ভূষনছড়া গনহত্যাপার্বত্য এলাকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণহত্যা

Uncategorized জাতীয়

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঃ পার্বত্য এলাকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণহত্যা। ১৯৮৪ সালের ৩১ শে মে তৎকালীন শান্তিবাহিনী’র নৃশংস গণহত্যার শিকার হন রাঙামাটির দুর্গম ভূষণছড়া এলাকার ৪০০ এর বেশি বাঙালি। ৩১ শে মে, ১৯৮৪ আনুমানিক ভোর ৪টা। তখন ছিলো মরজান মাস। রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলার, ভূষণছড়া গ্রামের সাধারণ নিরীহ মানুষ সেহরি খেয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিতেছে। কিন্তু তারা বুজতেও পারে নি তাদের সাথে ঘটতে যাচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম নিকৃষ্ট এবং ন্যাক্কারজনক ঘটনা।রমজান মাস, সেহরি খেয়ে কেউ ঘুমিয়েছে বা ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনই ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ এবং এর সশস্ত্র সামরিক শাখা শান্তিবাহিনীর ১২৫-১৫০ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী আক্রমণ করে তাদের উপরে। আগ্নেয়াস্ত্র, বেয়নেট, দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় ঘর-বাড়িতে।ঘুমের মধ্যেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় অনেক পরিবার। পুড়িয়ে দেওয়া হয় প্রায় তিন শতাধিক ঘরবাড়ি।
ভোর ৪টা থেকে সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মাত্র চার ঘণ্টার মধ্যে নারী-শিশুসহ সাড়ে চারশর বেশি নিরীহ বাঙালিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। গর্ভবর্তী নারী,ছোট শিশু,বৃদ্ধ কাউকেই বাদ দেয় নি। শিশু, কিশোরী বা সদ্য বিবাহিত তরুণীদের করা হয় গণধর্ষণ, গর্ভবর্তী নারীদের পেট চাকু দিয়ে কেটে বাচ্চা বের করে দেওয়া হয়। সেইসাথে চলে মহিলাদের উপর অমানবিক নির্যাতন। সেদিন প্রায় ১২০-১৩০ জন শিশু, কিশোর, কিশোরী, মহিলাদের নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। পুরুষদের গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। আহত হয় আরও সহস্রাধিক।
দুই ধাপে চলে আক্রমণ। ভোর রাতে আক্রমণ শুরু করার পর
সকালের সূর্য ওঠার আগেই সন্ত্রাসীরা চলে যায়। সকালে সূর্য ওঠার পর রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হওয়া মানুষজন ভাবে যে তারা এখন নিরাপদ। সন্ত্রাসীরা চলে গেছে এই ভেবে যখন বাড়িতে ফিরে আসে ঠিক তখনই তাদের উপর আবারও আক্রমণ করা হয়। এ সময়ই নিকৃষ্ট ও ভয়াবহ হয়ে ওঠে আক্রমণ কারিরা।
এই ঘটনায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় পুরো একটি জনপদ।১৬০০ টি পরিবারের মধ্যে তিন শতাধিক পরিবার সেদিন আক্রান্ত হয়।আক্রান্তদের মধ্যে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ১০০ টির বেশি পরিবার। এর ফলে অন্যান্য পরিবার গুলোও পালিয়ে যায়।
কেন এই নৃশংসতা? রাঙামাটি জেলার ‘বরকল’ উপজেলার একটা দূর্গম ইউনিয়নের নাম “ভূষনছড়া”। রাঙামাটি জেলা শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৭৫ কি.মি.। এই এলাকাটা এতই দূর্গম যে সড়ক পথে যোগাযোগর কোন উপায় নেই। পুরোটাই নদী কেন্দ্রিক।
সত্তরের দশকের শেষদিকে জনসংখ্যার সুষম বণ্টন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ সরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দরিদ্র এবং ভূমিহীন মানুষদের চট্টগ্রামের সরকারি খাস জমিতে পূর্নবার্সন করে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং এর সশস্ত্র সামরিক শাখা শান্তিবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের পূনবার্সন মেনে নেয় নি। এর জন্যই ঘটে এই নৃশংসতা। ঘটনার প্রতিক্রিয়া!
এত অল্প সময়ে এক সাথে এতজন মানুষকে নির্মম ভাবে হত্যার ইতিহাস পৃথিবীতে খুব কমই আছে। কিন্তু এত বড় একটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও তৎকালীন সরকার শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে এই ঘটনাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখে।এই ঘটনা প্রকাশ হলে সারাদেশে ব্যাপি আন্দোলন হবে এবং বাঙালিদের ভয়ে উপজাতিরা ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারে এই অজুহাত দেখিয়ে তৎকালীন সরকার এই ঘটনাটাকে সম্পূর্ণ ধামাচাপা দিয়ে ফেলে। অথচ এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বিক্ষুব্ধ বাঙালিরা উপজাতিদের উপর আক্রমণ চালালে তা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ফলাও করে প্রকাশ করা হয়।
নেওয়া হয় নি কোন মামলাও
এতবড় একটা নৃশংস গনহত্যা হওয়ার পর ও শুধুমাত্র সরকারের নির্দেষের কারণে নেওয়া হয় নি কোন মামলা। বাঙালিরা বারবার চেষ্টা করার পরও ‘বরকল’ থানা কর্তৃপক্ষ
উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ বলে মামলা না নিয়ে শুধুমাত্র একটা সাধারণ ডায়েরি বা জিডি করে রাখে। এই ঘটনার পর তৎকালীন রাস্ট্র প্রধান ‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ’ নিহত এবং আহতদের ক্ষতিপূরণ ও পূর্নবাসবন এর কথা বললেও ক্ষতিগ্রস্তরা কোন সহায়তাই পাই না। নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ২ একর করে সরকারি খাস জমি এবং নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয় নি। মাত্র ৫ হাজার টাকা এবং ১ বস্তা করে চাল দেওয়া হয়। অনেকে সামান্য এই সাহায্যটুকু ও পায় নি। দীর্ঘ ৩৭ বছর পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এই গনহত্যার কোন বিচার হয় নি।তৎকালীন সময়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারনেই এ গনহত্যা স্বীকৃতি পায় নি। এই গনহত্যার সাথে জড়িত সকলেকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করে বিচার করা হোক এটাই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার গুলোর দাবী।পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ষড়যন্ত্র অনেক হয়েছে, প্রচুর রক্ত জড়েছে। সব সময়ই বলী হয়েছে সাধারণ নিরীহ মানুষ। শান্তি চুক্তির এত বছর পরও পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসে নি।


বিজ্ঞাপন