশু ধর্ষণের শিকার, পাঁচজন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, দু’জন ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ও ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যার শিকার হয়েছে একজন। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি থেকে জুন) ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬৯৭ নারী ও কন্যাশিশু। এদের মধ্যে শিশুই ৪৩১ জন।
বুধবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপপরিষদে সংরক্ষিত ১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত জুলাই মাসে মোট ১৮১ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬৭ জন। তাদের মধ্যে ২৮ শিশু ধর্ষণের শিকার, পাঁচজন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, দু’জন ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ও ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যার শিকার হয়েছে একজন। এ ছাড়া চার শিশুসহ ৯ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। একজন শ্নীলতাহানির শিকার হয়েছে। এক শিশুসহ পাঁচজন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। অ্যাসিড দগ্ধের শিকার হয়েছে দু’জন। অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছে একজন। উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে এক শিশু। উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে একজন। পাঁচ শিশুসহ ছয়জন অপহরণের ঘটনার শিকার হয়েছে। নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা ঘটেছে সাতটি। বিভিন্ন কারণে পাঁচ শিশুসহ ২৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়াও দু’জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৯ জন, তাদের মধ্যে দু’জনকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে সাত শিশুসহ মোট ১৩ জন। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছে তিন শিশুসহ ১০ জন। পাঁচ কন্যাশিশুসহ ১৭ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। বাল্যবিয়ে-সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে দুটি। বাল্যবিয়ের চেষ্টা করা হয়েছে একটি। এক কন্যাশিশুসহ সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছে ছয়জন।
এতে বলা হয়, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই ছয় মাসে ৪৩১ কন্যা শিশু ধর্ষণসহ মোট ৬৯৭ জন নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তন্মধ্যে ৪১ জন কন্যা শিশুসহ দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০৪ জন নারী ও কন্যা শিশু। ১২ কন্যা শিশুসহ ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ১৬ নারী ও কন্যা শিশু। ৩৪ কন্যা শিশুসহ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ৪৬ নারী ও কন্যা শিশু। ১২ কন্যা শিশুসহ উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ২২ নারী ও কন্যা শিশু। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২৯ কন্যা শিশুসহ ৯৯ নারী। হত্যার শিকার হয়েছেন ৬২ কন্যা শিশুসহ ২২১ নারী। বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে ২২ কন্যা শিশু।
এদিকে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং-বিষয়ক জুলাই মাসের প্রতিবেদনও বলছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও দেশে নারী-শিশুর প্রতি ধর্ষণ, হত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বিগত মাসগুলোর মতোই অব্যাহত রয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
এমএসএফ বলছে, জুলাই মাসে ধর্ষণের ৬২টি, গণধর্ষণ ২৫টি, ধর্ষণ ও হত্যার ৪টি ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে ৬ জন প্রতিবন্ধীসহ ৪৭ জন শিশু ও কিশোরী রয়েছে। ধর্ষণের শিকার ৬২ জনের মধ্যে ৩৭ শিশু ও কিশোরী রয়েছে। অন্যদিকে গণধর্ষণের শিকার ১৬ জন এবং ধর্ষণ-হত্যার ঘটনায় দুই শিশু ও কিশোরী রয়েছে। ধর্ষণচেষ্টার শিকার ২৬ জনের মধ্যে ১৭ জনই শিশু ও কিশোরী। যৌন হয়রানি ১৫টি ও শারীরিক নির্যাতনের ৩৯টি ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ২৭ জন শিশু-কিশোরীসহ মোট ৬৬ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন।
এইসব ঘটনার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করে আসছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তারা বলছেন, এইসব ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনাগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাশালীরা জড়িত থাকায় তাদের বিচার হয় না। আবার অনেক সময় পুলিশ এইসব ক্ষমতাশালীদের গ্রেফতারও করে না। কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও তারা আবার জামিনে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। ফলে এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে সমাজে খুব ভালো বার্তা যাচ্ছে না। এই কারণে এদের থামানোও যাচ্ছে না। এই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অবশ্যই অপরাধ কমে যাবে।
গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ-ের বিধান যোগ করা হয়। বাংলাদেশে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধর্ষণ, ধর্ষণ জনিত কারণে মৃত্যুর শাস্তি প্রসঙ্গে ৯(১) ধারায় এতদিন ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদ-। তবে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর যদি মৃত্যু হয় বা গণধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হয় বা আহত হন, তাহলেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- অথবা যাবজ্জীবন কারাদ-ের বিধান রাখা হয়েছিল। সেই সঙ্গে উভয় ক্ষেত্রেই ন্যূনতম এক লক্ষ টাকা করে অর্থ দ-ের বিধান ছিল। সেই আইনে পরিবর্তন এনে ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেই মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে অর্থদ-ের বিধানও থাকছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, ধর্ষণ বা ধর্ষণ-পরবর্তী অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলেও একই শাস্তি হবে। যদি কোনো ব্যক্তি তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে শ্লীলতাহানি করেন তাহলে এটি যৌন নিপীড়ন বলে বিবেচিত হবে। এজন্য ওই ব্যক্তির অনধিক ১০ বছর এবং ন্যূনতম তিন বছর সশ্রম কারাদ-ে দ-িত করার বিধান রয়েছে। এবং অতিরিক্ত অর্থদ-েও দ-িত করা হবে।
এছাড়া পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে যদি কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হন, তাহলে যাদের হেফাজতে থাকাকালীন ওই ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে, তিনি বা তারা প্রত্যেকে হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, সর্বোচ্চ ১০ বছর কিন্তু ন্যূনতম পাঁচ বছর সশ্রম কারাদ-ে দ-িত হবেন এবং ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা অর্থদ-েও দ-িত হবেন।


বিজ্ঞাপন