পি কে হালদার সিন্ডিকেটের নতুন কেলেঙ্কারি

অপরাধ অর্থনীতি

পুঁজিবাজারের আরেক প্রতিষ্ঠানের ১৩০০ কোটি টাকা গায়েব
বিশেষ প্রতিবেদক : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আরেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিতর্কিত পি কে হালদার ও তার সিন্ডিকেটের নতুন আর্থিক কেলেঙ্কারি উদঘাটিত হয়েছে। ঋণের আবেদন গ্রহণ না করেই এবং কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই অস্তিত্বহীন ২০ প্রতিষ্ঠানের নামে ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়েছে ভয়ংকর ওই দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ।


বিজ্ঞাপন

দুদক সূত্র জানায়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ফাস ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি রাসেল শাহরিয়ারের এক স্বাক্ষরেই বেরিয়ে যায় ৭০০ কোটি টাকা।

পি কে হালদার ফাস ফাইন্যান্সে কোনো পদে না থাকলেও অর্থ লোপাটে সব কলকাঠি নেড়েছেন তিনি। সাবেক এমডি রাসেল শাহরিয়ার ছিলেন পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ সহচর।

তাই নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভায়ও উপস্থিত থাকতেন পি কে হালদার। তার নির্দেশ ও পরামর্শ অনুযায়ী কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ পাস করা হতো।

দুদক বলছে, ফাস ফাইন্যান্সের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ সংক্রান্ত কোনো আবেদন গ্রহণ না করে, যাচাই-বাছাই ও জামানত ছাড়াই প্রায় ২০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া ঋণ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেন। এভাবেই বেরিয়ে যায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

দুদকের অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, বিপুল অঙ্কের ওই টাকা ভুয়া ২০ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়নি। পরিকল্পনা অনুযায়ী সব টাকাই চলে যায় পি কে হালদার সিন্ডিকেট সদস্যদের নিজ নিজ ব্যাংক হিসাবে।

পি কে হালদারের এই সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ উজ্জ্বল কুমার নন্দী, সিদ্দিকুর রহমান ও জাহাঙ্গীর আলম।

এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, দেশের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ওই সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা।

দুদক সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের শেষের দিকে পি কে হালদার সিন্ডিকেট সদস্যরা ফাস ফাইন্যান্সের শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দখলে নেন। এরপর কৌশলে পুরাতন কর্মকর্তাদের ছাঁটাই করে তাদের পছন্দের লোকজনকে নিয়োগ দেন।

এরই ধারাবাহিকতায় পি কে হালদারের আস্থাভাজন রাসেল শাহরিয়ারকে এমডি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। রাসেল শাহরিয়ার ও পি কে হালদার ২০০৭ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে একসঙ্গে চাকরি করেছেন। তখন থেকেই তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে।

অন্যদিকে, উজ্জ্বল কুমার নন্দী তার পছন্দের লোকজনকে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন। এর মধ্যে পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান ও জাহাঙ্গীর আলম হলেন পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

জানা গেছে, ফাস ফাইন্যান্স থেকে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেওয়ার নির্দেশ দেন পি কে হালদার।

আর ওইসব পরিচালক সেভাবে ঋণ পাস করিয়ে নিতেন। মাঝেমধ্যে লোক দেখানো বোর্ড মিটিং হতো। ওইসব সভায় কোনো আলোচনা ছাড়াই পি কে হালদারের ঋণ-সংক্রান্ত সুপারিশ অনুমোদন করা হতো।

তৎকালীন এমডি রাসেল শাহরিয়ার ওইসব কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে নিজের স্বাক্ষরে ঋণ-সংক্রান্ত মেমো বানিয়ে বোর্ডে উপস্থাপন করে অনুমোদন করিয়ে নিতেন। ঋণের টাকা চলে যেত পি কে হালদারের ব্যক্তিগত বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে।

ফাস ফাইন্যান্সের অর্থ আত্মসাতে যে ২০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো হলো এসএ এন্টারপ্রাইজ, মুন ইন্টারন্যাশনাল, সুখাদা প্রোপার্টিজ, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ, আরবি এন্টারপ্রাইজ, দিয়া শিপিং, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, মেসার্স বর্ন, কণিকা এন্টারপ্রাইজ, দ্রিনান এ্যাপারেলস, বি এন্টারপ্রাইজ, এমার এন্টারপ্রাইজ, জিঅ্যান্ডজি এন্টারপ্রাইজ, তামিম অ্যান্ড তালহা, হাল ইন্টারন্যাশনাল, মেরিন ট্রাস্ট, আর্থ স্কোপ ও এমটিবি মেরিন।

জানা গেছে, গত ১৬ থেকে ১৮ আগস্ট ফাস ফাইন্যান্সের সাবেক চেয়ারম্যান, পরিচালক, এমডি ও বিভিন্ন পর্যায়ের ২২ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক।

জিজ্ঞাসাবাদে তারা জালিয়াতির মাধ্যমে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। এ নিয়ে তারা দুঃখ প্রকাশ করেন। লোপাট হওয়া ওই টাকা উদ্ধারে তারা দুদকের কাছে সময় চেয়েছেন।

ফাস ফাইন্যান্সের অর্থ আত্মসাতের এই অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে দুদক উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিম।