অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ঃ ইকোনমিক টাইমস এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, ভারত ৪১৫ পণ্যে বাংলাদেশের আরোপকরা ট্যাক্স কমানোর অনুরোধ করবে। ভারত এই ৪১৫ পণ্য সারা বিশ্বে রপ্তানি করে $১৪৭ বিলিয়ন আয় করে। বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের ভেতর এই ৪১৫ পন্যের আমদানি ব্যয় প্রায় $১৭.৫ বিলিয়ন। যার ভেতর মাত্র $২.৪ বিলিয়ন আসে ইন্ডিয়া থেকে।
ভারতের সাথে প্রস্তাবিত সেপা চুক্তি করলে বাংলাদেশের এক্সপোর্ট বাড়বে ১৯০% এবং ভারতের ১৮৮%। বাংলাদেশের জিডিপি বাড়বে ১.৭২% আর ভারতের ০.০৩%।
এখানে একটা বিষয় লক্ষ করবার আছে। বাংলাদেশ তার বৈদেশিক বাণিজ্যের ৩৩% করে চীনের সাথে। ভারতের সাথে করে ১৯%। সেপা বাস্তবায়ন হলে দুই দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে সেটাতে সন্দেহ নেই। এটাও সন্দেহ নেই যে ভারতের সাথে ট্রেড বাড়লে খরচ ও সময়ের হিসাবে বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক।
কিন্তু সমস্যা এখানে না। ভারত থেকে আমাদের যে পরিমান আমদানি এর বিপরীতে রপ্তানিকে নগণ্য বলা যায়। দেশটির সাথে বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় $১৪ বিলিয়ন ডলার। এটা মোটেও ছোট অঙ্ক নয়।
আমি আঞ্চলিক বাণিজ্যের পক্ষে। তবে সেটা অবশ্যই হতে হবে বাংলাদেশের অনূকূলে। সেপার বিশ্লেষনে যদি বাংলাদেশের রপ্তানি ১৯০% বৃদ্ধি দেখে পুলকিত হই তাহলে চলবে কেন? ভারতের বৃদ্ধি পাবে ১৮৮%।
অর্থাৎ শতাংশের হিসাবে এটা প্রমাণের চেষ্টা রয়েছে যে এতে বাংলাদেশের বেশি লাভ হবে। বাস্তবে ১৪ বিলিয়নের ঘাটতি সে কথা বলা হচ্ছেনা।
ধরুন ভারত থেকে ১৫ বিলিয়ন আমদানি করে বাংলাদেশ। এই ফিগারের ১৮৮% দাঁড়ায় $২৯ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে বাংলাদেশের রপ্তানি যদি $১ বিলিয়ন হয় তবে এর ১৯০% দাঁড়াবে $১.৯ বিলিয়ন। অর্থাৎ ১৫ বিলিয়ন আমদানির বিপরীতে ১ বিলিয়ন রপ্তানি করলে বাণিজ্য ঘাটতি থাকত $১৪ বিলিয়ন ডলার। সেপার সুফলে বাংলাদেশের ১৯০% রপ্তানি বাড়লে এবং ভারতের রপ্তানি ১৮৮% বৃদ্ধি পেলে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়াবে মাত্র (২৯-১.৯ অথবা 2 বিলিয়ন) অর্থাৎ প্রায় $২৭ বিলিয়ন ডলার।
এই হিসাবে এটা স্পষ্ট ইকোনমিক টাইমস এই ফিগারটিকে সংখ্যায় না প্রকাশ করে শতাংশের হিসাবে কেন প্রকাশ করেছে। এতে বোঝানো যায় বাংলাদেশ বেশি উপকৃত হবে।
বাস্তবতা সেপা হয়ত চীনকে কাউন্টার করার একটা ভাল বাণিজ্যিক অস্ত্রে রুপ নিতে পারে। এবার আরেকটু হিসাব কষা যাক। যেই ৪১৫ পণ্যে ভারত ট্যাক্স কমাতে বলছে এর মধ্যে আছে , ডেনিম, ওভেন ফ্যাব্রিক, পেপার, পেপারবোর্ড, জুয়েলারি, আঙ্গুর, প্লাস্টিক, ফুটওয়ার, সিরামিকের সিঙ্ক, কেবল তার, ইলেক্ট্রিক কন্ডাকটর ইত্যাদি।
ডেনিমে বাংলাদেশ নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ন। বিশ্বের অন্যতম রপ্তানিকারক ও বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে ভারতকে আমরা ২৫% এর স্থানে ২২.৫% শুল্ক অফার করতে পারি। এতে এর প্রভাব এদেশের মিলারদের প্রতিদ্বন্দিতায় হুমকি হবেনা। এ বাদে আঙ্গুর, জুয়েলারিতে ছাড় দেয়া যেতে পারে। একারনে বলছি যে, এই পণ্য বিশ্বের অন্যখান থেকে আনতে গেলে আমাদের বেশি ডলার ব্যয় করতে হবে। অন্য গুলির ক্ষেত্রে প্রয়োজন দেখছিনা। যদিও ৪১৫ টি পণ্যের পুর্নাঙ্গ লিস্ট এইচ এস কোড আমার জানা নেই।
যেকোন ডিলের মূল শক্তি হল দরকষাকষি। যদি শতাংশের হিসাবের পরিবর্তে বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টির দিকে জোর দেয়া যায় এবং ওদের দেশে গার্মেন্টস রপ্তানির কোটা, এন্টি ডাম্পিং এর নামে প্রতিবন্ধকতা এবং অন্যান্য নন ট্যারিফ ব্যারিয়ার উঠানো যায় তবে সেটা মন্দ হয়না।
এক্ষেত্রে মনে করিয়ে দিতে হবে চীন বাংলাদেশের জন্য ৯৯% পণ্যে শুল্ক মুক্ত সুবিধা দিয়েছে। ভারতকেও এরকম কিছু করার তাগিদ দিতে হবে। জানি ওদের মন এত বড় নয়। যদি না দিতে পারে তাহলে ডিল ঝুলিয়ে রাখতে হবে এবং অন্যান্য বৃহৎ ইকোনমির সাথে ফেবারেবল ট্রেড ডিল করতে হবে। আস্তে ধীরে সবকিছু লাইনে চলে আসবে।
এক্ষেত্রে বলতে চাই, বাণিজ্যের ফুল বেনিফিট নিয়েও আমাদের নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। এমন কিছু করা উচিত হবেনা যেটাতে দেশের সক্ষমতায় আঘাত লাগে। আঞ্চলিক বাণিজ্যের সুবিধা অনেক। তবে সেটা যদি এক পাক্ষিকভাবে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি সৃষ্টি করে তবে সেটার সুবিধাগুলি ঝুঁকিতে রুপ নেয়। নিত্য পণ্যে আমরা দেখেছি ভারত নির্ভরযোগ্য আমদানি অংশীদার নয়। হুট করে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার রেওয়াজ তাদের আছে।
এজন্য বাণিজ্য অতি নির্ভরশীলতা বাংলাদেশের জন্য সুখকর হবেনা। তবে যদি সেদেশের বাজার বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত হয় এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা যায় বা সারপ্লাস হবার সুযোগ থাকে সেক্ষেত্রে না করার মানে নেই।
আরেকটি একটি কথা বলে রাখা ভালো , ভারত আরব আমিরাতের সাথেও সেপা চুক্তি করতে যাচ্ছে। এবং আশা করছে যে দুই দেশের বাণিজ্য শত বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে।
এখানে বাংলাদেশের সাথে আরব আমিরাতকে মেলালে হবেনা। কারন আরব আমিরাতের কাছে ভারত নির্ভরযোগ্য আমদানি উৎস। ওদের সাথে হুট করে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়না ভারত। বিষয়টাকে সব আঙ্গিকেই ভাবা জরুরি। বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি থাকবার পরেও ৪১৫ পণ্যে শুল্ক কমানোর অনুরোধ মানসিকতার পরিচয় বহন করে অবশ্য।