ডাচ ডিজিসের ভীতি বাংলাদেশের জন্য নয়

Uncategorized অর্থনীতি

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ঃ ডাচ ডিজিসের ধারনাটা ১৯৫৯ সালে নেদারল্যান্ডস এ বিশাল গ্যাসক্ষেত্রে আবিস্কারের পর সেদেশের অন্য উৎপাদনশীল খাতের নিম্নমুখী প্রবণতা বোঝাতে ১৯৭৭ সালে প্রথম ব্যাবহার হয়। সারকথা হল, কোন দেশে যদি নির্দিষ্ট সেক্টরের দ্রুত উন্নতি সেদেশের অন্য সেক্টরের উন্নতির জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেই মেকানিজম কেই ডাচ ডিজিস বলে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচূর্য অনেক দেশে সহজ কাঁচা টাকার উৎসে পরিনত হলে, মানুষ কষ্ট করে কৃষি, বা শিল্প খাতে কষ্ট করে আয় করার প্রবণতা কমিয়ে দেয়। এক প্রকার নির্ভরশীলতা সৃষ্টি হয় নির্দিষ্ট সম্পদের উপর। এই ধরুন মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ তেল সম্পদে পরিপূর্ণ। তেল উঠাচ্ছে, বিক্রি করছে, নগদ বৈদেশিক মুদ্রা কামাচ্ছে। নিজেদের অন্য সব সেক্টরে সক্ষমতা সৃষ্টির দিকে নজর বা প্রয়োজনীতা অনুভব কম করছে। বেশ কিছুদিন ধরে ভার্চুয়াল জগৎ ছেয়ে গেছে একটি লেখায়। সেখানে বর্ণনা করা হয়েছে কিভাবে ভেনিজুয়েলা এখন দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। তাদের জিডিপির ৮০% আসে তেল থেকে। জিডিপির অত্যাধিক তেলের উপর নির্ভরশীলতা তাদের কাল হয়েছে। একি অবস্থা হতে চলেছে বাংলাদেশের ও। আসলে ই কি তাই? সত্যি কি বাংলাদেশ শেষ হয়ে যাবে? প্রথমে ভেনিজুয়েলার ক্রাইসিস কিভাবে শুরু হল সেটা নিয়ে অল্প আলোচনা করা যাক ভেনিজুয়েলা ওপেকের সদস্য একটি দেশ। বিশ্বের সব থেকে বেশি তেলের রিজার্ভ আছে এমন দেশের ভেতর ভেনিজুয়েলা অন্যতম। ভেনিজুয়েলার মোট রপ্তানি আয়ের ৯৫% আসে তেল রপ্তানি করে। তেলের টাকা কাচা টাকা। তেলের মত প্রাকৃতিক সম্পদ রপ্তানিতে কোন শ্রম দেয়া লাগে না। সহজ টাকার উৎস থাকার কারনে ভেনিজুয়েলা তাদের অন্য ইন্ডাস্ট্রি দাড় করানোর চেষ্টাও করেনি।অনেকটা আরবদের মত অলস প্রকৃতির হয়ে গেছে তারা। ভেনিজুয়েলা তাদের তেল রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত অর্থ থেকে খাদ্য সহ বিভিন্ন দ্রব্য আমদানি করে নিশ্চিন্তে চলত। সমস্যা বাধে ২০১৪ সালে।তেলের দাম $১০০ ডলারের উপর ছিল কিন্তু হঠাৎ দর পড়তে পড়তে তলানিতে ভলে যায়। $১০০ এর বেশি ব্যারেল প্রতি তেল $৩০ এর কাছাকাছি নেমে আসে।এতেই বাধে বিপত্তি। তাদের রপ্তানি কমে যায়। রপ্তানি আয় দিয়ে আমদানির চাহিদা মেটাতে ব্যার্থ হয়। দেখা দেয় তিব্র ডলার সঙ্কট। ফলে তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার মত অর্থ তাদের কাছে ছিল না। এর প্রভাব পড়ে ভেনিজুয়েলার মুদ্রা বলিভারের উপর। মানুষের হাতে অর্থ আছে কিন্তু পণ্য নেই।এর ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। দাম বৃদ্ধি পাবার পর সরকার একটা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। অনেকটা জিম্বাবুয়ের মত টাকা ছাপাতে থাকে। আর শ্রমিকের মজুরি ৩৪ গুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। কিন্তু যেহেতু পণ্য নেই তাই বাজারে অতিরিক্ত টাকার প্রবাহ মূল্য স্ফীতির বিস্ফোরণ ঘটায়। শেষ পর্যন্ত তাদের মুদ্রা স্ফীতি ১০,০০,০০০% এ গিয়ে দাঁড়ায়।
অনেকেই এই পরিস্থিতিকে বাংলাদেশের সাথে মেলাচ্ছেন যেটা একে বারেই ঠিক নয়। বাংলাদেশের মানুষ পায়ের উপর পা তুলে খাই না। যথেষ্ট পরিশ্রম করে খেটে খাওয়া মানুষ এই বাংলাদেশিরা ১৯৭১ সালে সব কিছু শূন্য থেকেই শুরু করেছিল ।আমাদের তেলের মত কোন প্রাকৃতিক সম্পদ নেই যে আমরা বসে বসে আলসেমি করব আর তেল বেচা টাকা দিয়ে বিদেশ থেকে পণ্য কিনে ক্ষুধা নিবারণ করব। আমাদের কৃষক মাঠেই খাটেন। বিশ্বের ধান উৎপাদনে ৪র্থ এমনি এমনি নয়। বর্তমানে ৩য়। এদেশের মানুষ প্রাকৃতিক এবং মানব সৃষ্ট নানান দূর্যোগ মোকাবেলায় অভ্যস্থ। দেশের মানুষ বাড়ির উঠানে অল্প জায়গা পেলে সেখানেও লাউ বা সিম অথবা অন্য কোন গাছ লাগিয়ে নিজেদের স্বাবলম্বী করে তুলেছে। এদেশের খাদ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য আমদানির উপর নির্ভর করা লাগে না।গার্মেন্টস এর উপর অতিনির্ভরতা কথাটা সঠিক নয়। এটা একটা শিল্প। এর বিকাশ হয়েছে। বর্তমানে রপ্তানির বেশিরভাগ আসে গার্মেন্টস থেকে। তবে বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের জন্য আমাদের প্রায় মোট রপ্তানির সমান রেমিট্যান্স ও বিনিয়োগ আসে। গার্মেন্টস শিল্পে বিকাশের কারনে অন্য শিল্প থেমে আছে এমন ও নয়। গার্মেন্টস শিল্প শ্রমের শিল্প। এটা বিলাসিতা নয়। তেল বা গ্যাস বিক্রি করলাম আর টাকা পেলাম এমন নয় বরং এখানে প্রতিযোগীতা করেই টিকতে হয়। বাংলাদেশে গার্মেন্টস বাদেও অনেক শিল্প দাঁড়িয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। আগে অনেক পণ্য আমদানি করে চলা লাগত। সেই সকল পণ্য এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। ফলে এটা রপ্তানির অংকে প্রদর্শিত না হলেও আমদানি নির্ভরতা কমানোতে অবদান রাখছে। সিমেন্ট, বলপেন, সিরামিক, কিচেনওয়ার, স্টিল, গ্লাস, টিভি, ফ্রিজ, মোটর সাইকেল, গাড়ি, মোবাইল, ফুড প্রসেসিং, প্লাস্টিক, থেকে শুরু করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট এখন দেশে তৈরি হচ্ছে। জাহাজ নির্মিত হচ্ছে। এজন্য যারা ডাচ ডিজিচ নিয়ে আর এদেশের গার্মেন্টস নিয়ে বার বার ভয় দেখান তাদের চিন্তার পরিসর আরেকটু বড় করা উচিত।
অপরিশোধিত তেল কোন ইন্ডাস্ট্রির ভেতর পড়েনা যেটার উপর নির্ভর করা যায়। এটা হল জুয়া খেলা। সম্পদ বেচা।তেলের দাম কখন কেমন থাকবে এর কোন গ্যারান্টি নেই। $১১০ ডলার ব্যারেলের তেল $৩০ ডলারে নামা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তাই তেলের উপর যদি অর্থনীতির ৮০% এর অধিক নির্ভর করে তাহলে বুঝতে হবে সেই দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি আসলেই দূর্বল। গার্মেন্টস সেক্টর তেলের মত না। যদি কখনো তেলের বিকল্প জ্বালানি আবিষ্কার হয় তাহলে মধ্য প্রাচ্য সহ বহু দেশ নিঃস্ব হয়ে পড়লে সেটা অসম্ভব হবে না। কিন্ত গার্মেন্টস এর কি বিকল্প আবিস্কার হবে বা আছে? না। মানুষকে কাপড় পরতেই হবে। আর বাংলাদেশ এর বেশিরভাগ গার্মেন্টস নিত্যপ্রয়োজনীয় শার্ট গেঞ্জি। দামি বা বিলাসবহুল প্রোডাক্ট নয়। এই কাপড় সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা চললে ও চাহিদা থাকে। কারন গোল গলা গেঞ্জি যার দাম মাত্র ১০০ টাকা সেটা মানুষ কিনবেই।
গার্মেন্টস শিল্পের ধরনের সাথে তেলের কোন মিল নেই। এটা খেটে খাওয়া শিল্প। আলসেমির শিল্প নয়। আর গার্মেন্টসের ক্ষেত্রে যদি এমন হয় যে বৈশ্বিক মন্দা চলছে তখন বিলাসবহুল গার্মেন্টস আইটেমের বাজার মন্দা যেতে পারে কিন্তু বাংলাদেশের কম মূল্যের নিত্য প্রয়োজনীয় পোষাকের বাজারে খুব সীমিত প্রভাব পড়বে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *