মোঃ কিশোর : কোলকাতার এই নামটি অনেক পথ অতিক্রম করে আজ এমনভাবে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। ব্রিটিশরাই এই শহরের গোড়পত্তন করেন প্রথমে ।কলিকাতা বৃটিশরাজের রাজধানী হিসাবে পরিচালিত হয়ে আসলেও পরবর্তিতে ১৯১১ সালে কলকাতা থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়।৪৭ এর আগে বাংলাদেশ( পুর্ববাংলা) থেকে কলকাতায় যাওয়া আসা একটা নৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। আমাদের দাদা নানারা কলকাতার সাথে অনেক বেশী পরিচিত ছিলেন।আর আমরা কলকাতা চিনেছি ইতিহাস-গল্প-সাহিত্য-নাটক-গান-সিনেমার মাধ্যমে।

কলিকাতার নামকরণ নিয়ে অনেক বক্তব্য আছে ।
তবে এই শহরের প্লান করেন , ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট জনাব জব চার্ণক।সেও ১৬০০ সালের শেষের দিকে।
নামকরনের যে কটি তথ্য পাওয়া যায় তার মধ্যে কয়েকটি হল – –
কোলকাতা শহর তিনটি গ্রামের উপর গড়ে উঠেছে।গ্রামগুলো হল, সুতানুটি, কালিকাতা আর গোবিন্দপুর।

ধরে নেয়া হয় যে, এই কালিকাতা গ্রামের ( যা ইডেন গার্ডেন এলাকায় ছিল) নাম থেকে থেকে কোলকাতা নামটা নেয়া হয়েছে। এছাড়াও কলিকাতা নামটা নাকি এক ব্রিটিশের মুখ থেকে এসেছে ।একজন ইংরেজ যখন এক দেশী কৃষকনকে এলাকার নাম জিজ্ঞেস করলে সে কৃষক ভেবেছিল তার ফসল কাটার কথা জিজ্ঞেস করেছে ভেবে সে ইংরেজ কে বলেছিল, ‘কাল কাটা হয়েছে’।
এই কাল কাটা ইংরেজের মুখ থেকে নাকি কালকাটা >ক্যালকাটা > হালের কোলকাতা হয়েছে।
আরো তথ্য আছে, সেগুলোর মধ্যে অনুপমম হল এই এলাকায় শামুক ঝিনুক পুড়িয়ে চুন করাহত। শামুক পোড়ানো হত বা কালি করা হত বলে একে এমন নাম করা হয়েছিল।
এও অনেকে বলে , এটা একটা সমতল এলাকা বা ফ্লাট এরিয়া বলে স্থানীয় ভাবে একে কিল কিলা বলত লোকে , সেখান থেকেও কলিকাতা নামটা আসতে পারে বলে অনেকে ধারনা করেন।
সর্বোপরি, অনেকে ধারনা করেন, দেবী কালীর (Place Of Kali) নাম থেকে এই কলিকাতা নামটা এসেছে।
যেভাবেই নামকরণ হোক না কেন , নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাহর পতনের পর কলিকাতার দিকে নজর পড়ে ইংরেজদের।তারা লন্ডনের পর এই শহরে গড়ে তোলে তাদের ‘দ্বিতীয় সাম্রাজ্য শহর’।
আমি লন্ডন আর কলিকাতার স্ট্রাকচারাল দারুন মিল দেখেছি ।লন্ডন শহরের পুরনো বিল্ডিংগুলো আগের মত রেখে দিয়েছে।অথচ একই রকম বিল্ডিংসে ভরা কলিকাতার সব বিল্ডিং এর ভগ্নজরাজীর্ণ অবস্থা।দেয়ালে ,ছাদে গজিয়ে উঠেছে নানান আগাছা, বটের শেকড় – – যেন ধ্বংসের অপেক্ষায় – – – –
এই যে ইংরেজরা এই উপমহাদেশ শাসন করা শুরু করল।ইংরেজের পায়ের নীচে মাটি আসে প্রথমে এই কলকাতা বা বাংলার মাটিতে – –
ইংরেজরা বা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মুঘল আমল থেকেই অনেক দেনদরবার করছিল কম ট্যাক্স বা খাজনায় ব্যবসা করার জন্য।সে সুযোগ মিলে যায় বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সময়। জাহাঙ্গীরের মেয়ের আগুনে পুড়ে ক্ষত হলে ইংরেজ ডাক্তার গ্যাব্রিয়েল বুটান তাকে সারিয়ে তুলে বাদশাহর আস্থা অর্জন করে ব্যবসার অনুমতি পান।এর পরে তিনি বাঙ্গলার সুবাদার শাহ সুজার রাজমহলে রাজনারীদের চিকিৎসা করিয়ে রাজার কাছ থেকে ব্যবসার আরো কিছু সুবিধা সহ আলাদা ফোর্ট বানানো এবং তার সিকিউরিটির জন্য নিজস্ব ফোর্স ব্যবহারের অনুমতি লাভ করে ।তারপরে তো ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে করে পলাশীতে বাঙ্গলার নবাবকে পরাজিত করে ।তারপর শক্তি সঞ্চয় করে দূর্বল মুঘল শাসককেও উৎখাত করে এই উপমহাদেশ ইংরেজেদের দখলে আসে ।আমাদের নিজস্ব বিশ্বাসঘাতকতার কথা আর নাইবা বললাম- – –
যা হোক , কলকাতায় পা দিয়ে মনে হয়েছে এই শহর আমার আগে থেকে চেনা। বিবেকানন্দ, ঈশ্বরচন্দ্র ,রবী ঠাকুর, মাইকেল, নজরুল,সমরেশ, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সত্যজিৎ, উত্তম কুমার, শক্তি চট্টপাধ্যায়- – -এঁদের কল্যানে এই শহরের নানা ঘটনা , নানা স্থান আর স্ট্রিটের সাথে আমি খুব পরিচিত । ভিক্টোরিয়া পার্ক, এসপ্লানেড, পার্কস্ট্রিট, নিউমার্কেট,লেনিন স্মরনী, সেক্সপিয়ার স্মরনী, মির্জা গালিব স্মরণী, যেন কত যুগের চেনা আমার।
শহরের অনেক জায়গায় ঘুরেছি -ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, সাইন্স সিটি, ওয়াক্স মিউজিয়াম, ইকো পার্ক বাবুরঘাট, নিউমার্কেট, আলিয়া ইউনিভার্সিটি, মারকুইস স্ট্রিট, আকাশবানী বিল্ডিং – –
সারা কলকাতা ঘুরে আমার মনে হল এই শহরটা অনেকটাই লন্ডন শহরের মত ।একই রকম বিল্ডিং বা স্থাপনা ।কিন্ত লন্ডন শহর অবিকল অমনই রাখা হয়েছে আর কলকাতার বিল্ডিং এ যত্নের অভাবে গজিয়েছে জংগল, কোথাও ভেঙে পড়েছে, কোথাও বিপদজনক ইমারত হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে যেন এই পুরনো বিল্ডিংসগুলো ঘাড়ের উপর জঞ্জাল হয়ে পড়ে আছে । অনেক বিল্ডিং সরিয়ে ফেলা হয়েছে সেখানে মাথা উচু করে আছে হাইরাইজ বিল্ডিং।
কিন্ত এমন না হয়ে এগুলো নান্দনিক হেরিটেজ হতে পারত।
লন্ডন যেমন এখনো কত সুন্দর, দেখলেই শত বছরের ছোয়া পাওয়া যায় !!
তবে সময়ের অভাবে বইপাড়ায়, কফি হাউজে যেতে পারিনি।
এই শহর আমার কাছে অচেনা মনে হয়নি। মনে হয়েছে কত আপন । শান্তি নিকেতন ও রবীন্দ্রভারতীসহ কলকাতাকে আরো একটূ বেশি নিজের করে দেখবার জন্য আমাকে আবার যেতে হবে। আমি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।