চলচ্চিত্র অভিনেতা প্রবীর মিত্রের জন্মদিন আজ

বিনোদন

আব্দুল কাদের সাইফুল : বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের শক্তিমান, প্রানোজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন অভিনেতা প্রবীর মিত্রের জন্মদিন আজ। প্রবীণ অভিনেতাদের মধ্যে সবচেয়ে দর্শক সমাদৃত হচ্ছেন প্রবীর মিত্র। তার এই গ্রহণযোগ্যতা আজ অবধি ধরে রেখেছেন তিনি।


বিজ্ঞাপন

বুধবার (১৮ আগস্ট) জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেতা ‘প্রবীর মিত্রের’ জন্মদিন।

জানা যায়, জন্মদিনটা তিনি ঘরোয়া পরিবেশে সাদামাটাভাবেই পালন করবেন। যেহেতু, বর্তমানে বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত জনজীবন ও পুরো দেশ। সেহেতু, এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তিনি একেবারেই একান্ত পরিবেশে পালন করবেন তার জন্মদিন।

স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে গরীব এতিম ও হতদরিদ্রের সাথে তার জন্মদিনের আনন্দ ভাগাভাগি করবেন। বর্তমানে তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ, সেজন্য মানসিক অবস্থা ভালো নেই। পাশাপাশি, চলচ্চিত্র সংকট ও দেশের আর্থিক বিপর্যয় একজন নাগরিক হিসেবে তিনি কিছুটা বিমর্ষ।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যে অভিনেতাদের জন্য গর্ব করতে পারে তাঁদের মধ্যে একজন কিংবদন্তি অভিনেতা প্রবীরমিত্র। প্রায় ৫ দশকের অভিনয় জীবন তাঁর। অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।

প্রবীর মিত্রের নামটি আসলেই চোখের সামনে অসংখ্য চরিত্রের ছবি ভাসে। তিনি কখনো বাবা, ভাই, ছেলে, বন্ধু, পুলিশ অফিসার, ধনী, গরিব, জমিদার, একতারা দোতারা হাতে শিল্পী, সন্তানহারা পাগল কিংবা হক মওলার মতো চরিত্রও করেছেন। বহুমুখী চরিত্রের অসাধারণ একজন অভিনেতা। মঞ্চ যার ব্যাকগ্রাউন্ড তাঁর তো এমনই হবার কথা। অনেক চরিত্রে নিজের আইডেনটিটি তৈরি করতেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন।

সেই রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন-দের নায়ক আমল থেকে শুরু করে ফারুক, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, জাভেদ, ওয়াসিম, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্না, সালমান শাহ হয়ে পরবর্তী রিয়াজ, শাকিল খান, ফেরদৌস, শাকিব খান হয়ে কাজী মারুফ পর্যন্ত তিনি অনেক নায়কের সাথে পর্দা ভাগ করেছেন নিজের পারফরম্যান্সে। এই বিশাল কর্মপরিধি তাঁকে কিংবদন্তি বানিয়েছে।

প্রবীরমিত্রের অভিনেতা হিসেবে সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁর বলিষ্ঠ ভয়েস। দূর থেকে শুনলেও বোঝা যাবেও প্রবীরমিত্রেরই ভয়েস। আবৃত্তির জন্য এ ধরনের ভয়েস খুব কার্যকরী হয়।

জন্ম ১৮ আগস্ট ১৯৪৪, চাঁদপুর। জমিদার বংশের সন্তান ছিলেন। পুরনো ঢাকায় শৈশব কাটে। স্কুলে নাটক করতেন অনেক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকে প্রায় সব চরিত্রে প্রক্সি দিতে হয়েছিল তাঁকে এবং এখান থেকেই অভিনয়ের নেশা পাকাপোক্তভাবে পেয়ে বসে তাঁকে। ক্লাস টু-তে তাঁর বন্ধু ছিলেন আরেক কিংবদন্তি অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান। বিউটি বোডিং-এ যেতেন আর বিখ্যাত সব মানুষদের সাথে দেখা হত।

চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় ১৯৬৮-তে পরিচালক এইচ আকবরের ‘জলছবি’ ছবিতে। ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছিল একজন শিল্পীর অনুপস্থিতিতে। এটিএম শামসুজ্জামানের স্ক্রিপ্টে ‘জীবনতৃষ্ণা’ ছবিতে ‘এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে’ গানটিতে তিনি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এরপর তাঁর ক্যারিয়ার এগিয়ে যেতে থাকে। বেশকিছু ছবিতে নায়ক এবং প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন।

অসংখ্য ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি :
জলছবি, জীবনতৃষ্ণা, পুত্রবধূ, জয় পরাজয়, দেবদাস, তিতাস একটি নদীর নাম, সেয়ানা, অঙ্গার, রামের সুমতি, নয়নের আলো, রঙিন নবাব সিরাজউদ্দৌলা, আশ্রয়, বাল্যশিক্ষা, ফকির মজনু শাহ, মৌচোর, প্রতিজ্ঞা, গাঁয়ের ছেলে, মধুমিতা, বড় ভালো লোক ছিল, জন্ম থেকে জ্বলছি, চ্যালেঞ্জ, চরিত্রহীন, ঝিনুক মালা, মান সম্মান, ফেরারী বসন্ত, নাজমা, আঁখি মিলন, মান অভিমান, আশীর্বাদ, প্রিন্সেস টিনা খান, সোহেল রানা, জারকা, পরিণীতা, মিস লোলিতা, বেদের মেয়ে জোসনা, যোগাযোগ, গাড়িয়াল ভাই, দোষী, বেদের মেয়ে জোসনা, রাজার মেয়ে পারুল, বদসুরত, রাজাজনি, বিশ্বাস অবিশ্বাস, প্রেমযুদ্ধ, আজ গায়ে হলুদ, প্রিয়া আমার প্রিয়া, ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না, সোনার ময়না পাখি, দেহরক্ষী।

তাঁর চরিত্রাভিনেতা হিসেবে উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি আছে। ‘রঙিন নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছবিতে তিনি আনোয়ার হোসেনের নবাব চরিত্রটি করেছিলেন। পরিচালক প্রদীপ দে-র প্রস্তাবে তিনি প্রথমে কোনোভাবেই রাজি ছিলেন না কারণ আনোয়ার হোসেন তাঁর কাছে গুরু ছিলেন। এফডিসিতে একদিন তাঁকে বললেন চরিত্রটি করার জন্য পরিচালক চাপ দিচ্ছেন।

আনোয়ার হোসেন সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে চরিত্রটি করতে বলেন। তাঁর কাছে সাহস পেয়ে তিনি রিমেক ছবিটিতে প্রধান চরিত্র করলেন এবং এটিও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল দর্শকের কাছে। প্রবীরমিত্রের কণ্ঠেও ‘বাংলা বিহার উড়িষ্যার মহান অধিপতি, তোমার শেষ উপদেশ আমি ভুলিনি জনাব’ সংলাপগুলো বলিষ্ঠ ছিল এবং অভিনয়ও অনবদ্য ছিল।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিতে তাঁর তেজোদ্দীপ্ত লুক ছিল। কবরীকে কোলে করে নিয়ে যাওয়ার যে শটটি আছে ঐ দৃশ্যে তাঁকে অনবদ্য লাগে দেখতে। ‘নয়নের আলো’ ছবিতে জাফর ইকবালের বন্ধুর চরিত্রটি ছিল অসাধারণ।

‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’ গানটিতে জাফরের পাশাপাশি প্রবীরমিত্রের অভিনয়ও উল্লেখ করার মতো। ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিলেন। এ ছবিতে ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুশ’ গানটিতে প্রবীরমিত্রের অভিনয়ই সবচেয়ে ফোকাসে ছিল। এই ছবিতেই তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ১৯৮২ সালে।

প্রবীরমিত্রের লিপে/অভিনয়ে স্মরণীয়, জনপ্রিয় কিছু গানও আছে—
এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে – জীবনতৃষ্ণা
হায়রে মানুষ রঙিন ফানুশ – বড় ভালো লোক ছিল
গুরু উপায় বলো না – পুত্রবধূ

চোখের জলে আমি ভেসে চলেছি – ঝিনুক মালা
প্রাণ খুলে গাও রে বন্ধু জীবনের জয়গান – জয় পরাজয়

আমি শুইনাছি শুইনাছি টাকার পাখা গজাইছে – প্রতিজ্ঞা ভালোবাসি বলেই বন্ধু আমায় কাঁদালে – বাঁশিওয়ালা, চোখ বুজিলেই দুনিয়া আন্ধার – রঙিন প্রাণসজনী, বান্দা তুলেছে দু’হাত – প্রতিজ্ঞা
ভালোবাসা আমাদের প্রাণের বাঁধন – চরম আঘাত
কোন সাধনে পাবো তোমারে – বাঁশিওয়ালা
পথের পানে চেয়ে আছি – ঝিনুক মালা
বিধি কোমল করে পাঠালো আমায় – রাজলক্ষী শ্রীকান্ত
বন্ধু তুমি রবে – আত্মসাৎ
আমার সোনার ময়না পাখি – সোনার ময়না পাখি

ব্যক্তিজীবনে প্রবীরমিত্র সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিলেন তারপর কনভার্ট করেন মুসলিমে।