বেড়েছে এডিসের লার্ভা-ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা

অন্যান্য এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন ঢাকা রাজধানী স্বাস্থ্য

মশক নিধনে ডিএসসিসির ক্র্যাশ প্রোগ্রাম
জুনে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ১৫৫৩ জন

মহসীন আহেমদ স্বপন : বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই আষাঢ়ে বৃষ্টিতে বেড়েছে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার লার্ভা। সেই সঙ্গে বাড়ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
জানা গেছে, গত সোমবার (২৩ জুন) থেকে বৃহস্পতিবারের (২৭ জুন) মধ্যে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশুসহ ৩০ জন রোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
এদিকে মশক নিধনে বিশেষ ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। সোমবার (১ জুলাই) রাজধানীর মন্ত্রিপাড়ার হেয়ার রোডে মশক নিধনে বিশেষ ক্র্যাশ প্রোগ্রাম উদ্বোধন করেন দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন। এ সময় ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া নিয়ে নগরবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মেয়র বলেন, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গতকাল থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত ডিএসসিসির প্রতিটি ওয়ার্ডে আমাদের মশক নিধনকর্মীরা একযোগে কাজ করবেন। এছাড়া ১৫ জুলাই ডিএসসিসি বিশেষ স্বাস্থ্য সেবা হটলাইন চালু করবে। নগরের কেউ অসুস্থ হলে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা নিতে পারবেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শরীফ আহমেদসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
হাসপাতালের তথ্যনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ১০৯ জন রোগী ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে রাবেয়া সরদার (৫০) নামে একজন মারা গেছেন। তিনি ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে গত ২২ জুন ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৬ জুন তার মৃত্যু হয়।
হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে কথা হয় ডেঙ্গু আক্রান্ত নিশাত (১৭) নামের এক কলেজ ছাত্রীর সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে ফার্মগেটের একটি কোচিং সেন্টারে পড়ছেন তিনি। থাকতেন একটি হোস্টেলে। গত ১৭ জুন জ্বর আসে তার। এক সপ্তাহেও জ্বর না সারায় ২৪ জুন হাসপাতালে ভর্তি হন এবং পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পরে।
শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে কথা হয় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত জান্নাত আক্তার মিমের মা মিনারা আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, মিম স্থানীয় একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। গত ২১ তারিখে জ্বর হয় মিমের। পরীক্ষার মাধ্যমে গত ২৬ তারিখে ডেঙ্গু ধরা পরে। সেদিন থেকেই তিনি হাসপাতালে ভর্তি।
জুরাইন ঋষিপাড়া থেকে ২৭ তারিখে ভর্তি হন পলি দাস (২৭) নামের এক গৃহবধূ। গত সাত দিন থেকে জ্বরে ভুগছিলেন তিনি। তাদের মতো আরও ৫৪ জন রোগী এখন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বর্হিবিভাগের আবাসিক চিকিৎসক শাইখ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘হাসপাতালের বর্হিবিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৫০ জন জ্বরের রোগী আসে। এর মধ্যে অনেকেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করে আসে আবার অনেকেই সাধারণ জ্বর নিয়ে আসে। যাদের রক্তের প্লাটিলেট (অনুচক্রিকা) কম থাকে তাদের ভর্তি করে থাকি। এরকম প্রতিদিন গড়ে ১৪ থেকে ১৫ জন রোগী ভর্তি হয়।
তিনি জানান, বাংলাদেশের আবহাওয়া অনুযায়ী জুন-জুলাই ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার প্রজনন মৌসুম। এ সময় থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে যায়। জমে থাকা পানিতে এডিস মশার জন্ম হয়।
ডা. শাইখ আব্দুল্লাহ বলেন, এবার দেশের সামগ্রিক আবহাওয়া ডেঙ্গুর যথেষ্ট উপযোগী। এ রোগ থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখতে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। রোগের কিছু সাধারণ উপসর্গ হলো- বিরামহীন মাথাব্যথা, হাড়, হাড়ের জোড় ও পেশিতে ব্যথা, বমিভাব ও বমি হওয়া, গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, সারা শরীরের ফুসকুড়ি দেখা দেওয়া, চোখের পেছনে ব্যথা হওয়া ইত্যাদি।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং প্রচুর পরিমাণে তরল পান করার (যেমন পানি, ডাবের পানি, স্যালাইনের পানি) পরামর্শও দেন এই চিকিৎসক।
তিনি বলেন, এর মাধ্যমে দ্রুত রোগমুক্ত হওয়া যায়। এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ডেঙ্গু সাধারণত সেরে যায়। তবে কিছু রোগীর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এসব ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ডেঙ্গুর বিপদজনক উপসর্গ সমন্ধে ডা. শাইখ আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করলে শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়। এসময় ত্বকও শীতল হয়ে যেতে পারে। অবিরাম অস্বস্তি, ত্বকের ভেতরের অংশে রক্তক্ষরণের কারণে ত্বকের ওপরের অংশে লাল ছোপ সৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে বমি, মল কিংবা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, প্রচ- পেটব্যথা ও অনবরত বমি, নাক ও দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ ও অবসাদ লাগতে পারে। এসব উপসর্গ চোখে পড়লে আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ১৫৫৩ জন : জুন মাসে রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছে ১৫৫৩ জন। মৃতের হয়েছেন একজনের। যা গত বছর এ সময়ের চেয়ে পাঁচগুণেরও বেশি। চিকিৎসকরা বলছেন, এবারের আক্রান্তের মধ্যে মারাত্মক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। যদিও বিষয়টি মানতে নারাজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, তবে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় হাসপাতালগুলো প্রস্তুত বলে জানান তারা।
মৃতের সংখ্যা আশঙ্কাজনক না হলেও ক্রমেই যেন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে রাজধানীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ২৫ জুন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় ১১২ জন, পরের দিন ৭৫ জন, ২৭ জুন ১১৫, ২৮ জুন ৫৪ জন, ২৯ জুন ১০৪ ও মাসের শেষ দিনে এই সংখ্যা ছিল ৫২ জন। গোটা জুন মাস জুড়ে এই সংখ্যা ১ হাজার ৫৫৩ জন। অথচ গত বছর এই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ২৯৫। আক্রান্তের তুলনায় মৃতের সংখ্যা কম হলেও আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে এর অধিকাংশই আক্রান্ত মারাত্মক ডেঙ্গুতে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে সংখ্যা বাড়লেও তা এখনো ভয়াবহ পর্যায়ে নয়। আর আক্রান্তের মধ্যে কোন টাইপের বেশি সে বিষয়ে পরীক্ষা শেষেই নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে ডেঙ্গু মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। এই মৌসুমে এপ্রিলে ২ জনের পর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৯ জুন মারা গেছে আরও একজন।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *