নিজস্ব প্রতিবেদক : পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট নিয়ে ধোঁয়াশা যেন কাটছেই না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ‘করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, আক্রান্তদের একটি বড় অংশ স্বাস্থ্যকর্মী। স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবন রক্ষা করতে না পারলে অনেক লোকের প্রাণ যাবে।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশঙ্কাকে সত্যি করে বাংলাদেশেও চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ইতোমধ্যে দুজন চিকিৎসকের আক্রান্ত হওয়ার কথা স্বীকার করেছে সরকার। আরও কয়েকজন চিকিৎসক কোয়ারেন্টিনে আছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বলছেন, ‘পিপিই এসেছে, আসছে এবং আসতেই থাকবে। চিন্তিত হবার কিছু নেই।’ বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পিপিই ছাড়াই ডিউটি করতে হচ্ছে তাদের। তার মানে পিপিই আছে, আর পিপিই নেই—এমন একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্তের কথা জানায় জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। তারপর থেকেই চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের জন্য পিপিই’র দাবি তুলেছেন। কয়েকটি জায়গায় পিপিই না থাকার কারণে চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। চলতি সপ্তাহেই প্রথমে খুলনা বিভাগের পরিচালক ও পরে ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন অফিস থেকে জারি হওয়া দুটো নোটিশে দেখা যায়, পিপিই সরবরাহ বন্ধ বা কম থাকার কারণে চিকিৎসকদের তারা নিজ দায়িত্বে পিপিই সংগ্রহ করতে বা বানিয়ে নিতে বলেছে।
চিকিৎসকরা প্রশ্ন রেখেছেন শুরু থেকে আনা লাখ লাখ পিপিই কোথায় কাদের সরবরাহ করা হলো। কয়েকদিন আগে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক তার হাসপাতালের চিকিৎসকসহ অন্যদের জন্য নিজ দায়িত্বে পিপিই কেনার প্রজ্ঞাপন জারি করেন। যদিও পরের দিনই ফের প্রজ্ঞাপন দিয়ে বলা হয়, যথেষ্ট পরিমাণ পিপিই রয়েছে এবং ওই পরিচালককে অব্যাহতি দেওয়া হয়। চিকিৎসকদের প্রশ্ন আসলেই কি পিপিই সংকট রয়েছে, নাকি কৃত্রিমভাবে এ সংকট তৈরি করা হয়েছে? সেটিও তদন্ত হওয়া উচিত বলে মনে করেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, যেসব চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করবেন, সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে সরকার তাদের সুরক্ষার বিষয়টি দেখছে। সে উদ্দেশ্যে প্রতিদিন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পিপিইসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে। এসব সামগ্রীর কোনও অভাব হবে না এবং সরকার এ বিষয়ে নজরদারি রাখছে।
যদিও পিপিই নিয়ে মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতর কাছাকাছি সময়ে পরস্পরবিরোধী কথা বলেছে। গত ২০ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ কোভিড-১৯ নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত কর্মীদের জন্য ১০ লাখ পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) সংগ্রহ করা হবে। তাতে করে কোনও সেবাকেন্দ্রে পিপিইর কোনও অভাব হবে না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ১০ লাখ পিপিই’র ঘোষণার ঠিক তিন দিন পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সংবাদ সম্মেলনে চিকিৎসকদের পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্টের এখন এত প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেন।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানা যায়, সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোরস ডিপো (সিএমএসডি) তে করোনার জন্য গত ২৩ মার্চ পর্যন্ত তিন লাখ ৫০ হাজারের মতো পিপিই সংগ্রহ করার পর ২ লাখ ৮৫ হাজারের মতো বিতরণ করা হয়েছে। মজুত আছে ৬৫ হাজারের মতো, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। অপরদিকে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. ইকবাল কবীর (পরিকল্পনা) জানান, এপ্রিল থেকে শুরু করে আমাগী তিন মাসে প্রায় ১০ লাখের মতো পিপিই আর মাস্ক দরকার হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসক বা নার্সরা যে পিপিই পরবেন, সেটা হতে হবে যেকোনও তরল (বমি, রক্ত, কেমিক্যাল) প্রতিরোধী। তবে তাতে নিঃশ্বাস নেওয়ার উপায় থাকতে হবে। আর এসব পিপিই ওয়ানটাইম ইউজ অর্থাৎ একবার ব্যবহারের পরই সেটি আর পরা যাবে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডেফিনেশন অনুযায়ী, এসব পিপিইর কাপড় হতে হবে নির্ধারিত। কিন্তু তা যদি না হয় তাহলে এর উদ্দেশ্য সফল হবে না, বরং তাতে আরও সংক্রমণের আশঙ্কা থাকছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিপিই আছে, আর পিপিই নেই এমন একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পিপিই ছাড়াই ডিউটি করতে হচ্ছে তাদের।
‘আমরা খুবই আনপ্রটেক্টেড’−এ মন্তব্য চটগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগের একজন চিকিৎসকের। নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেছেন, পিপিইর বিষয়ে আমরা একেবারেই সন্তুষ্ট না। পর্যায়ক্রমে পিপিই এলেও আশঙ্কায় আছি যে, কাল নাগাদ সাপ্লাই থাকবে কিনা। আমরা একসঙ্গে অনেক পিপিই চাই। প্রয়োজনে আমাদের কাছ থেকে মন্ত্রণালয় জেনে নেবে, সাত অথবা ১৫ দিনের চাহিদা কী।
এই চিকিৎসক জানান, চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য একেবারে হিসাব করে কমপক্ষে ৭৮ হাজার পিপিই চাওয়া হয়েছে এক মাসের জন্য, কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের হাতে রয়েছে মাত্র দুই হাজার ৯০০টি।
২৮ মার্চ মোটে সাড়ে তিনশ’ পিপিই দেওয়া হয়েছে দাবি করে সূত্রটি জানায়, ১০০টি উপজেলায় যদি তিনটি করেও দেওয়া হয়, তাহলে সাড়ে তিনশ’ পিপিই দিয়ে আমাদের কী হবে? এভাবে আসলে হয় না। যেকোনও দুর্যোগে মজুত থাকতে হয়—আরও মজুত লাগবে আমাদের, যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর বলেন, ‘সরকার এখন হয়তো একসঙ্গে এতগুলো দিতে পারবে না। কিন্তু একটা টাইম ফ্রেম ধরে নিয়ে আমাদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া উচিত। আমি আশা করবো, এটা কন্টিনিউয়াস সাপ্লাই হবে, যেন ঘাটতি না হয়।’
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘করোনার এই যুদ্ধে ফার্স্ট লাইন অব ডিফেন্স চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। অথচ সবাই বলছেন পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাহলে কি আমরা পরিস্থিতি ভয়াবহ হবার জন্য অপেক্ষা করবো, নাকি আগে থেকে প্রস্তুতি নেবো এ সিদ্ধান্ত যখন অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল, সেখানে আমরা এখনও এর জন্য অপেক্ষা করছি।’
যেসব অনুদানের পিপিই বিভিন্ন সময়ে এসেছে, সেগুলোর কোয়ালিটি ভীষণভাবে নি¤œমানের। গগলসের প্লাস্টিক খুলে গেছে এমন প্রোডাক্টও আমরা পেয়েছি। এমন পিপিইও এসেছে যেগুলো চিকিৎসক নয়, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য। সেগুলো কী করে চিকিৎসকদের দেবো কাছে এমন প্রশ্ন তুলে ধরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি সূত্র। সূত্রটি আরও জানায়, এমন অনেক অনুদানের পিপিই রয়েছে সেগুলো তালাবদ্ধ করে রেখে দেওয়া হয়েছে মানসম্মত নয় বলে।
তবে একইসঙ্গে বিভিন্ন সোর্স থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা সেক্রেটারিয়েটে ‘একটা হ্যান্ডসাম অ্যামাউন্ট’ রোববার (২৯ মার্চ) থেকে আসবে কন্ট্রোল রুমে। আর সিএমএসডিতে মজুত রয়েছে বেশকিছু বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের লজিস্টিক ও পাবলিক পার্টনারশিপের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘পিপিই এসেছে, আসছে এবং আসতেই থাকবে। এটা বন্ধ হবে না, সুতরাং চিন্তিত হবার কিছু নেই।’