বাঙালি জাতির এক অনুপ্রেরণার নাম বঙ্গমাতা

উপ-সম্পাদকীয়/মতামত

এইচ এম মেহেদী হাসান
১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামের শেখ জহুরুল হক এবং হোসনে আরা বেগমের ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন শেখ ফজিলাতুন্নেসা। তাঁর ডাক নাম ছিল রেণু। এক ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।
আবহমান গ্রাম বাংলার প্রকৃতির সৌন্দর্যের রাণীক্ষেত টুঙ্গিপাড়ার গ্রামে শেখ ফজিলাতুন্নেসা (রেণু) বাবা-মা’র আদরে বেড়ে উঠতেছিলেন। কিন্তু এই আদর যত্ন, ভালোবাসা বেশিদিন টিকেনি। শৈশবে বাবা-মাকে হারিয়ে শেখ ফজিলাতুন্নেসা (রেণু)’র জায়গা হয় দাদা শেখ কাশেমের কাছে। দাদার পাশাপাশি মাতৃস্নেহে আগলে রাখেন তাঁর চাচি সায়েরা খাতুন এবং পরবর্তীতে এই চাচি-ই তাঁর শাশুড়ি অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মা সায়েরা খাতুন।
পিতার অভাব বুঝতে দেননি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাবা শেখ লুৎফর রহমান। তাঁদের আদরেই বড় হয়ে ওঠেন শেখ ফজিলাতুন্নেসা (রেণু)।
নিজেদের সন্তানদের সঙ্গে শৈশবে শেখ ফজিলাতুন্নেসাকেও ভর্তি করিয়ে দেন স্হানীয় মিশনারি স্কুলে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার অন্তরায় হিসেবে কাজ করে তৎকালীন সমাজব্যবস্থা, তাই লেখাপড়া আর এগোয়নি। তবে ঘরে বসেই পড়ালেখা করেছেন তিনি। বেগম রোকেয়ার মতো তিনিও লড়াই করে ঠিকই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন শৈশব-কৈশোরে। জ্ঞান অর্জন করতে শুধুই যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই মুখ্য তা তিনি ভুল প্রমাণ করেছেন।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, ‘রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন মা মারা যান। একমাত্র রইলো তাঁর দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়।’


বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘ অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে অন্যত্র লিখেছেন, ‘আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন,’ তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুইবোনকে লিখে দিয়ে যাব। ‘ রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে।’
বিয়ে হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এন্ট্রান্স পাস করার পরই মূলত তাঁদের সংসার জীবন শুরু হয়। তাঁদের বিয়ের ফুলশয্যা হয়েছিল ১৯৪২ সালে।
এ বছরই তিনি ভর্তি হন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। সেখানেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্ররাজনীতি করার কারণে প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং পড়ালেখার চাপে বাড়িতে আসতে পাড়তেন না।
এই সময়টায় বিভিন্ন ধরণের বই পড়ে সময় কাটতো বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের। অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও প্রবল মুখস্থ বিদ্যার অধিকারী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব সময়কে মূল্যায়ন করে হয়ে ওঠেন একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অনন্য মানুষ।
শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই তিনি ছিলেন সুক্ষ্ম প্রতিভাসম্পন্ন জ্ঞানী,বুদ্ধিদীপ্ত, দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল। জাতির পিতার ‘ অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘ লেখার ক্ষেত্রেও মূল প্রেরণা ও উৎসাহ ছিল তাঁর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতেও সহধর্মিণীর সেই অবদানের কথা স্মরণ করেছেন। জীবন সংগ্রামের সব কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে তিনি পরিবারও সামলেছেন বেশ গুছিয়ে। সবকিছুর পরেও তিনিই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের রাজনীতির শ্রেষ্ঠ ছায়াশরীর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালি জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের অবদান, অনুপ্রেরণা ও আত্মোৎসর্গ অনস্বীকার্য। তাঁর কারণেই একটি জাতির মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন বপণ করে এর স্বাদও এনে দিতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে পেছন থেকে কাজ করেছেন তাঁর-ই প্রিয় সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব(রেণু)।
মুক্তির মহামানব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। এ অর্জন জাতির পিতার আজীবনের লালিত স্বপ্ন।
জাতির পিতার এসব লড়াই সংগ্রামে আন্দোলনের নেপথ্যের প্রেরণাদাত্রী ছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমগ্র রাজনৈতিক জীবন ছায়ার মতো অনুসরণ করে তাঁর প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অফুরান প্রেরণার উৎস হয়ে ছিলেন।
মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় লিখেছেন, ‘ বিশ্বে যা কিছু চির সুন্দর, কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর’।
মহীয়সী নারী বঙ্গমাতার জীবনী বিশ্লেষণ করলে মানবতার কবি,সাম্যের কবি, বিদ্রোহী কবির এই কবিতার যথার্থ প্রতিফলন দেখা যায়।
বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয়-দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বার বার পাকিস্তানি শাসকদের হাতে বন্দি জীবন যাপন করছিলেন, তখন আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের কাছে ছুটে আসতেন। তিনি তাঁদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা পৌঁছে দিতেন এবং আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা যোগাতেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তি নিয়ে কিছু কুচক্রী মহল স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলো, তখন প্যারোলে মুক্তির বিপক্ষে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের দৃঢ়চেতা অবস্হান বাংলার মুক্তির সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছিল। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব যুগে যুগে কালে কালে পৃথিবীর ইতিহাসে এক কালজয়ী মহীয়সী নারীর অবস্হানে রইবে। তাঁর চিন্তা, চেতনার নির্যাস মানুষ সাদরে গ্রহণ করে উপকৃত হয়ে আসছে।
ছাত্রনেতা, তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়ালেখা কালীন, ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত থাকার কারণে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হতো। আর সেই অর্থের যোগান দিতেন তাঁর-ই সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব (রেণু)। তিনি তাঁর পিতৃ-সম্পত্তি থেকে অর্জিত অর্থ বিনা দ্বিধায় পাঠিয়ে দিতেন স্বামী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। তিনি যে কত বড় ত্যাগ স্বীকারকারী নারী তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রজমানের ওপর জেল-জুলুম চালিয়ে তাঁকে থামাতে চেয়েছিল কিন্তু বঙ্গবন্ধু থেমে থাকার মানুষ ছিলেন না। কারণ তার পিছনে একজন প্রেরণাদাত্রী মহীয়সী নারী ছিলেন। তিনি তাঁর প্রিয় সহধর্মিণী রেণু। ওই কঠিন সময় বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন তিনি। নিজের ঘরের আসবাবপত্র, অলংকার বিক্রি করেও দল ও নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
একজন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হয়েও সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করতেন তিনি। তাঁর বাড়িতেও কোনো বিলাসী আসবাবপত্র ছিলোনা,ছিলো না কোনো অহংবোধ। তাঁর সদয় আচরণ ও বিনয়ে মুগ্ধ ছিল সবাই। তিনি তাঁর সন্তানদের যেমন ভালোবেসেছেন তেমনি আবার শাসনও করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার লড়াই সংগ্রাম করার কারণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে জেলখানায় থাকতে হতো বেশিরভাগ সময়।
সেই কারণেই পিতা-মাতা উভয়েরই কর্তব্য পালন করতে হয়েছে তাঁকে। কোমলে কঠোরে মিশ্রিত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই সাহসী নারী স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সন্তানদের গড়ে তোলেন। তিনি সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলেন।
তাঁর কাছে সাহায্য সহযোগিতা চেয়ে কেউ কখনো খালি হাতে ফিরে গেছে এমন কোন নজির নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির অর্জিত অর্থ ব্যয় করে দরিদ্র ঘরের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন কিংবা অনাহারে কষ্টে থাকা অসহায় মানুষকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য। ওই বছরই সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। তারা ওঠেন ঢাকার গেণ্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী লেনের একটি বাড়িতে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হওয়ার কারণে সরকারি বাসা পান। বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবার নিয়ে ওঠেন মিন্টো রোডের সরকারি বাড়িতে। কিন্তু পাকিস্তান যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলে অল্পদিনের নোটিশেই ছাড়তে হয় সরকারি বাড়ি। একদিকে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ঢাকায় নতুন, অন্যদিকে বার বার বাসা পাল্টাতে হয়েছে তাদের।
বঙ্গবন্ধুর জেলে যাওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পাকিস্তানের গলারকাঁটা ছিল বঙ্গবন্ধু। এই সংকটময় সময় দৃঢ়চেতা মনোবলে সবকিছুই সামলিয়েছেন তিনি।
১৯৬১ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বাড়ি করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই বাড়ি ছিল বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার সারাজীবনের স্বপ্নের নীর। এই বাড়ি নির্মাণেও বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের অনেক কষ্ট ও শ্রম জড়িয়ে রয়েছে। সততা ও আদর্শ নিয়ে চলতে গেলে যা হয়।
১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর নিজেদের বাড়িতে ওঠেন তাঁরা। এরপর এই বাড়িটিই হয়ে ওঠে বাঙালিদের আপন ঠিকানা। বিশেষ করে নেতাকর্মীদের তীর্থস্থল।
ধানমন্ডির এই বাড়ি থেকেই পরিচালিত হয়েছে দলীয় কার্যকলাপ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনামূলক নানা কার্যক্রম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে থাকার সময় ধানমন্ডির এই বাড়িতেই ছুটে আসতেন নেতাকর্মীরা। তখন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বুদ্ধি-পরামর্শসহ নানাভাবে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ক্ষেত্রেও রয়েছে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের বুদ্ধিমত্তার ছাপ।
সারা বিশ্বের সফল রাষ্ট্রনায়ক, বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গমাতার জন্মদিন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন,
‘ ৭ মার্চ ভাষণের আগে কতজনের কত পরামর্শ, আমার আব্বাকে পাগল বানিয়ে ফেলছে। সবাই এসেছে এটা বলতে… হবে, ওটা বলতে…হবে। আমার মা আব্বাকে খাবার দিলেন, ঘরে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। আব্বাকে সোজা বললেন, তুমি ১৫টা মিনিট শুয়ে বিশ্রাম নিবা। অনেকেই অনেক কথা বলবে। তুমি সারা জীবন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছ, তুমি জেল খেটেছ। তুমি জান কী বলতে হবে…? তোমার মনে যে কথা আসবে, সে কথাই বলবা।’
এরপর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে উত্তাল জনসমুদ্রে তর্জনি উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম-আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ‘
বঙ্গবন্ধুর সেই ডাকেই স্বাধীনতার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ডাকে ছিল বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন। এই সমর্থন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সাহস জুগিয়েছিল। আজ এই ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। ‘
এছাড়া ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চের পতাকা উত্তোলনেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রজমানের প্রধান উদ্দীপক ও পরামর্শক হিসেবে বিবেচনা করা হয় মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সম্পূর্ণ নয়টি মাস অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য্য নিয়ে তিনি পরিস্হিতি মোকাবেলা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি বন্দিদশায় ছিলেন। তবুও তিনি সাহস ও মনোবল হারাননি। তিনি জানতেন একদিন তাঁর স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হবেই। আর তা-ই হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জিত হয়। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ভবিষৎবাণী বাস্তবে রুপ লাভ করে।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তিলাভ করে তিনি লন্ডন যান। লন্ডন থেকেই বঙ্গবন্ধু তাঁর সহধর্মিণী বেগম মুজিবের সঙ্গে প্রথম কথা বলেন।
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ভারত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অবসান ঘটে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের দীর্ঘ প্রতীক্ষার।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে মনোযোগ দেন। সেখানেও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পাশে দাঁড়ান। অনেক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে মর্যাদা সম্পূন্ন জীবন দেন।
স্বাধীনতার বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেন,
‘ এই বীরাঙ্গনা রমণীদের জন্য জাতি গর্বিত। তাঁদের লজ্জা কিংবা গ্ল্যানিবোধের কোনো কারণ নেই। কেননা তারাই প্রথম প্রমাণ করেছেন যে, কেবল বাংলাদেশের ছেলেরাই নয়, মেয়েরাও আত্মমর্যাদাবোধে কী অসম্ভব বলীয়ান।
(তথ্যসূত্র : দৈনিক বাংলার বাণী, ১৭ ফাল্গুন, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ)
বঙ্গমাতার বিচরণ ছিল বাংলা ও বাঙালি প্রতিটি অনুপ্রেরণায়। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে দেশকে তুলে ধরতেও জাতির পিতার সঙ্গে অবদান রেখেছেন। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের সঙ্গে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধীর বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। বিশ্বনেতারা বাংলাদেশ সফরকালেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে থাকতেন তিনি।
শুধুমাত্র তিনি সহধর্মিণী হিসেবে নয়। রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবেও আজীবন প্রিয়তম স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াশরীর ছিলেন তিনি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ইতিহাসের কালজয়ী মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপ্রেরণাদায়িনী হয়ে পাশে ছিলেন। বাঙালি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে ধাপে মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের অবদান রয়েছে। তিনি একজন নীরব দক্ষ সংগঠক। যিনি সূর্যের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালিদের অন্ধকার থেকে রক্ষা করেছেন এবং মুক্তিসংগ্রামে অসামান্য অবদান রেখেছেন,সাথে সাথে বঙ্গবন্ধুকে আকাশসম আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।
বাঙালি জাতির এক অনুপ্রেরণা’র নাম এই মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সপরিবারে স্বাধীনতা বিরোধী খুনিচক্রের বুলেটের আঘাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমৃত্যু অমর সঙ্গী বাংলার মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ৯১তম জন্মবার্ষিকী’তে তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেন করছি।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সাবেক সহসভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ।